× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

সম্পাদকীয়

জাহাঙ্গীরনগরে সবুজের প্রতি এত আক্রোশ!

সম্পাদকীয়

প্রকাশ : ০৫ মে ২০২৪ ০৯:৪২ এএম

জাহাঙ্গীরনগরে সবুজের প্রতি এত আক্রোশ!

এই উপমহাদেশের জগৎবিখ্যাত বিজ্ঞানী স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু আবিষ্কার করেছিলেন, মানবজীবনের ন্যায় বৃক্ষেরও প্রাণ আছে। জড় বস্তু একেকটি বৃক্ষ মানুষের জীবনের জন্য অপরিহার্য। আমরা যে অক্সিজেন গ্রহণ করি তা বৃক্ষের দান এবং যে কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃশ্বাসে ত্যাগ করি, তা বৃক্ষই টেনে নিয়ে আমাদের পরিত্রাণ দেয়। কিন্তু এই বৃক্ষের ওপর আক্রোশ কতটা ভয়াবহ পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে এর প্রায় নিত্য সাক্ষ্য মেলে সংবাদমাধ্যমে। শুধু মানুষের জীবনের জন্যই নয়, পরিবেশের সুরক্ষাসহ প্রাকৃতিক বিপর্যয় রোধেও বৃক্ষ অপরিহার্য। স্যার জগদীশ বসু যথার্থই বলে গেছেন, ‘গাছ কাটা আপনার নখ কাটার মতো নয়, তবে শ্বাস কাটানোর মতো।’ ফরাসি বংশোদ্ভূত সমাজসেবী এবং পরবর্তী সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বসবাসকারী আমেরিকান ব্যাংকিং শিল্পের পথপ্রদর্শক হিসেবে খ্যাত স্টেফান জিরাল্ড বলেছিলেন, ‘আমি যদি ভাবি যে আমি কালই মারা যাবো, তবু ভবিষ্যতের জরুরি প্রয়োজনে আমার আজই একটি বৃক্ষ রোপণ করা উচিত।’ জগৎখ্যাত আরও অনেক মনীষীই মানব ও ভূমণ্ডলের অত্যন্ত জরুরি অনুষঙ্গ হিসেবে বৃক্ষকে চিহ্নিত করেছেন। কিন্তু আমরা দেখছি, দেশে বৃক্ষনিধনের উন্মত্ততা চলছে, যা শুধু বৃক্ষগ্রাসী কতিপয় লোভাতুর মানুষের অপরিণামদর্শী কর্মকাণ্ডই নয়, প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়েও তা চলছে নির্বিচারে। ৪ মে ‘সবুজে ঘেরা ক্যাম্পাসের তপ্ত ভূমির পথে যাত্রা’ শিরোনামে প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ প্রকাশিত প্রতিবেদনটি এরই স্মারক। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে নৈসর্গিক অপরূপ রূপে গড়ে ওঠা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নয়নের নামে যেভাবে নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন চলছে তা কর্তৃপক্ষের অপরিণামদর্শিতা বৈ কিছু নয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৮ সালে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) পাস হওয়া উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু হলে বদলে যেতে থাকে জাহাঙ্গীরনগরের দৃশ্যপট। বিগত চার বছরে সবুজের অভয়ারণ্য হিসেবে খ্যাত জাহাঙ্গীরনগরে প্রায় দেড় হাজার বৃক্ষ নিধন করা হয়েছে। এর ফলে নির্মল সবুজারণ্য হয়ে উঠেছে তপ্ত ভূমি। আমরা দেখছি, দেশের চলমান টানা তাপপ্রবাহে জনজীবনে কঠিন অভিঘাত লেগেছে। ইতোমধ্যে তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে অনেকের প্রাণহানিও ঘটেছে। পরিবেশবিজ্ঞানী ও গবেষকদের অভিমত, পরিবর্তিত জলবায়ু পরিস্থিতি যখন ক্রমেই আরও প্রকট হয়ে উঠছে তখনও বৃক্ষ এবং প্রকৃতির সুরক্ষায় দায়িত্বশীলদের সংবিৎ ফিরছে না! এর জ্বলন্ত খণ্ডিত দৃষ্টান্ত মিলেছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের গবেষকদের গবেষণায়ও। ‘বাংলাদেশ জার্নাল অব এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ’-এ প্রকাশিত ওই গবেষণা প্রতিবেদনে জানা যায়, ১৯৮৮ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত প্রায় সাড়ে তিন দশকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বৃক্ষের পরিমাণ ও জলাশয়ের হার কমেছে ২৬ দশমিক ৫ শতাংশ। অন্যদিকে নির্মাণ করা অবকাঠামোর হার বেড়েছে ১৫৯ দশমিক ৩ শতাংশ। আমরা জানি, বিস্তৃত এলাকা নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের আঞ্চলিক ও অবকাঠামোগত অবস্থান সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং বৈচিত্র্যময় হলেও তা আজ বহুমুখী অভিঘাতে পরিবেশ ও প্রকৃতিকে করে তুলছে চরম বিপদাপন্ন।

