নিরাপত্তা
ড. নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ
প্রকাশ : ০৫ মে ২০২৪ ০৯:৩৯ এএম
ড. নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ
একটা সময় ছিল যখন পাহাড়কে নিরাপদ আবাস বলে বিবেচনা করা হতো। কারণ পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থানকালে আশপাশের এলাকার ওপর সহজে নজর রাখা যায় এবং শত্রুর চলাচল বা আগমন অনেক আগে থেকেই লক্ষ করে পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়া যায়। পরে ইসলামের ইতিহাসে খন্দকের যুদ্ধ, হিন্দু পুরাণে কৈলাস পর্বতমালার যুদ্ধ, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মধ্য ও দক্ষিণ ইউরোপের আটটি দেশে বিস্তৃত আল্পস পর্বতমালার যুদ্ধ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বার্মা ক্যাম্পেইন প্রভৃতি প্রমাণ করে পাহাড় দখল করেই যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া যায়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে যুদ্ধের নতুন সংস্করণে বিভিন্ন রাষ্ট্রকে নিজ দেশেই বিদেশি বা শত্রু সমর্থনপুষ্ট তৃতীয় শক্তি, পঞ্চম বাহিনী বা বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে দেখা যায়। এসব বাহিনীর একটি বড় অংশই পাহাড়ে আশ্রয় নিয়ে সমগ্র দেশেই অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। ফলে সরকার দেশের সম্পদের একটা বড় অংশ সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা রক্ষায় তথা অশান্ত পাহাড়ি এলাকায় শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মূলত সামরিক খাতে ব্যয় করতে বাধ্য হয়। মেক্সিকোর চিয়াপাস পর্বতমালায় জাপটিস্টা বিদ্রোহী, কলম্বিয়ার আন্দেস পর্বতমালায় এফএআরসি বিদ্রোহী, রাশিয়ার ককেশাস পর্বতমালায় চেচনিয়া, আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার বিদ্রোহী, কঙ্গোর পশ্চিম আলবারটাইন পর্বতমালায় কঙ্গো, রুয়ান্ডা, বুরুন্ডী ও উগান্ডার বিদ্রোহী, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের হিন্দুকুশ পর্বতমালায় তালেবান বিদ্রোহী, ভারতের কাশ্মির ও চীন সীমান্তে স্থানীয় বিদ্রোহী এবং ফিলিপাইনের নিন্দাও দ্বীপের পর্বতমালায় আবু সায়াফ বিদ্রোহী দল নিজ অধিকৃত পাহাড়ি এলাকায় বহু ভয়াবহ সংঘাত ও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের জন্ম দিয়েছে।
বর্তমান বিশ্বে সিরিয়ার ইসলামি স্টেট (আইএস), আফ্রিকার বকু হারাম, সুদানের বিদ্রোহী দল কিংবা ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনি যোদ্ধারা পাহাড়ে আধিপত্য বজায় রেখেই যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের পূর্ব অংশে ‘সেভেন সিস্টার্স’খ্যাত সাতটি রাজ্য রয়েছে, যেখানে পাহাড়ি এলাকার আধিক্য লক্ষণীয়। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের তিন পার্বত্য জেলার মানুষ একসময় তথাকথিত শান্তি বাহিনীর অত্যাচারে চরম অশান্তিতে ছিল। এলাকার উন্নয়ন এমনকি সরকারি সেবা বা প্রশাসন এ সময় স্থবির হয়ে পড়েছিল। বহু রক্ত ঝরার পর ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে শান্ত হতে থাকে তিন পার্বত্য জেলা। তবে পৃথিবীর ইতিহাসে কোনো শান্তি প্রক্রিয়াই যুদ্ধরত ও বহুধারায় বিভক্ত সব দল বা উপদলকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। এই শান্তিচুক্তিও তার ব্যতিক্রম ছিল না। তবে সবচেয়ে দক্ষিণের পার্বত্য জেলা বান্দরবানের সঙ্গে ভারত ও মিয়ানমারের ভৌগোলিক সংযোগ থাকায় তিন দেশেরই জঙ্গি, বিদ্রোহী বা বিচ্ছিন্নতাবাদীদের জন্য এলাকাটি সামরিক কৌশলগত কারণে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। উচ্চ পাহাড় পরিবেষ্টিত হওয়ায় এলাকাটি অতি সহজে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কার্যক্রম পরিচালনার স্বর্গরাজ্য হয়ে ওঠে। অতি সম্প্রতি বাংলাদেশ সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের সরকারি বাহিনী ও সরকারি সীমান্তরক্ষী বা বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি) আরাকান আর্মি নামক বিদ্রোহীদের হাতে শোচনীয় পরাজয় বরণ করায় বাংলাদেশে থাকা বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী দল নতুন করে সংগঠিত হয় ও রঙিন স্বপ্নে বিভোর হয়ে ওঠে। তাদের শক্তিমত্তা ও ধৃষ্টতার প্রমাণ পাওয়া যায় সম্প্রতি বান্দরবান জেলার রুমা উপজেলায় দিনেদুপুরে ব্যাংক ডাকাতি, অস্ত্র ছিনতাই ও থানচি উপজেলা থেকে ব্যাংক কর্মকর্তা অপহরণের ঘটনার মধ্য দিয়ে।
অন্যদিকে অতীত ইতিহাসের আলোকে যেকোনো উদ্বাস্তু শিবির কে অপরাধী, উগ্রবাদী, জঙ্গি বা বিচ্ছিন্নতাবাদী উৎপাদনের আঁতুড়ঘর বলা যায়। নেদারল্যান্ডসের হেগভিত্তিক স্বাধীন গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর কাউন্টার টেররিজম ২০১৬ সালে ‘লিংকস বিটুইন টেররিজম অ্যান্ড মাইগ্রেশন’ শিরোনামে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করে। এই গবেষণাপত্রে সুস্পষ্টভাবে দেখা যায়, পৃথিবীর ৮৬ শতাংশ উদ্বাস্তু উন্নয়নশীল দেশে অবস্থান করছে। এসব উদ্বাস্তু উগ্রপন্থি ও বিচ্ছিন্নতাবাদীরা নানাভাবে কাজে লাগায়। এসব শিবির থেকেই তারা নতুন সদস্য সংগ্রহ করে আবার নিজ স্বার্থে শিবিরে হামলা চালায়। কখনও কখনও তারা উদ্বাস্তু শিবিরেই ঘাঁটি গড়ে এবং এসব শিবির থেকে নানাভাবে প্রতিপক্ষের ওপর হামলা চালায়। উন্নয়নশীল দেশের উদ্বাস্তু শিবির এবং উন্নত দেশের রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থীদের শিবিরে (এসাইলাম ক্যাম্প) আক্রমণ চালিয়ে উগ্রবাদী বা আক্রমণকারীরা বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সাধারণত শিবিরে আশ্রয় নেওয়া উদ্বাস্তুরা নিজ ভিটামাটির ও মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয় বিধায় তাদের কিছুই হারানোর থাকে না, থাকে শুধু যেকোনো মূল্যে কোনো কিছু পাওয়ার প্রলোভন। তাই উগ্রবাদীরা নগদপ্রাপ্তি বা ভবিষ্যৎপ্রাপ্তির লোভ দেখিয়ে সহজেই উদ্বাস্তুদের দলে ভেড়াতে পারে। উল্লিখিত গবেষণাপত্র উদ্বাস্তু শিবির থেকে আত্মঘাতী যোদ্ধা তৈরির কথাও উদাহরণ সহকারে উল্লেখ করেছে।
সাম্প্রতিককালে দৈনিক প্রতিদিনের বাংলাদেশসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে পার্বত্য জেলা বান্দরবানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীরসহ বিভিন্ন সরকারি বাহিনী পরিচালিত সাঁড়াশি অভিযানের একপর্যায়ে কুকি চীন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) দুজন সদস্যের মৃতদেহ পড়ে থাকার প্রতিবেদনে জানা যায়, রুমা থানাধীন দুর্গম বাকলাই এলাকা থেকে শনিবার, ২৭ এপ্রিল, সকালে প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দ ভেসে আসে। পরে সেখানে তিনটি অস্ত্র, প্রচুর গোলাবারুদ, ওয়াকিটকি ও অন্যান্য যুদ্ধ সরঞ্জাম পাওয়া যায়। এর আগে রুমা থানা সদরে ব্যাংক লুটের ঘটনায় নারী ও ছাত্রলীগ নেতাসহ বহু পাহাড়ি জনগণকে আটক করা ও জিজ্ঞাসাবাদ প্রক্রিয়া শুরুর খবর প্রকাশিত হয়েছে। এসব পাহাড়ি মানুষ মূলত বম সম্প্রদায়ের, যারা পাহাড়ি বাঙালি, চাকমা ও ত্রিপুরাদের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠদের মাঝে নিজেদের বঞ্চিত মনে করে। এই কেএনএফ যোদ্ধারা যেসব অস্ত্র, যোগাযোগ সরঞ্জাম ও রণকৌশল ব্যবহার করেছে বা করছে, তদুপরি যে সাহসিকতা প্রদর্শনের উদাহরণ সৃষ্টি করেছে, তার আলোকে তাদের পেছনে দেশি-বিদেশি কুচক্রী মহলের যোগসাজশ থাকার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বিশেষত মিয়ানমারে আরাকান আর্মির অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র ও যুদ্ধ সরঞ্জাম ব্যবহার ও সরকারি বাহিনীকে হটিয়ে নিজেদের প্রশাসন প্রতিষ্ঠার সাফল্য কেএনএফ সদস্যদের সামরিক শক্তি প্রয়োগ ও প্রদর্শন করে দাবি আদায় উদ্বুদ্ধ করছে বলে প্রতীয়মান হয়। আরাকান আর্মির আধুনিকায়নের পেছনে বিদেশি শক্তি আছে বিধায় কেএনএফ সদস্যদের নেপথ্য শক্তি খুঁজে বের করা জরুরি। মনে রাখতে হবে, আগে কেবল সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে পাহাড়ের শান্তি আসেনি এবং ভবিষ্যতেও আসবে না। সামরিক চাপের পাশাপাশি কূটনৈতিক যোগাযোগ বৃদ্ধি করতে হবে, রাজনৈতিক সদিচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে হবে। বম জনগোষ্ঠীসহ পাহাড়ে থাকা প্রতিটি নৃগোষ্ঠীর কাছে দেশের সার্বিক অগ্রগতির সুফল পৌঁছে দিতে হবে এবং তাদের ন্যায্য দাওয়াকে সম্মানের সঙ্গে মেনে নিতে হবে। এক্ষেত্রে যত বিলম্ব ঘটবে, পরিস্থিতি ততই ঘোলাটে হবে।
নানা মহল থেকে ধারণা করা হচ্ছে, মিয়ানমারে যুদ্ধ পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। এতে অতীতের মতো আবারও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের চেষ্টা তীব্র থেকে তীব্রতর হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। মিয়ানমারের সরকারি সীমান্তরক্ষী বাহিনী বা বর্ডার গার্ড পুলিশের সদস্যরা আত্মসমর্পণ করে বাংলাদেশ আরও বড় আকারে আশ্রয় নিতে পারে। এসব বিষয় আমলে নিয়ে আগে থেকেই সম্মিলিত নিরাপত্তা ও আপদ মোকাবিলার পন্থা (ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট স্ট্র্যাটেজি) প্রণয়ন করতে হবে। মনে রাখা দরকার, রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের বিশেষত তাদের তরুণ সমাজকে প্রতিনিয়ত আরাকান আর্মি এবং সরকারি বাহিনী নিজস্ব শক্তি বৃদ্ধির কথা বিবেচনায় রেখে নিজ নিজ বাহিনীতে যোগদানের জন্য প্রলুব্ধ করে চলেছে। কোনো কোনো রোহিঙ্গা আবার নিজেরাই একটি বাহিনী তৈরি করার কথা ভাবছে এবং তাদের ইন্ধন দেওয়ার মতো দেশি-বিদেশি কুচক্রী মহলের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়াও অবাস্তব নয়। রোহিঙ্গা তরুণরা বছরের পর বছর উদ্বাস্তু শিবিরে থেকে চরম হতাশা, অধৈর্য ও যেকোনো মূল্যে দেশে ফেরত যাওয়ার জন্য বেপরোয়া হয়ে উঠেছে এবং এর বহিঃপ্রকাশ প্রায়ই ক্যাম্পে গোলাগুলি ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনার মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে। তাই ক্যাম্পের নিরাপত্তা এবং সীমান্তের উভয় পাড়ে গোয়েন্দা কার্যক্রম বৃদ্ধি ও তথ্য সংগ্রহের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া অত্যাবশ্যক।
অপরদিকে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত ও সংবাদের দেখা যায় মাদক ব্যবসায়ীরাও পাহাড় ও রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিজেদের প্রভাব বিস্তার এবং অবাধ মাদক ব্যবসা নিশ্চিত করতে একটি পথভ্রষ্ট দল তৈরি করে ও তাদের হাতে অস্ত্র তুলে দেয়। তাই দেশব্যাপী মাদকের বিরুদ্ধে প্রকৃত অর্থে শূন্য সহিষ্ণুতা প্রদর্শন করতে হবে। সেই সঙ্গে আইন ও বিচার কাঠামোর আমূল সংস্কার করে দ্রুততম সময়ে মাদক-সংক্রান্ত মামলার নিষ্পত্তি ও অপরাধীদের অনুকরণীয় বা সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করলে পাহাড় ও রোহিঙ্গা ক্যাম্পেরও অবস্থার উন্নতি ঘটবে। মিয়ানমারে অভ্যন্তরীণ সংকটের নানামুখী বিরূপ প্রভাব পড়েছে আমাদের এখানেও।
পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও বেসামরিক প্রশাসন বহু ত্যাগ স্বীকার করেছে। পাহাড়ি ও বাঙালিদের রক্তে বছরের পর বছর লাল হয়েছে পাহাড়ের ধূসর জমি ও সবুজ প্রান্তর। অনেকের জীবন ও অঙ্গহানি ঘটেছে। পাহাড়ে চাকরি ও অবস্থানের কারণে সেনাসদস্যদের পরিবারের অন্য সদস্যরাও নানা রকম প্রতিকূলতা মোকাবিলা করেছে। তারা বারবার ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে। মানসম্মত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না থাকার কারণে অনেকের সন্তানের যথাযথ শিক্ষাও বিঘ্নিত হয়েছে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রতিষ্ঠা করা পাহাড়ের শান্তি যেন বিনষ্ট না হয়, সেটাই শান্তিপ্রিয় দেশবাসীর একান্ত প্রত্যাশা। আরও প্রত্যাশা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রোহিঙ্গা, ফিলিস্তিনি বা আফ্রিকান উদ্বাস্তুদের প্রকৃত কল্যাণে এগিয়ে আসুক। তাদের ঘিরে ব্যবসা বা চাকরির ক্ষেত্র প্রস্তুত নয়, প্রকৃত শান্তিই সবার কাম্য।