সন্দ্বীপ ঘিরে পরিকল্পনা
এস এম রানা
প্রকাশ : ০৪ মে ২০২৪ ১৩:৩৩ পিএম
এস এম রানা
বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন জনপদ সন্দ্বীপ। ইতিহাসসমৃদ্ধ গৌরবোজ্জ্বল সন্দ্বীপ হালসময়ে হতশ্রী। প্রকট যোগাযোগ সংকটে বছরজুড়ে দুর্ভোগে থাকতে হয় বাসিন্দাদের। জলপথে জটিল যোগাযোগব্যবস্থা দুর্ভোগ বাড়িয়েছে দুর্বল চিকিৎসাব্যবস্থায়। পিছিয়ে গেছে কৃষি ও শিক্ষা খাত। দ্বীপের চরে পতিত জমি আছে। কিন্তু লবণাক্ততার কারণে চাষাবাদযোগ্য জমি কম। নদী-খাল-ডোবায় যে পরিমাণ মাছ পাওয়া যায় তা দিয়ে স্থানীয় চাহিদা মেটে না। অথচ জনপদটিই সাগর-নদী ঘেরা। সাগর-নদীতে মাছের অভাব নেই আর তীরে যেন মাছের দেখা নেই অবস্থা। সার্বিকভাবে জটিল জীবনজীবিকার দ্বীপটিই হয়ে উঠতে পারে বাংলাদেশের অর্থনীতির গেমচেঞ্জার। বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং বিসিক শিল্পনগরী স্থাপনের প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে দ্বীপের চর ঘিরে। আবার দ্বীপের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশের ভাসানচর সন্দ্বীপের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হতে যাচ্ছে। সেখানে নৌবাহিনী কার্যক্রম চালাচ্ছে। উত্তর-পশ্চিমাংশে জমি বরাদ্দ পেয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। নিরাপত্তার দিক থেকে অদূর ভবিষ্যতে সন্দ্বীপ হয়ে উঠবে নিশ্ছিদ্র।
দুই
বাহিনীর কার্যক্রম, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের শিল্পকারখানায় পণ্য উৎপাদনের জন্য কাঁচামাল
পরিবহন, কিংবা উৎপাদিত পণ্য রপ্তানির জন্য পরিবহন, দ্বীপবাসীর সহজ যাতায়াত নিশ্চিতসহ
সার্বিক যোগাযোগের জন্য বিদ্যমান ঘাটব্যবস্থা যে অকার্যকর তা সরকারের অজানা নয়। এখন
যাতায়াত সুবিধার জন্য ফেরিঘাট স্থাপনের বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে। ফেরি চড়ে গাড়ি যাবে সন্দ্বীপ।
পণ্য পরিবহন হবে ফেরিপথে। কিন্তু এ ফেরিব্যবস্থাও কি খুব সহজ মাধ্যম? সহজ নয় বলেই পদ্মা
সেতু নির্মিত হয়েছে। দেশের ১৮ জেলা ঢাকার সঙ্গে যুক্ত করতে পদ্মা জয় করেছে সরকার। পদ্মায়
এখন বুক উঁচু করে দাঁড়িয়েছে বাঙালির গর্বের স্থাপনা। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ মূল
সেতুটি বাংলাদেশকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। বলা হচ্ছে, দেশের ডিজিপিতে প্রবৃদ্ধি বেড়েছে
১ দশমিক ২ শতাংশ। প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার মেগা প্রকল্প বাংলাদেশকেই পরিবর্তন করে
দিয়েছে।
সে
রকম আরেকটি সেতুই পারে সন্দ্বীপকে নতুন রূপে গড়তে। দ্বীপের চারপাশে অথই পানি। দ্বীপটি
সুনিপুণভাবে গড়ে তুলতে হলে যোগাযোগব্যবস্থায় ফেরি নয়, দরকার একটি সেতু। স্বপ্নের সেতু
দ্রুত যোগাযোগব্যবস্থা নিশ্চিত করবে। কিন্তু সেতুর স্বপ্ন সন্দ্বীপবাসী দেখবে কীভাবে?
যাদের ভূখণ্ডের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হয় প্রাণ মুঠোয় নিয়ে, নৌযান উল্টে সলিলসমাধি যাদের
হাতছানি দেয়, স্বজন হারানোর বেদনাহত হৃদয় নিয়ে যারা জীবন পার করে তাদের তো সেতুর স্বপ্ন
দেখা শত আলোকবর্ষ দূরের স্বপ্ন। কিন্তু দ্বীপের বাইরে থেকে যারা দ্বীপে বাণিজ্যিক প্রাণের
ভ্রূণের জন্ম দেখছেন, যারা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির নিকাশ বোঝেন তারাই উৎপাদন, বিপণন কিংবা
রপ্তানি আয়ের নিকাশ করে জিডিপির ইনডেক্স নিয়ে বসতে পারেন। তারপর ‘আগামীর সন্দ্বীপ’-এর
যাতায়াতব্যবস্থা কেমন হওয়া উচিত সে পথ বাতলে দিতে পারেন।
এ
স্বপ্নসেতু হতে পারে মিরসরাই বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরী থেকে সন্দ্বীপের সন্তোষপুর ইউনিয়নের
ডোমখালী পর্যন্ত। বঙ্গোপসাগরের এ অংশে সন্দ্বীপ চ্যানেলের দৈর্ঘ্য ৬ থেকে ৭ কিলোমিটার।
এ জলপথ পাড়ি দিতে স্পিডবোটে লাগে ১৫ মিনিটের মতো। সাগরের এ অংশের গভীরতা ৫-৭ ফুটের
মতোই। তবে পলি জমে তলদেশ ভরাট হচ্ছে। অদূর ভবিষ্যতে মিরসরাই-সন্দ্বীপ একাকার হয়ে যেতে
পারে এমন বাস্তবতাও দেখা যাচ্ছে। সরকার এরই মধ্যে উড়িরচর-কোম্পানীগঞ্জে একটি ক্রসবাঁধ
নির্মাণ করছে। এ বাঁধ নির্মাণের পরবর্তী সাত বছরের মধ্যে আরও বিপুল পরিমাণ চর জেগে
উঠবে বলে আশা করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে সন্তোষপুর-মিরসরাইয়ের মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া সন্দ্বীপ
চ্যানেলের বড় অংশ ভরাট হয়ে চর জাগতে পারে।
দেশের
অর্থনীতিতে গেমচেঞ্জারের নিয়ামক হয়ে ওঠা সন্দ্বীপের সঙ্গে যোগাযোগ সুগম করতে স্বপ্নের
সেতু প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল সত্যিকার অর্থেই কর্মচঞ্চল হয়ে
উঠবে, ভাসানচর, জাহাজ্জ্যার চর ছাড়াও আশপাশের বিপুল ভূমিতে উন্নয়নের জোয়ার বয়ে যাবে।
সন্দ্বীপ ঘিরে এখন স্বপ্নের হাতছানি। এ স্বপ্ন পূরণে বদলে যাবে আমূল দৃশ্যপট। দ্বীপে শিল্পের কাঁচামাল পৌঁছানো কিংবা কারখানায়
উৎপাদিত পণ্য সাগরপথেই যেমন চট্টগ্রাম বন্দর পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া যাবে তেমন সড়কপথেও
দ্রুত পৌঁছার ব্যবস্থা থাকবে। দ্বীপটির কৃষি, মৎস্যের পাশাপাশি পর্যটন খাত দুর্বার
গতিতে এগিয়ে যাবে। আমূল বদলে যাবে দ্বীপের অর্থনীতিসহ মানুষের জীবনমান। অর্থনৈতিক অঞ্চলে
উৎপাদিত বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানির প্রয়োজনেই সেতু দরকার হবে।
সন্দ্বীপের
অনেক মানুষ যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে আছে। তাদের পাঠানো রেমিট্যান্স এককভাবে ১১
শতাংশ। তারা যদি আগামীর ‘স্বপ্নসেতু’ পাড়ি দিয়ে নিজ জন্মভিটায় পৌঁছে এবং বিনিয়োগের
সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করে তা হলেও তো ছোট্ট দ্বীপরাজ্যে কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থলগ্নি হবে।
অর্থ লগ্নি করতে পারে বিদেশিরাও। সন্দ্বীপের কৃতী সন্তান সাবেক সচিব ও অর্থনীতিবিদ
মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান মনে করেন, সন্দ্বীপের যোগাযোগব্যবস্থা সহজ হলে এ উপজেলার
প্রবাসীরাই বিনিয়োগ করতে পারেন দুই থেকে তিনশ মিলিয়ন ডলার। একটি দ্বীপ ঘিরে ‘পদ্মা
সেতুর’ স্বপ্ন দেখা দিবাস্বপ্নের মতোই কি-না এ প্রশ্ন তুলেছেন কেউ কেউ। কিন্তু স্বপ্ন
যে দিনেই দেখতে হয়। রাতের ঘুমে দেখা স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয় না। জাগরণে দেখা স্বপ্নই
বাস্তবায়িত হয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন
জাগরণে দেখেছেন, আন্দোলনের বীজ বপনও করেছেন দিনমান সারা দেশ চষে বেড়িয়ে। তাই স্বর্ণদ্বীপে
সোনালি অর্থনীতি গড়ে তুলতে দিবাস্বপ্নেরই প্রয়োজন।
চিরকালীন স্বপ্নদ্রষ্টা খ্যাত ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি এপিজে আবদুল কালামের প্রণিধানযোগ্য একটি উক্তি স্মরণ করা যেতে পারে। ভারতের তামিলনাড়ুর রামেশ্বরমের প্রত্যন্ত গ্রামে দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেওয়া এই ব্যক্তি ভারতের রাষ্ট্রপতি হবেন তা হয়তো শত কোটি আলোকবর্ষ দূরের কল্পনায়ও কেউ ভাবেনি। সেই এপিজে আবদুল কালামই হয়েছিলেন ভারতের রাষ্ট্রপতি। রাষ্ট্রপতির অমর উক্তি এ রকমÑ‘স্বপ্ন পূরণ না হওয়া পর্যন্ত স্বপ্ন দেখে যাও। স্বপ্ন সেটা নয় যা তুমি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে দেখো, স্বপ্ন সেটাই যা তোমাকে ঘুমোতে দেয় না।’