× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

২৫ বৈশাখ

রবীন্দ্রনাথ ও জাতীয় সংগীত

হারুন হাবীব

প্রকাশ : ০৮ মে ২০২৪ ০৯:২২ এএম

হারুন হাবীব

হারুন হাবীব

যুগে যুগে সব ভাষায় অসাধারণ এবং আকর্ষণীয় সব সংগীত রচিত ও গীত হয়েছে। কিন্তু জাতীয় সংগীতের নির্বাচন সেসব সংগীতের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। কারণ সব রাষ্ট্রেই জাতীয় সংগীতের বিশেষ অবস্থান ও আবেদন আছে, আছে তার নির্বাচনী ব্যাখ্যা; যা জনপদভেদে নিজস্ব জন্মকথায় ভাস্বর। বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত কেবল স্বাধীন রাষ্ট্রের সংগীত নয়, এ সংগীত গীত হয়েছে পাকিস্তানের সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী গণআন্দোলনে, এমনকি এ সংগীত বল দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধের মাঠে, হানাদার পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর রক্তক্ষয়ী জনযুদ্ধে। কাজেই ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’র ইতিহাস গতানুগতিক সংগীতের ইতিহাস নয়।

বাংলার মাটি-জল-ঋতু, আকাশ ও প্রকৃতি বন্দনায় রচিত কবিগুরুর এ কালজয়ী সংগীতকে বুকে ধারণ করে লাখো বাঙালি যুবক জননী-জন্মভূমির ভালোবাসায় জীবন বিলিয়েছে, দেশ পরাধীনতা থেকে মুক্ত-স্বাধীন করেছে। সেই ভালোবাসায় সিক্ত হওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল আমারও একজন হয়ে। অতএব এ গানের দীপ্তি ও আবেদন বঙ্গের অমলিন রক্ত-শপথে সিক্ত। বাংলাদেশের ইতিহাস প্রেক্ষাপটে কবিগুরুর এ গান আমাদের জনপদে মা-প্রকৃতির বন্দনায় অসামান্য এক সৃষ্টি, যার কথা-সুর-দ্যোতনা অনাবিল আনন্দধ্যানে বাংলার প্রকৃতি পরিস্ফুট করে।

শুধু ভারত ও বাংলাদেশ নয়, শ্রীলঙ্কার জাতীয় সংগীতও রবীন্দ্র-আশীর্বাদপুষ্ট। ব্রিটিশ শাসনের অবসানে এবং নতুন ভারতের উত্থানে ভারতের জাতীয় সংগীত নির্বাচিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথের ‘জনগণ মন’ ১৯৪৭ সালে, বাংলাদেশের ‘আমার সোনার বাংলা’ হয়েছে ১৯৭১ সালে। বিশ্বভারতীর গ্রন্থনায় জানা যায়, শ্রীলঙ্কার জাতীয় সংগীতটিও প্রথম রচনা করেন রবীন্দ্রনাথ। ‘নম নম নম মাতা’ গানটি প্রথম লেখেন এবং সুর আরোপ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। শান্তিনিকেতনে তার প্রিয় ছাত্র শ্রীলঙ্কার আনন্দ সমরাকোনের অনুরোধে কবিগুরু বাংলায় গানটি রচনা ও সুরারোপ করেন ১৯৩৮ সালে। এরপর আনন্দ সমরাকোন দেশে ফিরে যান এবং গানটি সিংহলি ভাষায় রূপান্তর করেন। সুরও রাখেন তার গুরুর। ১৯৪৯ সালের ৪ ফেব্রুযারি গানটি শ্রীলঙ্কার প্রথম স্বাধীনতা বিদসে গীত হয়।

একবার নয়, বারবার চেষ্টা হয়েছে আমাদের জাতীয় সংগীত  এবং এর রচয়িতা রবীন্দ্রনাথকে বিতর্কের মধ্যে এনে ফায়দা লোটার! যারা এ অপচেষ্টা করেছেন তার বেশিরভাগই ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতায় জর্জরিত লোক, যারা বাঙালির অসাম্প্রদায়িক জাতিসত্তা প্রশ্নবিদ্ধ করতে নিরন্তর ফন্দিফিকির করে চলেছেন। এদের কেউ কেউ আবার এমন সব গোত্রের যারা সমকালীন পছন্দনীয় গানের ভক্ত হয়ে ইতিহাস অগ্রাহ্য করার মূর্খতা দেখান! ভালো কথা, ভাল গান বা সুমধুর সংগীত যুগে যুগেই রচিত ও গীত হয়েছে এবং হবেও; কিন্তু সেগুলো জাতীয় সংগীতের মর্যাদা পায় না। যদি তাই হতো তাহলে সব রাষ্ট্রেই যুগে যুগে জাতীয় সংগীতের পরিবর্তন ঘটত!

পাকিস্তান আমলের ‘ব্যুরো অব ন্যাশনাল রিকনস্ট্রাকশন’ বা বিএনআরের জন্ম দিয়ে সাম্প্রদায়িক বিভাজন সৃষ্টির সরকারি যাত্রা শুরু হয়েছিল। পাকিস্তানের সংহতির পক্ষে লেখার জন্য ভাড়া করা হয়েছিল কয়েক ডজন লেখক। এর আগে এবং পরে বিচ্ছিন্নভাবে হলেও এ অপকর্ম থেমে থাকেনি যৌথ পাকিস্তানের ২৩ বছরে। পূর্ববঙ্গের স্বাধীকার আন্দোলন পথভ্রষ্ট করতে নানা পথে আঘাত হেনেছে ধর্মান্ধ ও উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তি। আমরা দেখেছি, মুক্তিযুদ্ধের সময় রবীন্দ্রনাথ ও তার গান নিয়ে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়ানো হয়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের কুশীলবরা জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের উদ্যোগ নিয়েছে। জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতাসীন হওয়ার পর একটি মহলের কয়েক দফা চেষ্টা চলেছে জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের। এরপর বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় বিশেষত জামায়াতে ইসলামীর যুদ্ধাপরাধী নেতারা জাতীয় সংগীত পরিবর্তনে জোর উদ্যোগ গ্রহণ করেন। কারণ তারা জানেন এ সংগীত পরিবর্তন করা গেলে একটা বড় যুদ্ধে জেতা যাবে। অর্থাৎ একদিকে সরকার অন্যদিকে ১৯৪৭-এর চেতনাধারী বুদ্ধিজীবীরা লাগাতার তৎপর থেকেছেন জাতীয় সংগীত পরিবর্তনে। অতএব আক্রান্ত হয়েছেন রবীন্দ্রনাথ, এমনকি কাজী নজরুলকেও বিধর্মী বলার চেষ্টা হয়েছে! কিন্তু তাদের কোনো প্রচেষ্টাই সফল হয়নি।

তবে এ উদ্যোগগুলো বিচ্ছিন্ন মনে হলেও হতে পারে এবং কারও কারও কাছে মত প্রকাশের স্বাধীনতাও মনে হতে পারে, কিন্তু আমার তা মনে হয় না। হয় না এ কারণে যে, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বয়স যখন ৫০ বছর পেরিয়েছে, তখনও দ্বিজাতিতত্ত্বের অনুসারীরা ১৯৭১-এর ইতিহাস-চেতনার পরিবর্তন ঘটিয়ে ১৯৪৭-এর চেতনার পুনঃস্থাপন চাইতে সুস্পষ্টভাবে তৎপর! তারা নিজেদের মতো করে পাঠ্যপুস্তক সংস্কার চায়, নিজেদের রাজনীতির চাহিদা অনুযায়ী পাঠ্যসূচিতে পরিবর্তন চায়। বলা বাহুল্য, ‘আমার সোনার বাংলা’ বাংলার প্রকৃতির নিখুঁত উপস্থাপন। বাংলার আলো-বাতাস, ঋতুবৈচিত্র্য, নদ-নদী মিলে যে অপরূপ বাংলাদেশ, যে বাংলাদেশ আমাদের মা-মাতৃভূমি-জননী-জন্মভূমি; সেই মায়ের বন্দনাই এ গান যার স্রষ্টা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। দেশবন্দনার আরও অনেক উৎকৃষ্ট সংগীত যে নেই তা বলা যাবে না নিশ্চয়, কিন্তু ‘আমার সোনার বাংলা’র যে আবেদন, তা চিরায়ত বাংলার রূপ, যা আমরা চোখে দেখি, আলো-বাতাসে শিহরিত হই এবং অন্তরে অনুভব করি।

এ গানটি রচিত হয় বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময়, ১৯০৬ সালে। এ গান গেয়েই অবিভক্ত বঙ্গের জয়গান গেয়েছেন প্রতিবাদীরা। পাকিস্তানবিরোধী গণআন্দোলনে এবং মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে গানটি ব্যাপকভাবে গীত হয়ে পূর্ব বাংলা বা পূর্ব পাকিস্তানের দেশপ্রেমিকদের সশস্ত্র করেছে। মুক্তিযুদ্ধের কয়েক সপ্তাহ আগে, ’৭১-এর ৩ মার্চ বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে ঘোষণার প্রস্তাব করা হয় ঢাকার পল্টন ময়দানে। ’৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের ঐতিহাসিক শপথগ্রহণ ঘটে এ গানটি গীত হয়ে। পাকিস্তানের কারাগার থেকে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি বেরিয়ে ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁরই সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে, ১৩ জানয়ারি, ১৯৭২-এ গানটির প্রথম ১০ লাইন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জাতীয় সংগীত হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি লাভ করে।

মোটকথা, যৌথ পাকিস্তানের ২৩ বছরের জীবনে রবীন্দ্রবিরোধিতা ছিল সামরিক শাসক ও তাদের দোসর উগ্রসাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর হাতে পরিচালিত পরিকল্পিত এক কর্মসূচি; নিজেদের রাজনীতির স্বার্থে ওরা রবীন্দ্রনাথকে ‘বিধর্মী’ বা ‘বিজাতীয়’বলে দূরে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে। সরকারিভাবে রবীন্দ্রনাথ নিষিদ্ধ হন। পাঠ্যপুস্তক ও সরকারি প্রচারযন্ত্রে রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ হয়। কিন্তু যে রবীন্দ্রনাথ বাঙালির অবিভাজ্য সাংস্কৃতিক প্রেরণা, তাকে দূরে রাখা যায়নি। যে পূর্ববঙ্গের মানুষ বাংলা ভাষার অধিকার ছিনিয়ে আনতে সংগ্রাম করে; যে মানুষ লালন-রবীন্দ্র-নজরুলের মনুষ্যবাদে দীক্ষিত, তারা কবিগুরুকে আঁকড়ে ধরেছে প্রাণশক্তির উৎস হিসেবে; বাধা যত এসেছে রবীন্দ্রনাথ ততই প্রাণের রবীন্দ্রনাথে পরিণত হয়েছেন। অবধারিতভাবেই বলা যায়, পূর্ব বাংলা বা বাংলাদেশের মানুষের জন্য রবীন্দ্রনাথ জরুরি। জরুরি তিনি জাতীয়তার প্রশ্নে, যে জাতীয়তা বাঙালির আত্মপরিচয় ও আত্মরক্ষার বর্ম।

বলা বাহুল্য, এ জাতীয়তাবাদের যেমন বাইরের শত্রু আছে তেমন আছে ভেতরের। যেটাকে আমরা বাইরের বলি তা হলো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ থেকে উৎসারিত অপতৎপরতা। রবিঠাকুর সে তৎপরতার বিরুদ্ধে সচেতন থেকে মানুষকে সজাগ করার চেষ্টা করেছেন। ভেতরের শত্রু নিয়েও তিনি ভেবেছেন। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতা সহজে পরাস্ত হওয়ার নয়। কারণ শ্রেণি শোষণ ও স্বার্থ। একদিকে ব্রিটিশ এবং পরে পাকিস্তানি শাসকরা এ শ্রেণিশোষণ উস্কে দিয়ে সাম্প্রদায়িকতা বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে বাঙালি জাতীয়তায় বারবার ফাটল ধরেছে। হিন্দু ও মুসলমান উগ্রপন্থিরা ধর্মের ভিত্তিতে দেশ ভাগ করেছে। সত্যি বলতে কি, আমার মনে হয় রবীন্দ্রনাথ সর্বতোভাবে বাঙালি ঐক্যবদ্ধ মুক্তি কামনা করেছেন; যা ঘটেনি বা পারেননি তিনি নিজেও। তবে এ না পারা তার ব্যর্থতা নয়; এ ব্যর্থতা আমাদের নির্বুদ্ধিতার। স্মরণযোগ্য, বাঙালি জীবনের যা কিছু শুভ, যা কিছু মঙ্গল তার সবটাই অসাম্প্রদায়িক জাতিসত্তার সম্মিলিত অর্জন। পাকিস্তানি রাষ্ট্রযন্ত্রের হাতে রবীন্দ্রনিষিদ্ধের প্রতিবাদে মুখর হয়েছিলেন স্বয়ং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। উচ্চকণ্ঠে তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা এ ব্যবস্থা মানি না। আমরা রবীন্দ্রনাথের বই পড়বই, আমরা রবীন্দ্রসংগীত গাইবই এবং রবীন্দ্রসংগীত এ দেশে গীত হবেই।’

সে কারণে বলি, বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের বাইরের রবীন্দ্রপ্রেমীর কাছে রবীন্দ্রনাথ সমানভাবে আসেননি, অন্যদের কাছে তিনি প্রাকৃতিক হলেও আমাদের কাছে কষ্টার্জিত অর্জন, প্রেম ও দ্রোহের প্রেরণা। কাজেই ‘আমার সোনা বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ আমাদের শক্তি ও অহংকার। সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির কূটচালে তাকে বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব নয় এবং এর সাক্ষ্য ইতোমধ্যে বহুবার মিলেছে।

  • বীর মুক্তিযোদ্ধা, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা