× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

উপজেলা নির্বাচন

ইসি ও সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ

ড. মোসলেহউদ্দিন আহমেদ

প্রকাশ : ০৩ মে ২০২৪ ১৩:২৬ পিএম

ইসি ও সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ

উপজেলা নির্বাচন নিয়ে বহুমাত্রিক শঙ্কা নানা মহল থেকে প্রকাশ পাচ্ছে। সকালেই বোঝা যায় সারা দিনের গতিপ্রকৃতিÑএমন কথা আমাদের সমাজে বহুলপ্রচলিত। এ প্রেক্ষাপটে ৮ মে এবারের উপজেলা নির্বাচনের ধারাবাহিক পর্বের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। এবার চার পর্বে হতে যাচ্ছে উপজেলা নির্বাচন। প্রথম পর্ব ৮ মে। কিন্তু প্রতিদিনই সংবাদমাধ্যমে উঠে আসছে নির্বাচন নিয়ে মাঠ পর্যায়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার নানা বার্তা। উপজেলা নির্বাচনে মন্ত্রী-এমপিরা নানাভাবে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছেন এবং এর ফলে নির্বাচন সংঘাতময় হয়ে ওঠার আশঙ্কা রয়েছে। ২০১৫ সালে উপজেলা নির্বাচন অধ্যাদেশ সংশোধন করা হয়। সংশোধনের আগে দলীয় প্রতীকে নির্বাচনের নিয়ম ছিল না। ২০১৫ সালে দলীয় প্রতীকে নির্বাচন শুরু হলো। কিন্তু এবার স্থানীয় সরকার কাঠামোর উপজেলা স্তরের নির্বাচন দলীয় ভিত্তিতে হচ্ছে না।

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে মন্ত্রী-এমপিদের নির্বাচনের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করার এবং তাদের স্বজনদের প্রার্থিতা প্রত্যাহারে বারবার নির্দেশ দেওয়া হলেও এর কার্যকারিতা দৃশ্যমান হয়নি। উল্লেখ্য, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেশের অন্যতম বিরোধী দল বিএনপি এবং সমমনারা অংশ নেয়নি। উপজেলা নির্বাচনেও তা-ই পরিলক্ষিত হচ্ছে। বলা হচ্ছে দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হবে না তবে সাধারণ নির্বাচনের মতো এ ক্ষেত্রেও ডামি প্রার্থী দেখা যাচ্ছে এবং এ ধরনের ডামি প্রার্থীদের সঙ্গে মন্ত্রী-এমপিদের এক ধরনের প্রশ্রয়ের অভিযোগও নানা মহলে পাওয়া যাচ্ছে। দলীয় প্রতীকে নির্বাচনের সময়ও এমন হয়েছিল এবং এবারও তেমনটিই দেখা যাচ্ছে। প্রচ্ছন্নভাবে দল এ নির্বাচনে উপস্থিত। কিন্তু যারা স্বতন্ত্র প্রার্থী তারা এক ধরনের শঙ্কায় রয়েছেন বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। নির্বাচন কমিশন ও তাদের সহযোগী শক্তি সরকারের জন্য ইতোমধ্যে উপজেলা নির্বাচনে সংঘাত-সহিংসতা থামিয়ে অংশগ্রহণমূলক ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বিএনপিসহ সমমনারা বর্জন করলেও স্থানীয় পর্যায়ের বিএনপির অনেক নেতাই এ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন এবং বিএনপির তরফে নির্বাচন বর্জনের নির্দেশ উপেক্ষা করে যারা নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে এবং নেওয়াও হচ্ছে।

সংবাদমাধ্যমে এও উঠে এসেছেÑউপজেলা নির্বাচনে অংশ নেওয়া বিএনপির ৭৩ নেতার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়া হয়েছে এবং তাদের বহিষ্কারাদেশ পাঠানো হয়েছে। অন্যদিকে এ নির্বাচন ঘিরে আওয়ামী লীগের তৃণমূলে অভ্যন্তরীণ কোন্দল ক্রমেই বাড়ছে। ২৭ এপ্রিল প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থীদের নিয়ে এবার আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রায় একই ধরনের অস্বস্তিকর অভিজ্ঞতা। কেন্দ্রের বারণ শোনেননি দুই দলেরই তৃণমূলের নেতারা।’ নির্বাচন কমিশনের সহযোগী শক্তি হিসেবে সরকারও নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক করার চেষ্টা করেছে। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ বুঝতে পেরেছিল, দলীয় প্রতীকে নির্বাচন আয়োজন করতে গেলে বর্জনকারী দলগুলোর অধিকাংশই অংশ নেবে না। স্থানীয় সরকার কাঠামোর নির্বাচনের আভাস সম্পূর্ণ আলাদা। এখানে দলীয় স্বার্থের বদলে ব্যক্তি রাজনীতিকের স্বার্থই প্রাধান্য পায়। ফলে দলীয় প্রতীকে নির্বাচন না করার সিদ্ধান্তের মাধ্যমে নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার অধিকার নিশ্চিত করার পরিসর বাড়ানো হয়েছে। একজন ব্যক্তি স্থানীয় পর্যায়ে তার রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করলে জনপ্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশের অধিকার তার রয়েছে।

মূলত দলীয় প্রতীকে নির্বাচন না হওয়ার কারণে আগ্রহীরা অংশগ্রহণের সুযোগ পেয়েছেন। বিএনপির তৃণমূল পর্যায়ের অনেক নেতাও হয়তো তেমনটিই ভাবছেন। তারা হয়তো ভাবছেন, এখানে দলীয় প্রভাব বেশি নয় এবং স্থানীয় পর্যায়ে তাদের কাজ করার সুযোগ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে নানা সমীকরণ কাজ করতে পারে। স্থানীয় সরকার কাঠামোর নির্বাচনে দলীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে ভোটাররা ভোট দেন না। এখানে ব্যক্তি পরিচয়ই মুখ্য। তাই বিএনপি বা সমমনারা যতই পদক্ষেপ নিক, স্থানীয় সরকার কাঠামোর নির্বাচনে কোনো প্রার্থীর অংশগ্রহণ থামাতে পারবে না। এ ক্ষেত্রে দলীয় শৃঙ্খলাভঙ্গের বিষয়টি সঙ্গত কারণেই সামনে চলে আসে। এ স্তম্ভেই লিখেছিলাম, স্থানীয় সরকার কাঠামো এখন সরকারের তাঁবেদারে পরিণত হয়েছে। তাই যে-ই নির্বাচিত হোন না কেন তাকে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে আঁতাত করতেই হবে। যে পদ্ধতিতে স্থানীয় সরকার কাঠামো গড়ে তোলার কথা ছিল তা উপজেলায় অনুপস্থিত। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ যে ধরনের স্থানীয় সরকার কাঠামো গড়ে তুলেছিলেন তা সাধারণ মানুষ গ্রহণ করেছিল। ১৯৯১-৯৭ সাল পর্যন্ত স্থানীয় সরকার কাঠামো পরিচালনায় বিএনপি বড় ভুল করেছিল। ১৯৯৭ সালের পরে উপজেলা নির্বাচন আবার একটা রূপ পেতে শুরু করে। কিন্তু আমরা দেখছি, পূর্ববর্তী সময়ে ক্ষমতাসীন দল স্থানীয় সরকার কাঠামো পরিচালনায় যে ভুল করেছিল পরে সব রাজনৈতিক সরকার একই ভুল করেছে।

নির্বাচনে শৃঙ্খলা ও নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নানা মহলে এবং সংবাদমাধ্যমে যখন প্রশ্নের পর প্রশ্ন এবং আশঙ্কার চিত্র উঠে আসছে তখনও নির্বাচন কমিশনের তরফে দৃঢ়প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছে, যেকোনো মূল্যে নির্বাচন প্রশ্নমুক্ত করার সব রকম ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অন্যদিকে আইজিপি পুলিশ সুপারদের কঠোর ও নির্মোহ অবস্থানে থেকে দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দিয়েছেন। কোনো কোনো বিশ্লেষক ইতোমধ্যে বলেছেন, ‘উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থীরা ভোটারকে নয় গুরুত্ব দিচ্ছেন প্রশাসনকে।’ অন্যদিকে টাকার বিনিময়ে অনেকেই ভোট নেওয়ার অপপ্রক্রিয়ায় সক্রিয় রয়েছেন বলেও সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে। প্রশাসনের অসাধু কর্মকর্তারাও সুযোগ সন্ধানে আছেন। এমন বার্তাও সংবাদমাধ্যমেরই। রাজনীতির মাঠ আপাতত তেমন সরব না হলেও উপজেলা নির্বাচনের প্রচার কার্যক্রম ঘিরে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সংঘাত সহিংসতার খবর ও বলবানদের মহড়ার চিত্র সংবাদমাধ্যমে উঠে আসছে। আমরা দেখছি, স্থানীয় সরকার কাঠামোর প্রতিটি স্তরকেই যেকোনো সময়ের সরকারই স্থানীয় স্বশাসনের ভিত্তিতে দেখতে পারেনি। তাদের চিন্তাভাবনায় এটি যেন সরকারের প্রশাসনিক ব্যবস্থার বর্ধিত অংশ। অথচ ১৮৮২ সালে জেলা প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করে ব্রিটিশরা। তখন স্থানীয় সরকারের তিনটি স্তর হয়েছিল : ইউনিয়ন বোর্ড, জেলা বোর্ড ও লোকাল বোর্ড। এভাবে স্থানীয় স্বশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যায়। এখনও স্থানীয় সরকার কাঠামোর বিভিন্ন স্তরের নির্বাচন উৎসবমুখর হয়ে থাকে। যত দিন পর্যন্ত সংসদ বা সরকার বিষয়টিকে গুরুত্ব না দেবে তত দিন স্থানীয় সরকার কাঠামোর এ সংকট দূর করা যাবে না।

স্বাধীনতার ৫২ বছর অতিক্রান্তেও স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনব্যবস্থা আমরা গড়তে পারিনি। মূলত স্থানীয় সরকার কাঠামোর মাধ্যমে গোটা দেশকে বিকেন্দ্রীকরণ করা যায়। বিকেন্দ্রীকরণের ক্ষেত্রে ডিকনসেনট্রেশন, ডেলিগেশন, ডেভ্যুলুশন এবং প্রাইভেটাইজেশন জরুরি। ডেভ্যুলুশন বা নতুনভাবে স্থানীয় অঞ্চল গড়ে তোলার ভাবনা থেকেই মূলত ব্রিটিশরা স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল। এ ধরনের ব্যবস্থার প্রধান কাঠামো ছিল পাঞ্জাব ও বাংলায়। পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত ব্যবস্থার মতো এ কাঠামো অনেকাংশে গোটা দেশকে বিকেন্দ্রীকরণের সুযোগ করে দেয়। স্থানীয় সরকার কাঠামো তার নিজস্ব ভঙ্গিতে চলবে। অর্থায়ন, আইন পরিচালনা, নিয়ম সবই স্থানীয় সরকারের প্রশাসনিক কাঠামো দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে।

পাকিস্তান আমলে এ ব্যবস্থা পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়। অথচ এখন অবস্থা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিদের প্রশাসনের সঙ্গে আঁতাত করতেই হয়। প্রশাসন এখানে তাদের সহযোগী শক্তি হিসেবে কাজ করতে পারছে না, এ অভিযোগও নতুন নয়। আর প্রশাসনের ওপর স্থানীয় সরকার কাঠামোর অতিনির্ভরতার ফলে দুর্নীতি বাড়ছে। স্থানীয় সরকার কাঠামোর প্রতিনিধি প্রশাসনকে সহযোগিতা না করলে প্রশাসন কোনো কারণ দেখিয়ে তাদের বিলুপ্ত করার আইনি অধিকার রাখে। যত দিন স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকার গঠিত না হবে তত দিন আমরা এ সংঘাত-সহিংসতা, রাজনৈতিক ছত্রছায়ার প্রভাবমুক্ত স্থানীয় সরকার কাঠামোর নির্বাচন পাব না। এমনকি মানুষকে সেবা দেওয়া বা স্থানীয় পর্যায়ে সুশাসন নিশ্চিত করার ক্ষেত্রেও বহুবিধ প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়ে যাবে। এমনটি কাঙ্ক্ষিত নয়।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনোত্তর অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া চার ধাপের উপজেলা নির্বাচন ইসি ও সরকার উভয়ের জন্যই বড় চ্যালেঞ্জ। ৮মে প্রথম ধাপে অনুষ্ঠিত নির্বাচন যদি প্রশ্নমুক্ত করা যায়, তাহলে আশা করা যায় এর ইতিবাচক প্রভাব পরবর্তী ধাপেও পড়বে। ইসিকে অবশ্যই কঠোর অবস্থানে থাকতে হবে একইসঙ্গে সরকারকেও নির্মোহ অবস্থান নিয়ে যথাযথ সহযোগিতা করতে হবে। 


  • স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ও অধ্যাপক, লোকপ্রশাসন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা