× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

রাজনীতির গতিপথ ও আশা-দুরাশার ভবিষ্যৎ

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

প্রকাশ : ১২ নভেম্বর ২০২২ ১৫:১০ পিএম

অলঙ্করন : জয়ন্ত জন

অলঙ্করন : জয়ন্ত জন

আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সুস্পষ্ট কিছু লক্ষ্য ছিল। এও সত্য, মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট এক দিনে তৈরি হয়নি। জাতি যে লক্ষ্য নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছিল সেই লক্ষ্য কি পূরণ হয়েছে? এই প্রশ্নের উত্তর অন্তহীন নয়। ইতোমধ্যে আমরা স্বাধীনতা অর্জনের পঞ্চাশ বছর অতিক্রম করেছি। এই পঞ্চাশ বছরে আমাদের অর্জন কিংবা অনার্জন কী, এই নিয়ে প্রশ্ন উঠছে ফিরে ফিরে। দেশ-জাতির কল্যাণে আমাদের নীতিনির্ধারকদের অঙ্গীকার-প্রতিশ্রুতির ঘাটতি আছে বলে মনে হয় না। কিন্তু তাদের অনেকেরই আন্তরিকতা কিংবা সদিচ্ছা নিয়ে একই সঙ্গে কারও কারও দেশপ্রেম নিয়ে যে প্রশ্ন ফিরে ফিরে আমাদের সামনে আসে তা এড়িয়ে যাওয়ার অবকাশ কতটা আছে? এই জিজ্ঞাসার উত্তরও নয় অস্পষ্ট।

দেশের বর্তমান রাজনৈতিক চিত্র কি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংজ্ঞা-সূত্রের সাক্ষ্য বহন করে? সব রাজনৈতিক দলের জন্য অধিকারের মাঠ কি সমতল? এসব প্রশ্নের উত্তর প্রীতিকর নয়। এই পরিস্থিতি এক দিনে সৃষ্ট নয়, আরও বহু আগেই এর সূচনা। যেমন বলা যায়, আমাদের দেশের রাজনীতিতে বাকযুদ্ধের বিরূপ প্রভাব কখনও কখনও প্রকটভাবেই দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। চলমান বৈশি^ক সংকটকে সামনে রেখে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে যে বাকযুদ্ধ চলছে তাতে হতাশই হতে হয়। কারণ, এই সংকটের প্রেক্ষাপটে দেশে খাদ্যঘাটতির যে আশঙ্কা করা হচ্ছে এ নিয়ে প্রয়োজন সরকার তো বটেই একইসঙ্গে সব রাজনৈতিক দলেরই যূথবদ্ধ প্রচেষ্টা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, আমরা তেমনটি যতটা না দেখছি এর বিপরীত চিত্রটিই বেশি করে দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। 

বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধকালে সমাজতন্ত্রের কথা শোনা গিয়েছিল। যুদ্ধের আগেও, ঊনসত্তরের সময়েই, জাতীয়তাবাদী নেতারাও সমাজতন্ত্রের পক্ষে বলাবলি শুরু করেছিলেন। অর্থাৎ বাধ্য হয়েছিলেন বলতে। উদ্দেশ্য আন্দোলনরত মানুষকে নিজেদের বেষ্টনীর ভেতর ধরে রাখা। নতুন রাষ্ট্রের সংবিধানে যে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি থাকবে সেটাও ছিল অত্যন্ত স্বাভাবিক; উজ্জ্বল অক্ষরে সেটা লেখাও হয়েছিল। কিন্তু যতই সময় পার হতে থাকল, ততই অনেকটা প্রভাত কাটিয়ে ভরদুপুরের আগমনের মতো, পরিষ্কার হয়ে উঠল এই সত্য যে রাষ্ট্র ধরেছে পুরাতন পথ, চলেছে সে পুঁজিবাদী ধারাতেই। এমনটি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপরীত। এমনটা যে ঘটবে কেউ কি কখনও ভেবেছিল? বাংলাদেশের অভ্যুদয় ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদীর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য। প্রেরণা ছিল বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার। বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষা হয়েছে ঠিকই, না-হয়ে উপায় ছিল না, কিন্তু রাষ্ট্রের ভাষা হয়নি। স্বপ্ন ছিল একটি অভিন্ন শিক্ষাধারা গড়ে তোলার; সে স্বপ্ন কুপোকাত হয়ে স্বাপ্নিকদেরকে লজ্জা দিচ্ছে। সবকিছুই ঘটল একটি কারণে। সেটি হলো সমাজতন্ত্রীদের অকৃতকার্যতা। মুক্তির সংগ্রামে জাতীয়তাবাদীরা ছিলেন, সমাজতন্ত্রীরাও ছিলেন। সমাজতন্ত্রীরাই ছিলেন মূল শক্তি, তারাই আন্দোলন গড়ে তুলেছেন, এগিয়ে নিয়েছেন, কিন্তু নেতৃত্বে থাকতে পারেননি। ‘পিরানহা’ মাছ যেখানে থাকে সেখানে অন্য মাছেরা বিপদে পড়ে, কারণ ‘পিরানহা’ বাঁচে অন্য মাছ ভক্ষণ করে। বাংলাদেশের সর্বত্র এখন ওই মাছের দৌরাত্ম্য; অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক সর্বত্র সে ব্যাপক হারে ছোট মাছেদের উদরস্থ করছে। স্বভাবতই তার চোখ দুর্বলদের ওপর। বাংলাদেশে তাই এমনসব ঘটনা ঘটছে যা আগে কখনও কল্পনাও করা যায়নি। শিশুরা ধর্ষিত হচ্ছে, ধর্ষণের পরে তারা নিহতও হচ্ছে। কিশোর আবরার নিহত হয়, অন্যের অপরাধে আরেকজন জেল খাটেন। সাগিরা মোর্শেদ বাঁচতে পারেন না। 

ক্রিকেটে বাংলাদেশ ভালো করছিল। আমাদের খেলোয়াড়রা ইতোমধ্যেই বিশ্বমাপে উন্নীত হয়েছেন। জাতির জন্য তারা গৌরব বয়ে নিয়ে এসেছেন। কিন্তু অবস্থানটা ধরে রাখতে পারছেন কি? পারছেন না। যেমন চলমান টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশের ছিটকে পড়া ক্রিকেটপ্রেমীদের আশাহত করেছে। পুঁজিবাদ সেখানেও ঢুকে পড়েছে। জাতীয় সম্মানবোধের যে চেতনা নিয়ে তারা যাত্রা শুরু করেছিলেন সেটা এখন যে আর অক্ষত নেই। তাদের ঐক্য এখন আর অনড় নয়, ঐক্যের ভেতরে ব্যক্তিস্বার্থের অন্তর্ঘাতও তো নিকট অতীতে দৃশ্যমান হয়েছিল। সবকিছু ভাঙছে, খেলোয়াড়দের দেশপ্রেম কেন ভাঙবে না? সবাই সর্বক্ষেত্রে জিজ্ঞাসা করে, আমি কী পেলাম? সবাই শুধু পেতে চায়, দিতে ভুলে গেছে। অথচ দিয়েছে তো। প্রাণ দিয়েছে মুক্তিসংগ্রামে। শুরুটা যার অনেক আগে, এর চূড়ান্ত পরিণতি একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যমে। একাত্তরের মুক্তির সুফল এখন কার বা কাদের হাতে? অনেকেই আক্ষেপ করে বলেন, রাজনীতি রাজনীতিকদের হাতছাড়া হয়ে যাছে। স্বাভাবিকভাবেই খুবই দুশ্চিন্তার কথা। 

রাজনীতিকরা রাজনীতি করবেন এটাই স্বাভাবিক। রাজনীতি যদি রাজনীতিকদের হাতছাড়া হতে থাকে তাহলে জনপ্রত্যাশা হোঁচট খাবেই। রাজনীতির ময়দানে অনেক স্ববিরোধী ও হীন-স্বার্থবাদী আছেন। তারা যখন যখন একাত্তরের কথা খুব জোরে জোরে বলেন, তখন সন্দেহ হয় ভেতরটা শূন্য এবং তালটা মুনাফার। পণ্য হিসেবে একাত্তরকে ব্যবহার করছেন। একাত্তরের চেতনাটা ছিল সমাজবিপ্লবের; সেটাকে ঢেকে রেখে কথা বলা একাত্তরের শহীদদেরকে ও মুক্তিযোদ্ধাদেরকে অপমান করা বৈকি। বুঝুন আর নাই বুঝুন, ওই কাজটা যারা করেন তাদের উদ্দেশ্য মুনাফার দিকে, অন্য কিছু নয়। রাষ্ট্রের জন্য অত্যাবশ্যক ছিল স্বাধীনতার পরপরই হানাদার শয়তানদের বিচার। নিকৃষ্টতম অপরাধী হিসেব ১৯৫ জনকে চিহ্নিতও করা হয়েছিল। কিন্তু রাষ্ট্র তাদের বিচার করতে পারেনি। অপরাধীরা সবাই চলে যায় তাদের দেশে। এত বড় অপরাধের যখন বিচার হলো না তখন আশঙ্কা করা স্বাভাবিক হলো যে এ রাষ্ট্রে ন্যায়বিচার পাওয়াটা সহজ হবে না। পরবর্তীতে প্রমাণ হয়েছে যে আশঙ্কাটা অমূলক ছিল না। তবুও স্বস্তির, বিলম্বে হলেও বড় বড় যুদ্ধাপরাধীর বিচার হয়েছে, এরই মধ্যে অনেকের দণ্ডও কার্যকর হয়েছে এবং এই বিচার এখনও চলমান। তবে বিচার প্রক্রিয়া আরও গতিশীল করতে হবে এবং একাত্তরের সব অপরাধীকে খুঁজে খুঁজে বের করে দেশ-জাতির বৃহৎ স্বার্থেই তাদের বিচার সম্পন্ন করতে হবে। 

আমাদের রাষ্ট্র পুঁজিবাদী। বিশ্বপুঁজিবাদী ব্যবস্থার এক প্রান্তে তার আত্মসচেতন অবস্থান; পুঁজিবাদের গুণগুলো যেমন-তেমন, পুঁজিবাদের যত দোষ আছে সবগুলোই সে আত্মস্থ করে ফেলেছে এবং ক্রমবর্ধমান গতিতে বিকশিত করে চলছে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটা অসংশোধনীয়রূপে পিতৃতান্ত্রিক; যে জন্য এই ব্যবস্থায় মেয়েরা নিরাপত্তা পায় না এবং নানাভাবে লাঞ্ছিত হয়। পদে পদে তাদের বিপদ। গৃহে সহিংসতা, পরিবহনে হয়রানি। একাধিক জরিপ বলছে, বাংলাদেশে মেয়েদের শতকরা ৮৫ জন উন্মুক্ত স্থানে হয়রানির শিকার হয়। অনেক ক্ষেত্রেই অভিযুক্তরা পার পেয়ে যায় কোনো না কোনোভাবে। তবে এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ছত্রছায়ার যে অভিযোগ রয়েছে তা বড়ই উদ্বেগের। এ অবস্থা অব্যবস্থারই বিরূপ ফল। তাই ব্যবস্থার বদল না করে অবস্থার পরিবর্তন দুরাশা মাত্র। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তরা চারদিকে আস্ফালন করছে। যখন যে রাজনৈতিক দল সরকার গঠন করে ক্ষমতায় আসে তখন তাদের বলবানরা নিজেদের স্বার্থে এদের প্রতিপালন করে। রাজনীতির নামে এই অপরাজনীতি সমাজে যে অপছায়া ফেলেছে তা সরাতে হবে রাজনীতিকদেরই। সুস্থ রাজনীতির কোনো বিকল্প নেই। দেশ চালাবেন রাজনীতিকরা, তারাই স্বচ্ছতার ভিত্তিতে জনরায় নিয়ে সরকার গঠন করবেন। কিন্তু গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে সরকার গঠনের অন্যতম যে প্রধান প্রক্রিয়া নির্বাচন কিংবা ভোট এ নিয়েও বিস্তর নেতিবাচক প্রশ্ন রয়েছে। এও কিন্তু প্রশ্নবিদ্ধ ব্যবস্থারই বিরূপ ফল। রাজনীতিকদের স্বচ্ছতা-দায়বদ্ধতা-জবাবদিহি নিশ্চিত করা চাই সর্বাগ্রে যা অনেকটাই হারিয়ে গেছে। অথচ আমাদের রাজনীতির অতীত গৌরবোজ্জ্বল। এবং আমাদের রাজনৈতিক অর্জনও অনেক। কিন্তু তা হারিয়ে গেল হীনস্বার্থবাদীদের চক্রান্তে স্বাধীনতা অর্জনের পর কয়েক বছরের মধ্যেই। রাজনীতির অতীত ফিরিয়ে আনতে হবে এবং বিদ্যমান ব্যবস্থা যেসব ক্ষেত্রে প্রশ্নবিদ্ধ তা প্রশ্নমুক্ত করতে হবে। 

একটা ভরসা এই যে দুষ্ট লোকেরা যতই ক্ষমতাবান হোক, ভালো মানুষেরাও আছেন এবং তাদের সংখ্যাই অধিক। খুব দূর অতীতের ঘটনা নয়। মনে পড়ছে বগুড়ার লাল মিয়ার কথা। লাল মিয়া সামান্য রিকশাচালক। কিন্তু তিনি অসামান্য এক কাজ করেছেন। একজন যাত্রী ভুল করে লাল মিয়ার রিকশায় ২০ লক্ষ টাকা ভর্তি একটি ব্যাগ ফেলে যান। লাল মিয়া যাত্রীকে খুঁজতে থাকেন, তাকে না-পেয়ে ব্যাগ নিজের জিম্মায় রেখে দেন। মালিক ব্যাগের সন্ধান করবেন এই আশায়। মালিক ঠিকই রিকশাচালক লাল মিয়ার সন্ধান করেন এবং যা তিনি ঘটবে বলে ভরসা করেননি তাই ঘটে, লাল মিয়া নিজের-কাছে-রাখা ব্যাগটি মালিককে ফেরত দেন। আমাদের সরকারি ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা যখন লোপাট হয়ে যায় তখন এই ভালো মানুষের খবরটা আশা জাগায় বৈকি এবং ঘটনাটি যে ব্যতিক্রম তাও বলা যাবে না। এরকমের ভালোমানুষির দৃষ্টান্ত প্রায় সর্বত্রই পাওয়া যাবে। 

কিন্তু ভালো মানুষেরা তো দুর্বল, তাদের ক্ষমতা নেই, তারা বিচ্ছিন্ন, একাকী এবং গোটা ব্যবস্থাটা তাদের বিরুদ্ধে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কর্তৃত্ব অসাধুদের হাতে। তবে ভালো মানুষরা পারেন যখন তারা একত্রিত হন। মানুষ একত্রিত হয়েছিল বলেই আইয়ুব খানের পতন, বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছে। ভালো মানুষরা একত্রিত হয়ে অনেক অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন। এমন উদাহরণ কি স্বাধীন বাংলাদেশেও আমাদের সামনে নেই? আছে এবং আশা তো সেখানেই। 


লেখক : শিক্ষাবিদ ও সমাজ বিশ্লেষক


শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা