× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

কোন পথে গ্রামের মানুষ

ইমতিয়ার শামীম

প্রকাশ : ০২ আগস্ট ২০২২ ১৯:৪০ পিএম

আপডেট : ০৪ আগস্ট ২০২২ ১৪:৫৩ পিএম

ফাইল ছবি

ফাইল ছবি

তিনদিকেই তার ব্রহ্মপুত্র নদ। যারা পাখির চোখে দেখতে পারেন, তাঁরা বলে থাকেন, এই নদ বিভক্ত করেছে তাকে, করে রেখেছে বিচ্ছিন্ন; বিভক্তি আর বিচ্ছিন্নতা আবার তাকে ঠেলে দিয়েছে দরিদ্রতার দিকে। জনগোষ্ঠীর ৭৯ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষই দরিদ্র সেখানে। এমন দরিদ্রময় জনবসতির নাম চর রাজিবপুর। 

নদীকে যদি ‘শত্রু’ মনে করি, তা হলে অবশ্য চর রাজিবপুরকে বিচ্ছিন্নই বলতে হবে। বিচ্ছিন্ন সে মূল ভৌগোলিক এলাকা আর জনপদ থেকে। কেননা এই উপজেলা আর কুড়িগ্রাম সদরকে দুইদিকে ফেলে রেখেছে ব্রহ্মপুত্র নদ। শুকনো ঠনঠনে রাস্তা বানিয়ে গাড়ি নিয়ে সেখানে জেলা সদর থেকে যাওয়া সম্ভব নয় ওই নদটির কারণে। ব্রহ্মপুত্র মূর্তিমান ‘বিচ্ছিন্নতা’র প্রতীক চর রাজিবপুরবাসীর কাছে, হয়তোবা উন্নয়নবিশারদদের কাছেও। 

তাহলে নদী কি যুক্ত করে না মানুষকে? যুক্ত করে না হাওর-বাঁওড়? এমন সব জলপ্রবাহ কি তাহলে উৎস বিভক্তির?

এই প্রশ্নের উত্তর বরং একটু পরে খুঁজি। আগে বরং চেয়ে দেখি, দারিদ্র্য নামের ওই দানবের চেহারা। দেশে গরিব মানুষজনের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি কুড়িগ্রামে, এই কথা আমরা জেনেছিলাম গেল ২০২১ সালের অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে। পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) একটি সমীক্ষার সুবাদে তথ্যটি জানা গিয়েছিল। সমীক্ষাটি করানো হয়েছিল বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) এবং যুক্তরাজ্যের বাথ বিশ্ববিদ্যালয়কে দিয়ে। এর আগে ২০১৭ সালেও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ২০১৬ সালের খানা জরিপের ভিত্তিতে জানিয়েছিল, দেশে সবচেয়ে বেশি দরিদ্রের বাস কুড়িগ্রামে; সেখানে দারিদ্র্যের হার, ওই বছরের জরিপ অনুযায়ী, ৭০ দশমিক ৮ শতাংশ। 

এবার জনশুমারির প্রতিবেদন প্রকাশের পর আরও নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে, কুড়িগ্রামের রাজিবপুর হলো সেই উপজেলা, যেখানে সবচেয়ে বেশি দরিদ্রতা ভর করেছে। একটি দুটি নয়, দেশের ৫৭৭টি উপজেলার দারিদ্র্য পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে এ উপাত্ত তুলে ধরেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)।

কুড়িগ্রামের এই অবস্থা আজকের নয়, অনেক-অনেক দিনের। বাবা সৈয়দ সিদ্দিক হুসাইনের কুড়িগ্রাম প্রত্যাবর্তনের পরিপ্রেক্ষিত বর্ণনা দিতে গিয়ে সৈয়দ শামসুল হক তাঁর আত্মজীবনী ‘প্রণীত জীবন’-এ লিখেছিলেন, ‘কলকাতায় হোমিও পড়াশোনা করে সেই মহানগরেই প্র্যাকটিস শুরু করে হঠাৎ এক অন্তর্গত তাড়নায় চলে আসেন কুড়িগ্রামে, ১৯২৯ সালে তখনকার ব্রিটিশ বাংলার সবচেয়ে দরিদ্র এলাকা হিসেবে কুড়িগ্রামকে শনাক্ত করে।’ যার অর্থ, কুড়িগ্রামের দারিদ্র্য প্রায় একশ’ বছর আগে সেই ঔপনিবেশিক শাসনামলেও ছিল ব্যাপকভাবে আলোচিত, সমালোচিত। বলা বোধ হয় ভুল হবে না, ‘কার্তিকের মঙ্গা’কে পরাজিত করে এই জনপদের মানুষের ঘুরে দাঁড়ানোর যে কাহিনী আমাদের শোনানো হয়, তা হয়তো খানিকটা অতিকথনই।

কিন্তু কেন চর রাজিবপুরের মানুষ এত দরিদ্র? কেন দরিদ্র বেশি কুড়িগ্রামে? গত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে অনেক উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়েছে কুড়িগ্রামে। যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নের লক্ষ্যে সেখানে বন্দর নির্মাণ ও সংস্কারের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে, চালু করা হয়েছে আন্তঃনগর ট্রেন চলাচল আর পরিচালনা করা হচ্ছে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি। কিন্তু তারপরও কুড়িগ্রামের এই অবস্থা আমাদের বিস্মিত করে, জিজ্ঞাসু করে। 

চর রাজিবপুর কিংবা কুড়িগ্রাম আসলে একটি উদাহরণ মাত্র; যেমন উদাহরণ মাত্র ব্রহ্মপুত্র নদ। আসলে সারা দেশের গ্রামাঞ্চলই আমাদের কমবেশি বিস্মিত ও জিজ্ঞাসু করে : গত পাঁচ দশক ধরে গ্রামাঞ্চলে যে রূপান্তর ঘটে চলেছে, তা আসলে কতটুকু ইতিবাচক? পুঁজির প্রবাহ আসলে কতটুকু ইতিবাচক রূপান্তর ঘটাতে পেরেছে সেখানে?

দুই.

সংশয় নেই, গত ৫০ বছরে অনেক উন্নয়ন ঘটেছে। রূপান্তরও ঘটেছে। তাতে গ্রামের মানুষের জীবনযাপনে অনেক পরিবর্তনও এনেছে। কিন্তু তারপরও বলতে হয়, গ্রামের যে উন্নয়ন ও রূপান্তর ঘটে চলেছে, তা আসলে ঘটছে গ্রামের স্বার্থে নয়,শহরের স্বার্থেই; গ্রামের মানুষের যত না, তারও বেশি স্বার্থসিদ্ধি করছে এ উন্নয়ন নগরের মানুষের। গ্রাম আগেও শহরের শোষণের ক্ষেত্র ছিল, এখনও তাই হয়ে আছে। গ্রামের অবকাঠামো ভালো করা হচ্ছে, কেননা শহরের জন্যে খাদ্য থেকে শুরু করে নানা কিছুর দ্রুত যোগান প্রয়োজন। আর বদ্বীপ অঞ্চল হওয়ার পরও বাংলাদেশে পুঁজিব্যবস্থা যত শক্তিশালী হয়েছে, নগর যত শক্তিশালী হয়েছে, নদীও তত অপ্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে, বিশেষত যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে সে যেন মারাত্মক এক ‘শত্রু’ হয়ে উঠেছে। তাকে উপেক্ষিত করতে বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে অসংখ্য স্থানে, নির্মাণ করা হয়েছে সেতু। 

কুড়িগ্রামের কথাই ধরা যাক। একসময় এই কুড়িগ্রামকে মনে করা হতো, আসাম-পূর্ববাংলার দরজা। বিখ্যাত গবেষক স্টিম স্টিলের উপস্থাপিত গবেষণামতে, ব্রহ্মপুত্র-তিস্তা অববাহিকা হলো বিশ্বের সবচেয়ে পুরোনো আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের নৌপথ। ঔপনিবেশিক সেই সময়ে যোগাযোগের কার্যকর পথ নদী ছিল সামন্ত-শাসক ও সাম্রাজ্যবাদীদের শাসন আর শোষণের হাতিয়ার। কুড়িগ্রামের চিলমারী নদীবন্দর আর রৌমারী ও সোনাহাট স্থলবন্দর তখন হাওয়া যুগিয়েছে শাসক মোঘল আর ইংরেজদের পালে। কুড়িগ্রামের লালমনিরহাটে ছিল আসাম-বেঙ্গলের রেলওয়ে হেডকোয়ার্টার। চিলমারীতে ছিল জাহাজ তৈরির কারখানা।

কিন্তু এখন এসব ইতিহাসের বিষয়। সময় যত গড়িয়েছে, নদীর প্রতি অবহেলা বেড়েছে, নৌ-যোগাযোগ ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব কমেছে। কৃষিক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্যে নতুন নতুন প্রযুক্তি এসেছে; কিন্তু সেসব প্রযুক্তি পরিবেশ, ভূমি ও নদীর ওপর কী প্রভাব ফেলবে, প্রকৃতি তাতে কী প্রতিক্রিয়া দেখাবে, তা ভালো করে ভেবে দেখা হয়নি। গ্রামের সঙ্গে নগরের যোগাযোগ বেড়েছে, তাতে কৃষিপণ্যের বাজারও বিন্যস্ত হয়েছে নতুন করে, ভোগ্য-বিলাসী পণ্যের বাজারও সম্প্রসারিত হয়েছে গ্রাম অবধি। বিদ্যুতের সরবরাহ ও সংযোগ ঘটেছে; তাতে কেবল কৃষিকাজে বা জীবনযাপনেই পরিবর্তন আসেনি; কৃষক ও গ্রামবাসী, তারা এখন হয়ে উঠেছে শহুরে বিনোদন পণ্যসামগ্রী নির্মাণ ও বিপণনকারীদের ভোক্তা।

ভূমিগ্রাসের যে রাজনীতি ও অর্থনীতি রয়েছে, সেদিকে তাকালেও আমরা দেখি, গ্রামের মানুষদের অধিকারের পরিসর সংকুচিত হয়ে এসেছে। নদীর জমি দখল হয়ে যাওয়া তো খুব ‘স্বাভাবিক’ ঘটনা, এখন উন্নয়ন ও নিরাপত্তায়নের নামে ভূমি অধিগ্রহণের যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, তার প্রথম শিকার হচ্ছে মূলত গ্রামের মানুষ। গত কয়েক দশক ধরে রাষ্ট্রীয় ভূমি অধিগ্রহণের একটি প্রধান লক্ষ্যই হচ্ছে, দেশিবিদেশি পুঁজি বিনিয়োগকারীদের স্বার্থকে গুরুত্ব দিয়ে ‘বিশেষ’ অর্থনৈতিক জোন বা অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করা। এইসব অধিগ্রহণের সামাজিক ও পরিবেশগত এমনকি অর্থনৈতিক সুদূরপ্রসারী প্রভাবও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে দেখা হচ্ছে না। কর্মসংস্থানের মুলা গ্রামের মানুষের সামনে ঝুলিয়ে দেয়া হচ্ছে বটে, কিন্তু সেটিও শেষ পর্যন্ত গ্রামের মানুষের কপালে জুটছে না।

তিন.

এই যে সর্বশেষ জনশুমারি হয়ে গেল, তা থেকে দেখতে পাচ্ছি, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশই থাকে গ্রামাঞ্চলে। বাকি এক-তৃতীয়াংশ জনসংখ্যার বাস নগরে। শহর এখন এত অনায়াসে ঢুকে পড়ছে গ্রামের ভেতর, তারপরও শহর ও পল্লীভিত্তিক জনসংখ্যার হার যথাক্রমে ৩১.৫১ শতাংশ ও ৬৮.৪৯ শতাংশ। পল্লী এলাকায় থাকেন ১১ কোটি ৩০ লাখ ৬৩ হাজার ৫৮৭ জন মানুষ। নগর এলাকায় থাকেন ৫ কোটি ২০ লাখ ৯ হাজার ৭২ জন। 

দিনকে দিন শহরের তুলনায় গ্রামে বসবাসকারী এই ব্যাপক মানুষের জীবনযাত্রার মানের অবনতি ঘটছে। সাম্প্রতিক পণ্যের মূল্যস্ফীতির তাপও সবচেয়ে তীব্রভাবে স্পর্শ করছে এই গ্রামের মানুষকেই। গত জুলাইয়ে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) মূল্যস্ফীতির যে হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, মূল্যস্ফীতির চাপ সবচেয়ে বেশি পড়ছে গ্রামাঞ্চলে। বিবিএস জানাচ্ছে, গত জুন মাসের শেষে শহরাঞ্চলে যেখানে মূল্যস্ফীতি ঘটেছে ৬ দশমিক ৬২ শতাংশ, গ্রামাঞ্চলে সেখানে মূল্যস্ফীতি ঘটেছে ৮ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ। এ সময় গ্রামাঞ্চলে খাদ্যের মূল্যস্ফীতি ঘটেছে ৮ দশমিক ৯৩ শতাংশ। যা শহরাঞ্চলে ৭ শতাংশের ওপর।

মরার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে গত সোমবার বেড়েছে ইউরিয়া সারের দাম। এখন থেকে প্রতিকেজি ইউরিয়া কিনতে কৃষককে গুনতে হবে ২২ টাকা। আগে তিনি যা কিনতে পারতেন ১৬ টাকায়। তা ১৬ টাকা থেকে বেড়ে ২২ টাকা, এ আর এমন কী! কিন্তু প্রতি একর জমিতে একজন কৃষককে চাষের মৌসুমে তিন ধাপে ৯০ থেকে ১১০ কেজি সার ব্যবহার করতে হয়, এ তথ্যটি বিবেচনায় নিলে, বিষয়টি আর ‘এমন কী’ পর্যায়ে থাকে না। 

একদিকে উৎপাদনের ব্যয়বৃদ্ধি, অন্যদিকে মূল্যস্ফীতির ধকল গ্রামের এই মানুষদের কোনদিকে নিয়ে যাবে, নীতিনির্ধারকরা তা কি ভেবে দেখবেন?

১৮ শ্রাবণ ১৪২৯

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা