প্রজন্মের ভাবনা
সংগীত কুমার
প্রকাশ : ০৩ মে ২০২৪ ১৩:১৭ পিএম
৪ মে থেকে ট্রেনের
ভাড়ায় রেয়াতি (ছাড়) ব্যবস্থা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। ফলে কোনো
যাত্রী ১০০ কিলোমিটারের অধিক দূরত্বে ভ্রমণ করলে তার ভাড়ায় যে রেয়াত বা ছাড় পেত, তা
আর পাবে না। এ নতুন ব্যবস্থায় দূরের গন্তব্যে ট্রেনের ভাড়া সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ পর্যন্ত
বৃদ্ধি পাবে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। লোকসানের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতেই নাকি
এমন সিদ্ধান্ত। কিন্তু ভাড়া বাড়ালেই কি ট্রেনের লোকসান কমবে? ২০১২ সালেও সেকশনভিত্তিক
রেয়াত প্রত্যাহার করে সর্বনিম্ন ৫ থেকে সর্বোচ্চ ১১০ শতাংশ ভাড়া বাড়ানো হয়েছিল। পরে
২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে আরেক দফা ভাড়া বাড়ানো হয় ৭ থেকে ৯ শতাংশ। বর্তমান ভাড়া বৃদ্ধির
মাধ্যমে সীমিত ও নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর অর্থনৈতিক চাপ বাড়লেও রেলের আয় বাড়বে ৩০০ কোটি
টাকার মতো। অর্থাৎ মাত্র ৩০০ কোটি টাকার বাড়তি রাজস্বের জন্য সীমিত ও নিম্ন আয়ের মানুষের
ওপর নতুন করে ভাড়া বৃদ্ধির চাপ তৈরি করতে হচ্ছে?
যাত্রী পরিবহনে
ভাড়া ছাড়া আরও যেসব বিষয়ের ওপর ট্রেনপ্রতি আয় নির্ভর করে, তার মধ্যে রয়েছে ট্রেনপ্রতি
যাত্রীবাহী কোচের সংখ্যা, কোচের যাত্রীধারণ ক্ষমতা ও কোচের সিটের কত শতাংশ ব্যবহৃত
হচ্ছে (অকুপেন্সি রেট) তার হার ইত্যাদি। কোচের সংখ্যা বাড়ালে ট্রেন থেকে আয় বাড়ে কিন্তু
খরচ সমানুপাতে বাড়াতে হয় না। কিন্তু চাহিদা ও জনপ্রিয়তা থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন রুটে
প্রয়োজনীয়সংখ্যক ট্রেন ও ট্রেনপ্রতি পর্যাপ্ত কোচ বা বগি সরবরাহ না করায় রেলের আয় বাড়ছে
না। তথ্যপ্রযুক্তির যুগে অধিকাংশ যাত্রী অনলাইনে টিকিট কাটে। কিন্তু বাংলাদেশ রেলওয়ের
নিজস্ব পেমেন্টব্যবস্থা না থাকায় বিভিন্ন কোম্পানি রেলওয়েরই অ্যাপ ব্যবহার করে হাজার
কোটি টাকা আয় করছে। রেলের উন্নয়নে যে বিপুল অর্থ ব্যয় হয়, প্রশ্ন আছে তা নিয়েও। কারণ
পর্যাপ্ত ইঞ্জিন, কোচ, লোকবলের ব্যবস্থা না করেই নতুন নতুন ট্রেন চালু এবং নতুন রেললাইন
ও স্টেশন ভবন নির্মাণে অধিকাংশ অর্থ ব্যয় হচ্ছে। ফলে নতুন লাইনগুলোয় পর্যাপ্তসংখ্যক
ট্রেন চালানো যাচ্ছে না। ট্রেনগুলোয় পর্যাপ্তসংখ্যক কোচ দেওয়া হচ্ছে না। নানা অজুহাতে
গরিবের ট্রেন বলে পরিচিত লোকাল ও কমিউটার ট্রেন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
একটি সমীক্ষা
বলছে, রেলের সব কটি ট্রেন নিরবচ্ছিন্নভাবে চালু রাখতে দরকার ৩ হাজারের বেশি কোচ ও ৫০০
ইঞ্জিন। কিন্তু বর্তমানে রেলে কোচ আছে ১ হাজার ৭৮৮টি, যার ৪৭ শতাংশেরই অর্থনৈতিক মেয়াদকাল
শেষ। অন্যদিকে রেলে বর্তমান সচল ইঞ্জিনের সংখ্যা মাত্র ২৯৫টি, যার ৬০ শতাংশই মেয়াদোত্তীর্ণ।
আর মালবাহী ওয়াগনের সংখ্যা ৩ হাজার ২৪৭টি, যার ৬৭ শতাংশ মেয়াদোত্তীর্ণ।
শুধু যাত্রী পরিবহনের
মাধ্যমে রেলকে লাভজনক অবস্থানে নিয়ে যাওয়া অসম্ভব। এর জন্য প্রয়োজন মালামাল পরিবহনে
গুরুত্ব প্রদান। রেলে একটি যাত্রীবাহী ট্রেনের দৈনিক গড় আয় যেখানে ৩ লাখ টাকা, সেখানে
একটি মালবাহী ট্রেনের গড় আয় ৭-৮ লাখ টাকা। কিন্তু প্রয়োজনীয় ইঞ্জিন ও ওয়াগন সংকটের
কারণে বাংলাদেশ মালবাহী ট্রেনের সংখ্যা বাড়াতে পারছে না। সম্প্রতি জাতীয় সংসদে রেলমন্ত্রীর
দেওয়া তথ্য অনুসারে, দেশে ৩৫০টির বেশি যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল করলেও মালবাহী ট্রেন
মাত্র ২০-২৫টি চলাচল করে। ফলে রেলের আয় কম হচ্ছে। তাই শুধু ভাড়া বাড়ানো নয়, লোকসানের
মূল কারণ উদ্ঘাটন এবং সেগুলো সমাধানের মাধ্যমেই রেলকে লোকসানের বৃত্ত থেকে বের করে
আনা সম্ভব।