আমরা উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের বিরোধী নই। কিন্তু যে উন্নয়ন মানবজীবনে অভিঘাত ফেলে এই উন্নয়ন এবং উন্নয়নসংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের দূরদর্শিতা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন না করে অবকাশ থাকে না। আমরা জানি, দেশের মোট আয়তনের অন্তত ২৫ ভাগ বনভূমি থাকতে হয়। কিন্তু দেশে তা আছে মাত্র ১৪ শতাংশের মতো! যেভাবে বনভূমি কমে যাচ্ছে বরং বলা ভালো ধ্বংস করা হচ্ছে, তাতে শঙ্কিত না হয়ে উপায় থাকে না। দেশের কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাকৃতিকভাবেই বনভূমি ও বৃক্ষের সম্ভার থাকলেও তা কোনোভাবেই ধরে রাখা যাচ্ছে না। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠগুলোর কর্তৃপক্ষের অপরিণামদর্শী কর্মকাণ্ডে যদি এভাবে বৃক্ষ সংহার হয় তাহলে অন্য সামাজিক ও সংরক্ষিত বনাঞ্চলের পরিস্থিতি কী হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। জাহাঙ্গীরনগরে তো বটেই, দেশের প্রায় সর্বত্রই যে হারে বৃক্ষ সংহার হচ্ছে সেই তুলনায় বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি দৃশ্যত আড়ম্বরপূর্ণ হলেও কার্যত ফল শূন্য। কারণ এর রক্ষণাবেক্ষণসহ আনুষঙ্গিক কোনো কিছুতেই সংশ্লিষ্ট কারোরই কোনো দায়বদ্ধতা নেই। জাহাঙ্গীরনগরে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি শুধু খাতাকলমের হিসাবেই সীমাবদ্ধ তা-ও জানা গেছে ওই প্রতিবেদনেই। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের যে পরিমাণ উন্মুক্ত জায়গা রয়েছে পরিকল্পিত উপায়ে অবকাঠামো অর্থাৎ উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন বৃক্ষ নিধন না করেও তা করা যেত। আমরা জানি, জাহাঙ্গীরনগরে ২০১৯ সালে বৃক্ষ ব্যবস্থাপনা নামে একটি কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু ওই প্রতিবেদনেই বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বৃক্ষ ব্যবস্থাপনা এবং পরিকল্পিত বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি গ্রহণ করেনি এবং কমিটির কাছে কোনো পরামর্শও চায়নি! উন্নয়ন প্রকল্পের নামে যখন অপরিকল্পিত ভবন নির্মাণের জন্য বৃক্ষ নিধন করতে হয়, তখন কখনও কখনও তাদের ডাকা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বৃক্ষ নিধন ও রোপণের ব্যাপারে প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর প্রতিবেদকের কাছে যে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন, তা নিতান্তই দায়সারা গোছের এবং তা কোনোভাবেই প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নয়।

জাহাঙ্গীরনগরে বৃক্ষনিধনের প্রতিবাদে পথনাটকের মতো সাংস্কৃতিক প্রতিবাদও হয়েছে। তা ছাড়া প্রতিবাদী শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর যূথবদ্ধতায় পালিত হয়েছে আরও বিভিন্ন কর্মসূচি। তারপরও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের টনক নড়েনি এবং তাদের অপরিণামদর্শিতায় প্রাণ-প্রকৃতি তথা জীববৈচিত্র্যের যে ক্ষতি হচ্ছে, এ নিয়েও তাদের নেই কোনো জবাবদিহি! আমরা মনে করি, বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জ্ঞানচর্চার উর্বর ক্ষেত্রে অনুর্বর মস্তিষ্কজাত এমন আত্মঘাতী কর্মকাণ্ড কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। নিকট অতীতে উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক প্রকৌশলী মো. নাসির উদ্দীন সহযোগী একটি দৈনিকের প্রতিবেদকের কাছে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় তো কোনো বনভূমি নয়। ভবন নির্মাণের জন্য কিছু জায়গার বৃক্ষ কাটতেই হচ্ছে।’ আমরা একটি প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ একজন দায়িত্বশীলের এমন মন্তব্যে শুধু বিস্মিত নয়, তার পরিবেশ-প্রতিবেশ জ্ঞান নিয়েও প্রশ্ন তুলতে চাই। আমাদের স্পষ্ট দাবি, জাহাঙ্গীরনগরে সবুজের প্রতি আক্রোশ বন্ধ করতেই হবে। মানুষ ও প্রকৃতির সুরক্ষায় কোনো ছাড় দেওয়া যাবে না। যাদের দায়িত্বজ্ঞান নেই, তারা দায়িত্বশীল পদে কীভাবে বসেন আমরা এ প্রশ্নও রাখতে চাই।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে আমরা অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, লেখক ও গবেষক রিচার্ড টমাস মাবের একটি উক্তি স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। তিনি বলেছিলেন, ‘বৃক্ষ না থাকা মানে আমাদের শেকড় ছাড়া থাকার মতো।’ আমরা আশা করি বিলম্বে হলেও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বৃক্ষ রক্ষা ও রোপণের ব্যাপারে সংবিৎ ফিরবে। 

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা