× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

নগরায়ণ

দূরদর্শিতায় ঘাটতির প্রভাব দৃশ্যমান

ড. আদিল মুহাম্মদ খান

প্রকাশ : ০৪ মে ২০২৪ ১৩:৩৭ পিএম

ড. আদিল মুহাম্মদ খান

ড. আদিল মুহাম্মদ খান

২৫ এপ্রিল প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছেÑঢাকার গাছ ও জলাশয়হীন এলাকার তাপমাত্রা বাড়ছে দ্রুত। বিগত বছরগুলো থেকে রাজধানীর তাপমাত্রা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে মহানগরীর বাসযোগ্যতার ক্রমাবনতি। প্রতিবেদনে এও বলা হয়েছে, সাত বছরে ঢাকার গড় তাপমাত্রা অন্তত ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি বেড়েছে। গাছ ও জলাশয়হীন এলাকা যেমন গুলিস্তান, জুরাইন, ফার্মগেটে তাপমাত্রা বেশি অনুভূত হচ্ছে। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে প্রতিনিয়ত তাপমাত্রা বেড়ে চলেছে। সারা বিশ্বেই এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে এবং এ নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা যেমন আছে, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সমস্যা সমাধানের পথ নিয়েও ভাবা হচ্ছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, এ বাস্তবতা আমাদের জানা। তবে একই সঙ্গে আমাদের পারিপার্শ্বিক পরিবেশের বিভিন্ন ভৌত বৈশিষ্ট্যের কারণে এ তাপমাত্রার প্রভাব আমরা কতটুকু অনুভব করছি, সে বিষয়টিও অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। নগর এলাকায় বিশেষ করে ঢাকা শহরের মতো মেগাসিটিতে তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে মানুষের অস্বস্তি বাড়ার সম্পর্ক রয়েছে এবং বিদ্যমান তাপপ্রবাহ আমাদের স্বাস্থ্যঝুঁকিও অনেক বাড়িয়ে দিচ্ছে। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ার বিষয়টি শুধু আমাদের সমস্যা নয়। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টিকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে পরিবেশ ও প্রতিবেশ ধ্বংস করে দিয়ে তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে আমাদের দায় এড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। প্রকৃতপক্ষে নির্বিচারে সবুজ এলাকা ধ্বংস করে দিয়ে, গাছপালা নিধন করে, জলাশয়-জলাভূমি ভরাট করে যে নগরায়ণ আমরা করেছি তার বিরূপ ফলই এখন আমরা ভোগ করছি।

আজ থেকে প্রায় ৩০ বছর আগেও ঢাকায় পর্যাপ্ত সবুজ এলাকা ছিল। খাল, জলাশয়, জলাধারের সঙ্গে শহরের আশপাশের নদ-নদীসমূহের কার্যকর আন্তঃসংযোগ ছিল যা নগরীর পরিবেশ ও জলবায়ুর ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। আমাদের ঢাকা ও চট্টগ্রাম নগরী অতীতে এশিয়ার অন্যতম স্বাস্থ্যকর শহর হিসেবেই পরিচিত ছিল। কিন্তু বিগত দুই দশকে অবকাঠামোগত উন্নয়নের ক্ষেত্রে পরিবেশসংবেদনশীল পরিকল্পনা নেওয়া হয়নি। বেশুমার অবকাঠামো ও যত্রতত্র ভবন নির্মাণের ফলে পরিবেশ-প্রতিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে মারাত্মকভাবে। ফলে ঢাকা ও চট্টগ্রামের মতো মহানগরী আর স্বাস্থ্যকর নেই। স্বার্থান্বেষী বিভিন্ন মহল জলাশয় ভরাটের পাশাপাশি সবুজ এলাকা বিনষ্ট করে নিজেদের অর্থনৈতিক স্বার্থ হাসিল করছে। শুধু তাই নয়, নগরী পরিবেশসংবেদনশীল করে তোলার ক্ষেত্রে সরকার, স্থানীয় প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় কার্যকর ও দৃশ্যমান উদ্যোগ নেয়নি। নাতিশীতোষ্ণ এ দেশে গ্রীষ্মকালসহ ষড়ঋতুকে মাথায় রেখেই নগর পরিকল্পনা ও ভবনের নকশার সমন্বয়সাধন জরুরি ছিল।

জনসংখ্যাবহুল আমাদের দেশের যেকোনো শহরে অন্তত ২৫ শতাংশ সবুজ এলাকা জরুরি। পাশাপাশি ১০-১৫ ভাগ জলাশয় থাকা দরকার। নগর এলাকায় কনক্রিট বা ধূসর এলাকা ৪০-৫০ ভাগ হওয়া সত্বেও কয়েক দশক আগেও ঢাকা শহরে সবুজ-জল-কনক্রিটের এ ভারসাম্য বজায় ছিল। প্রাকৃতিকভাবে আমরা যে উপাদানগুলো পেয়েছিলাম, সেগুলো সুপরিকল্পনার মাধ্যমে রক্ষা করে যদি নগরায়ণ করতে পারতাম, তা হলেই আমাদের নগর উন্নয়ন টেকসই ও স্বাস্থ্যকর হতো। নগরায়ণের মৌলিক ভারসাম্য এভাবেই রক্ষা করা সম্ভব ছিল।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি)-এর সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকা মহানগরীর ৮০ শতাংশ জায়গা দখল করে রেখেছে কনক্রিট। ঢাকার এমন অনেক এলাকা আছে যেখানকার ৯০ ভাগ অংশই কনক্রিটে ঢেকে আছে। আমাদের রাজধানীর সবুজ এলাকা এখন সাত ভাগের নিচে চলে এসেছে। এমনকি ঢাকা মহানগরীতে অনেক জলাশয়, খাল ছিল সেগুলোও নামতে নামতে পাঁচ ভাগের নিচে চলে গেছে। আমাদের জলাশয় ও সবুজ এলাকা রক্ষা করতে পারলেই নগরায়ণের ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব ছিল। অথচ আমরা দেখছি, প্রতিনিয়ত সবুজ এলাকা ও জলাশয় হারিয়ে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে পরিকল্পনা ও উন্নয়ন সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থার ব্যর্থতা এড়ানোর অবকাশ নেই। দখল-দূষণ নিয়ন্ত্রণেও সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল প্রতিটি সংস্থার ব্যর্থতা দৃশ্যমান। অপরিকল্পিত ও অনিয়ন্ত্রিত নগরায়ণ, যত্রতত্র শিল্পায়ণ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় গাফিলতির ফলে নগর-মহানগরে বায়ুদূষণ বেড়েই চলেছে।

সাম্প্রতিক গবেষণা বলছেময়লার ভাগাড়, ইটভাটা, যানবাহন ও শিল্পকারখানার ধোঁয়া থেকে ঢাকার বাতাসে পাঁচ ধরনের ক্ষতিকর গ্যাসের স্তর তৈরি হয়েছে। এতে ঢাকার মাটি ও বাতাস আরও উত্তপ্ত হচ্ছে। পাশাপাশি ক্রমবর্ধমান আবদ্ধ কাচের ভবন এবং বিদ্যুৎ ও এসির বাড়তি ব্যবহার শহর উত্তপ্ত করছে ক্রমাগত। ফলে ঢাকা এরই মধ্যে তপ্ত দ্বীপে পরিণত হয়েছে।অতীতে যেকোনো ভবন নির্মাণের সময় ভবনের নকশা ও কাঠামো নিয়ে টেকসই ও পরিবেশ উপযোগী ভাবনা দেখা যেত। ভবনের ভেতর কীভাবে প্রাকৃতিক আলোবাতাসের প্রবাহ নিশ্চিত করা যায়, ভবন কীভাবে শীতল রাখা যায় এসব বিষয় অনেক বেশি প্রাধান্য পেত। আবার ভবনের আশপাশে সবুজায়নের বিষয়টিতেও দেওয়া হতো বাড়তি গুরুত্ব। দুঃখজনক হলেও সত্য, বর্তমানে আমরা যেন এসব বিষয়কে আর গুরুত্ব দিচ্ছি না। অনেক ক্ষেত্রে পাশ্চাত্যের অনুকরণে আবদ্ধ ঘর নির্মাণের দিকে দেওয়া হচ্ছে বাড়তি মনোযোগ। আবদ্ধ কিংবা কাচনির্মিত অবকাঠামো কখনই তাপ নিরোধক হয় না। বরং এ ধরনের ভবনে তাপ আটকে থাকে।

মহানগর-নগরের অবকাঠামো যেন এখন তাপের আধার হয়ে উঠেছে। এ তাপ এসির মাধ্যমে বাইরে বের করে দেওয়া হচ্ছে। গরমে প্রতিটি বাড়িতেই এসি একটি গুরুত্বপূর্ণ আধুনিক যন্ত্র হিসেবে গৃহীত হয়েছে। এ এসির মাধ্যমে বদ্ধ ঘর থেকে তাপ বের করে দেওয়া হচ্ছে। ফলে নগরে তাপ আরও বাড়ছে। উল্লেখ্য, ভবনের ডিজাইন ও নকশার কারণে বাধ্য হয়েই প্রতিটি ভবনে এসি ব্যবহার করছে মানুষ। অথচ ভবনের ভেতর পর্যাপ্ত আলোবাতাস পেলে তাপ ভবন থেকে বেরিয়ে যেত এবং এসির এত ব্যবহার প্রয়োজন ছিল না। ভবনের নকশা চটকদার করায় মুনশিয়ানা দেখানোর দিকেই যেন অনেকের ঝোঁক বেশি। ভবনকে প্রাকৃতিকভাবেই আরামদায়ক করার বিষয়ে অত ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। ভবনে এসির ব্যবহারের কারণে বাতাসে ক্লোরো ফ্লোরো কার্বন বা সিএফসি গ্যাস নির্গত হচ্ছে, যা জলবায়ু পরিবর্তন ও তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রাখছে। এসির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে সরকারের পক্ষ থেকে তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। বহুতল ভবনসমূহে মাত্রাতিরিক্ত এসি ব্যবহারের ফলে নগরে বাড়তি তাপ যোগ হচ্ছে, যা প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষের জীবনধারণকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। সঙ্গত কারণেই নগরে মাত্রাতিরিক্ত তাপের বিষয়টি নিয়ন্ত্রণে আমাদের কার্যকর, টেকসই ও সাশ্রয়ী সমাধানের কথা ভাবতে হবে।

আমরা দেখছি, গরমে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়েছে কিন্তু তার পর্যাপ্ত জোগান কিংবা সরবরাহ সব এলাকায় সমানভাবে নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রে মহানগরের উচ্চবিত্ত এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহে তেমন বিঘ্ন না ঘটলেও প্রান্তিক এলাকায় বড় ধরনের ঘাটতি রয়েছে। একই সঙ্গে শহর এলাকায় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহকে প্রাধান্য দেওয়ার কারণে গ্রামীণ অনেক এলাকায় ব্যাপক হারে লোডশেডিং হচ্ছে। ফলে বিদ্যুৎ সরবরাহের ক্ষেত্রে শহরের ভেতরে এক ধরনের এলাকাভিত্তিক বৈষম্য দেখা যাচ্ছে। অন্যদিকে শহর ও গ্রামীণ এলাকার মধ্যে বিদ্যুৎ সরবরাহে আরেক ধরনের বৈষম্য দেখা যাচ্ছে। বিদ্যুৎ সরবরাহে বিদ্যমান বৈষম্যের এ চিত্র আমাদের অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমতাভিত্তিক উন্নয়নভাবনার বিপরীত।

নগর এলাকায় তাপপ্রবাহের এ প্রকোপ থেকে রক্ষা পেতে ঢাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার (ড্যাপ) প্রতিবেদনে বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ইমারত নির্মাণ বিধিমালায় অবশ্যই যেকোনো ধরনের স্থাপনা নির্মাণের ক্ষেত্রে বৃক্ষরোপণের শর্ত দিতে হবে। ইমারত নির্মাণের যেসব উপাদান তাপ বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে, সেগুলোর ব্যবহার কমাতে হবে। বেসরকারি আবাসিক প্রকল্পের ভূমি উন্নয়ন বিধিমালায় গাছপালা রোপণের শর্ত দিতে হবে। গ্রিন ও ব্লু নেটওয়ার্ক রাখার বিধান সংযুক্ত করতে হবে। যেকোনো ধরনের রাস্তা নির্মাণের ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক করতে হবে গাছপালা রোপণ। নগর জীবনরেখায় বিদ্যমান নির্দেশনা অনুসরণ করে বৃক্ষ রোপণ করতে হবে। যেসব এলাকায় (প্রকল্পের মাধ্যমে গড়ে ওঠা আবাসিক এলাকা) আরবান হিট আইল্যান্ড বা নগর তপ্ত দ্বীপের প্রভাব অত্যধিক, সেসব এলাকায় সবুজায়ন প্রকল্পের মাধ্যমে পর্যাপ্তসংখ্যক গাছ লাগাতে হবে। বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় প্রস্তাবিত জলাশয় (পুকুর, লেক, খাল ও নদী) সংরক্ষণ করতে হবে। প্রস্তাবিত পার্ক ও খেলার মাঠের বাস্তবায়ন করতে হবে।

ঢাকা মহানগরীর অধিক জনঘনত্ব নিয়ন্ত্রণে রাখতে পরিকল্পনায় সুপারিশকৃত এলাকাভিত্তিক ডেনসিটি জোনিংয়ের নীতি যথাযথ অনুসরণ করতে হবে। ড্যাপের প্রস্তাবসমূহের কার্যকর বাস্তবায়নের জন্য নগর সংস্থাসমূহের যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া একান্ত জরুরি। পাশাপাশি নগর এলাকাসমূহে সবুজ ও জলাশয় রক্ষার পাশাপাশি পরিকল্পিত বৃক্ষায়ণের মাধ্যমে নগরে তাপের প্রভাব কমানোর কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। নতুবা আগামী দিনগুলোয় আমাদের জন্য আরও ভয়াবহ দুর্যোগ অপেক্ষা করছে।

  • সভাপতি, বিআইপি; পরিচালক, আইপিডি  অধ্যাপক, নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা