সম্পাদকীয়
প্রকাশ : ০৩ মে ২০২৪ ১৩:২৭ পিএম
বাবা-মায়ের কাঁধে সন্তানের লাশের চেয়ে ভারী আর কিছু হতে পারে না।
এমনকি স্বজনদের কাছেও তা দুর্বহ। ২ মে দুপুরে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে
এরই ফের মর্মস্পর্শী যে চিত্র দেখা গেছে এর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণও অত্যন্ত কঠিন। গত ১৪
ফেব্রুয়ারি অভিবাসনপ্রত্যাশী কিছু ব্যক্তি ইউরোপের উদ্দেশে সমুদ্রপথে যাত্রা শুরু করেন
এবং যাত্রাপথে নৌকাটি তিউনিসিয়ার উপকূলে ডুবে যায়। নৌকাটিতে চালকসহ মোট ৫২ জন যাত্রী
ছিলেন। দুর্ঘটনার পর ৪৪ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয় এবং ৯ জন প্রাণ হারান। ৯ জনের মধ্যে
৮ জনই বাংলাদেশি এবং তাদের লাশ লিবিয়া থেকে বিমানযোগে দেশে আনা হয়। আন্তর্জাতিক অভিবাসন
সংস্থার তথ্যমতে, বিভিন্ন দেশের উপকূল থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে
যাওয়ার চেষ্টাকালে শুধু গত বছরই ৩ হাজারেরও বেশি অভিবাসনপ্রত্যাশী প্রাণ হারিয়েছেন
কিংবা নিখোঁজ হয়েছেন, যাদের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক এই অঞ্চলের। আমরা জানি, সম্প্রতি ইউরোপের
বিভিন্ন দেশ অবৈধ অভিবাসনের ব্যাপারে কঠোর অবস্থান নিয়েছে এবং লিবিয়া-তিউনিশিয়া নৌবাহিনী
নজরদারি কঠোর করেছে। এই প্রেক্ষাপটে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপ-যাত্রা আরও বেশি বিপজ্জনক
এবং ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
ভাগ্যান্বেষণের লক্ষ্যে এভাবে যাতে কেউ অভিবাসনে আগ্রহী না হন তা
বিভিন্ন মাধ্যমে সরকার বারবার সতর্ক করলেও আমরা দেখছি, স্বপ্নপূরণের প্রত্যাশায় মৃত্যুযাত্রা
কোনোভাবেই থামছে না। সঙ্গতই প্রশ্ন দাঁড়ায়, এর প্রেক্ষাপট কিংবা কারণ কী? দেশের আর্থসামাজিক
ক্ষেত্রে বিদ্যমান সংকট, সমাজের ক্রমাগত বৈষম্যের ছায়া বিস্তৃত হওয়া, চাহিদার নিরিখে
কর্মক্ষেত্র প্রসারিত না হওয়া কিংবা কর্মহীনের ক্রমবর্ধমান হার এ পরিস্থিতির জন্য অনেকাংশেই
দায়ী। বিদ্যমান বাস্তবতায় সর্বাংশে তা মেনে নেওয়ার অবকাশ নেই। কারণ আত্মকর্মসংস্থানমূলক
কর্মক্ষেত্রের প্রেক্ষাপট অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় এখন অনেকটাই সহজ হলেও এক্ষেত্রে
চেষ্টা না চালিয়ে অনেকে দালালের হাতে জীবন সঁপে দিয়ে ভাগ্য বদলাতে চান! তাদের এই চিন্তা
কোনোভাবেই যে সঠিক নয় এবং বিদ্যমান বৈশ্বিক বাস্তবতায় তা যে অত্যন্ত দুরূহ তাও তারা
ধর্তব্যের মধ্যে নেন না। যে অর্থ দালালের হাতে তুলে দিয়ে জীবনের চাকা ঘোরাতে যৌবনের
এই প্রয়াস তার চেয়ে অনেক কম অর্থ বিনিয়োগ করে দেশেই আত্মকর্মসংস্থানমূলক কর্মকাণ্ডে
যুক্ত হয়ে জীবনচিত্র বদলানো সম্ভব এবং এমন অনেক নজির আমাদের সামনে আছেও। আমরা জানি,
আত্মকর্মসংস্থানমূলক বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকার স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা করেছে কর্মসংস্থান
ব্যাংকসহ অন্য আর্থিক খাতের মাধ্যমে। যদিও অভিযোগ আছে, সরকারের মহৎ উদ্দেশ্যের পরও
সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল কতিপয় অসাধু ব্যক্তির কারণে এই পথেও কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে।
আমরা মনে করি, তাদের ব্যাপারে কঠোর অবস্থান নেওয়া বাঞ্ছনীয়।
সংশ্লিষ্ট মহলগুলোর উদাসীনতা-ব্যর্থতার সুযোগে মানব পাচারের হোতারা
অন্যের জীবন বলি দিয়ে নিজেরা ‘মোটাতাজা’ হবে আর এর কোনো প্রতিবিধান নিশ্চিত করা যাবে
না, তা তো হতে পারে না। দালাল চক্রের খপ্পরে পড়ে যারা সহায়সম্পত্তি বিক্রি করে বিদেশে
গিয়ে কিংবা যাত্রাপথে ফের দালাল চক্রের হাতেই জিম্মি হন, এমন ভয়ংকর পরিস্থিতি জানা
সত্ত্বেও স্বেচ্ছায় কেন সম্ভাবনাময় জীবনগুলো অপমৃত্যুর পথে ধাবিত? বিষয়টি ফিরে ফিরে
জিজ্ঞাসার বিষয় হয়ে দাঁড়ালেও যাদের এ ব্যাপারে প্রতিকার-প্রতিবিধানের দায়দায়িত্ব রয়েছে
তাদের নির্বিকারত্ব আমাদের উদ্বিগ্ন এবং যুগপৎ ক্ষুব্ধ না করে পারে না। অবৈধভাবে অভিবাসন
প্রচেষ্টার ফল কতটা মর্মান্তিক হতে পারে এর নজির বারবার সামনে এলেও সচেতনতায় ঘাটতি
কিংবা অলীক স্বপ্নে বিভোর হওয়ার মতো অপপ্রবণতার রাশ টানা যাচ্ছে না। ভূমধ্যসাগরে কত
বাংলাদেশি সম্ভাবনাময় জীবনের সলিল সমাধি ঘটেছে, এর সঠিক হিসাব নির্ণয় করাও ভার। ইউরোপের
দেশগুলোতে উন্নত জীবনযাপন ও কর্মসন্ধানের পথ বাতলে দিয়ে দালালরা বিপুল অঙ্কের টাকা
হাতিয়ে নিয়ে আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে যে ক্ষতের সৃষ্টি করেছে, তা অপূরণীয়। সংবাদমাধ্যমেই
বহুবার উঠে এসেছে, দালালদের প্রলোভনের ফাঁদে পা দিয়ে ভিটেমাটি খুইয়ে উন্নত জীবনের প্রত্যাশায়
বিদেশ যেতে গিয়ে রিক্ত হাতে আবার অনেকেই ফিরে এসেছেন। তা ছাড়া অনেক ক্ষেত্রেই প্রবাসে
অবস্থানরত অবৈধ বাংলাদেশিদের জীবনযাপনের আরও অনেক মর্মস্পর্শী ঘটনা সংবাদমাধ্যমের কল্যাণে
আমাদের অজানা নয়। মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডের জঙ্গলে অবৈধভাবে অনুপ্রবেশ করা বাংলাদেশিদের
কঙ্কালপ্রাপ্তি ও গণকবরে দেহাবশেষ উদ্ধারের মতো বেদনাকাতর সংবাদও ইতোমধ্যে কম মেলেনি।
এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের পথ কীÑ এমনটি জিজ্ঞাস্য হলেও এর উত্তর
খুব জটিল নয়। ভাগ্যান্বেষীদের অলীক স্বপ্ন বিসর্জন দিয়ে বাস্তবানুগ চিন্তা করে সচেতনতাবোধ
পুষ্ট করতে হবে। দেশে যাতে সহজ প্রক্রিয়ায় আত্মকর্মসংস্থানের ক্ষেত্র বিস্তৃত হয়, এই
প্রচেষ্টা জোরদার করাও বাঞ্ছনীয়। পাশাপাশি বিষয়ভিত্তিক কর্মদক্ষতা নিশ্চিত করে দক্ষ
মানবসম্পদ গড়ার প্রয়াস জোরদার করতে হবে। একই সঙ্গে মানব পাচারের ফাঁদ পেতে বহুসংখ্যক
জীবনের ক্ষয় করে যে অল্পসংখ্যক ব্যক্তি ফুলে-ফেঁপে উঠছে তাদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তযোগ্য
বিচার নিশ্চিত করার বিকল্প নেই। ডিজিটাল বাংলাদেশ ও আগামীর স্মার্ট বাংলাদেশের সুফল
সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য অবৈধ ও ঝুঁকিপূর্ণ অভিবাসনের পথ রুদ্ধ করতেই
হবে। এ ব্যাপারে প্রশাসনিক ব্যবস্থার পাশাপাশি ব্যাপকভাবে সামাজিক উদ্যোগ নেওয়ার বিষয়টিও
সমভাবেই গুরুত্বপূর্ণ। অভিবাসন নিশ্চয়ই আমাদের জন্য আশীর্বাদ, কিন্তু অবৈধ অভিবাসন
যে কোনোভাবেই কল্যাণকর নয়; তা মনে রাখতে হবে। দালালদের হাতে অর্থ ও জীবন সঁপে দিয়ে
যারা উন্নত জীবন ও কর্মপ্রত্যাশার স্বপ্নে বিভোর তাদের হুঁশ ফিরুক।
দেশে ১৮ থেকে ৪০ বছর বয়সি নাগরিকের সংখ্যা বিশ্বের অনেক দেশের মোট
জনসংখ্যার চেয়েও বেশি। আমরা মনে করি, এই জনগোষ্ঠীকে মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে যদি দেশে-বিদেশে
নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় কর্মক্ষেত্রে সম্পৃক্ত করা যায়, তাহলে সার্বিক প্রেক্ষাপট বদলে
দেওয়া মোটেও দুরূহ নয়। একই সঙ্গে নতুন নতুন শ্রমবাজার সন্ধানের পাশাপাশি কর্ম-উদ্যোগীদের
স্বচ্ছপথে বিদেশ যাওয়ার ব্যবস্থাও নিশ্চিত করতে হবে। আমরা জানি, এ বিষয়ে ইতোমধ্যে আলোচনা-পর্যালোচনা
কম হয়নি কিন্তু মানব পাচারের অভিশাপ ঘোচানো যায়নি। আমরা বিশ্বাস করি, সুশাসন নিশ্চিত
হলে অপশক্তির দৌরাত্ম্য বন্ধ হতে বাধ্য। যারা জীবনবিনাশী অপতৎপরতায় লিপ্ত তাদের মূলোৎপাটন
করে কর্মক্ষমদের জীবনমানের নিশ্চয়তার বিধান নিশ্চিত করার প্রয়াস আরও জোরদার হোক। আমরা
চাই, বাংলাদেশিরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ুক; কিন্তু কোনোভাবেই অবৈধ পথে নয়।