এম আর খায়রুল উমাম
প্রকাশ : ০১ মে ২০২৪ ১৯:১৬ পিএম
এম আর খায়রুল উমাম।
কয়েক বছর আগের কথা। রাজধানী ঢাকার এক সিন্ডিকেট দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে চুক্তিতে লোক এনে ভিক্ষা করাতে শুরু করে। প্রকাশিত সংবাদ অনুসারে রংপুরের এক ব্যক্তির সঙ্গে কৃত চুক্তির হিসাব অনুযায়ী রোজা ও ঈদের এক মাস সিন্ডিকেট নির্ধারিত স্থানে ভিক্ষা করতে হবে এবং প্রতিদিনের আয় তাদের দিয়ে দিতে হবে যার বিনিময়ে সে কাজ শেষে ৩০ হাজার টাকা পাবে। রাজধানীতে অবস্থানকালে তার থাকাখাওয়ার সব ব্যবস্থা করা হবে। এ পর্যন্ত কোনো সমস্যা ছিল না। সমস্যা শুরু তখনই যখন সিন্ডিকেট পরবর্তী ঈদে সেই ব্যক্তির সঙ্গে চুক্তি করতে যায়। গতবারের আয় মনে রেখে সেই ব্যক্তি ৪০ হাজার টাকা দাবি করলে সমস্যা সৃষ্টি হয় এবং বিষয়টা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ পায়। রাজধানীতে যারা ভিক্ষা করে তারা সবাই ভিক্ষুক নয় এবং তারা এহেন সিন্ডিকেট দ্বারা পরিচালিত। এমন সিন্ডিকেট সৃষ্টি করে যদি বেশুমার অর্থ রোজগার করা যায় তবে মানুষ এখান থেকে সরে আসবে কেন? ফলে দিনে দিনে এ পেশায় ভিড় বাড়ছে। সামাজিক নিরাপত্তার নামে চলমান কর্মসূচি এ বৃত্তির ওপর কোনো প্রভাব ফেলতে পেরেছে বলে মনে হয় না। খুব প্রয়োজন ছিল দেশ থেকে এ পেশা বন্ধ করার উদ্যোগ গ্রহণ। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির মাধ্যমে এ পেশা থেকে মানুষকে সরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা গেলে দেশ ও জাতি উপকৃত হতো। শুধু ঘোষণা দিয়ে ভিক্ষুকমুক্ত জেলা করে কোনো লাভ হয়েছে বলে মনে হয় না।
সরকার সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির বরাদ্দ ও উপকারভোগীর সংখ্যা প্রতি বছর বাড়িয়ে চলেছে। বর্তমান অর্থবছরে সামাজিক নিরাপত্তার মূল ১৮টি কর্মসূচিতে বরাদ্দ ১৭ হাজার ৩৯৮ কোটি ৯১ লাখ টাকা; যার দ্বারা উপকার পাবে ১ কোটি ৯২ লাখ ৮৭ হাজার ৬৬৭ জন। অর্থাৎ জনপ্রতি ৯ হাজার ২০ টাকার কিছু বেশি। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির প্রধান লক্ষ্য অসহায় মানুষের পাশে থাকা। দরিদ্র, বয়স্ক , বিধবা, প্রতিবন্ধী, তৃতীয় লিঙ্গ, অসুস্থ, আহত, অপুষ্টিতে ভোগা মা ও শিশু ইত্যাদির জন্য এ বরাদ্দ কী ভূমিকা রাখতে সক্ষম হচ্ছে তা বিবেচনার মধ্যে আনা প্রয়োজন। যদিও সবাই জানে সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের বরাদ্দ বিশাল কিন্তু এ বিশাল বরাদ্দের মধ্য থেকে অসহায় মানুষের জন্য নগণ্যই। এ বরাদ্দ কতটা উপকারে আসছে তা ভাবনার বিষয়। লক্ষণীয় যে, কর্মসূচির বিশাল বরাদ্দের মধ্যে অবকাঠামো নির্মাণ, অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারীদের পেনশন, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা, চিকিৎসা সহায়তা, সঞ্চয়পত্রের সুদ ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত। তাই প্রকৃত অসহায় মানুষের ভাগ্যে মাথাপিছু প্রাপ্তি যা তা দিয়ে যেখানে জীবন বাঁচানোটাই কঠিন, সেখানে জীবনমান উন্নত করা তো অলীক কল্পনা। তবে এ কথাও ঠিক, শুধু অর্থ সাহায্য করে মানুষকে সংকটমুক্ত করা সম্ভব নয়; এটা সাময়িক ব্যবস্থামাত্র। কিন্তু অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে বর্তমান সময়ে অর্থসহায়তার বিকল্প না থাকায় মাথাপিছু বরাদ্দ বৃদ্ধি জরুরি।
অসহায় মানুষের জন্য বরাদ্দ অর্থ বিতরণ এখন পর্যন্ত দুর্নীতিমুক্ত রাখা যায়নি। এ সামান্য টাকায় ভাগ বসানোর ঘৃণ্য কাজ করতে সংশ্লিষ্টদের লজ্জা লাগে না, হাত কাঁপে না বরং তারা সমাজে দুই কান কাটাদের মতো মাথা উঁচু করে গদিওয়ালা চেয়ারে বসে আছে! কারও কোনো দায়িত্ব নেই, জবাবদিহির প্রশ্ন নেই। কর্মসূচির মধ্যে রাজনীতি ও আমলাতন্ত্র ঢুকে পড়ায় পুরো বিষয়টা দুর্নীতিতে ডুবে আছে। একে মাথাপিছু বরাদ্দের স্বল্পতা, তার ওপর দুর্নীতি ফলে সরকারি এ উদ্যোগ সম্পূর্ণ ব্যর্থ বলা চলে। সাধারণ মানুষের বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় ক্ষমতার বলয় সত্যি অসহায় মানুষের কল্যাণ চায় কি না? কর্মসূচির পরিসর দিনে দিনে বাড়ছে, উপকারভোগীর সংখ্যা বাড়ছে, এলাকা বাড়ছে কিন্তু জবাবদিহি নিশ্চিত করা হচ্ছে না। বরং সরকারের মর্জিমাফিক সময়ে ৩০ টাকার চাল, ১০০ টাকার তেল না দিয়ে এদের জন্য রেশনব্যবস্থা চালু করা হলে উপকারভোগীর সময় ও কষ্ট দুই বেঁচে যেত। কারণ এখানেও যে পুরো বিষয়টা দুর্নীতিমুক্ত এমন দাবির সুযোগ নেই। তবে প্রশ্ন রাখা যায়Ñদেশে কোথায় জবাবদিহি আছে?
আমাদের দেশে যেসব অবকাঠামো নির্মাণ হচ্ছে তার কোনোটারই জীবৎকাল নেই। অথচ প্রতিটি নির্মাণের একটা জীবৎকাল আছে। সে জীবৎকাল শেষ হওয়ার আগেই যদি নির্মাণকাজ নষ্ট হয়ে যায় তাহলে তার দায় সংশ্লিষ্টদের ওপর বর্তানোর কথা। কিন্তু দেশে তা সাধারণ মানুষের ঘাড়ে চাপে। হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ১০০ বছরের বেশি সময় ধরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে; আর ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের ব্রিজগুলোর দম ৩০ বছরেই শেষ হয়ে যাচ্ছে! সাধারণ মানুষের কোনো প্রশ্ন করার অধিকার নেই। দেশ ও জাতির এ ক্ষতি করার জন্য সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী থেকে ঠিকাদার পর্যন্ত সবার শাস্তি হিসেবে পুনর্নির্মাণের সম্পূর্ণ ব্যয় তাদের অর্জিত সম্পদ থেকে নেওয়া হলে জীবৎকালবিহীন অবকাঠামো কাউকে দেখতে হতো না।
সরকার সিন্ডিকেট ভাঙতে পারবে না তা আমাদের এক মন্ত্রী খুব পরিষ্কার বাংলায় জানিয়ে দিয়েছেন। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে তাই নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম আকাশছোঁয়া হলে সরকারের কিছু করার নেই বরং সিন্ডিকেট পণ্য বাজার থেকে উধাও হয়ে যাওয়ার ভয় দেখায়। এদিকে মন্ত্রীরা রাজধানীর বিশেষ বিশেষ জায়গায় প্যারিস-ভেনাসের আদল দেখতে পান। মেয়ররা সিটি করপোরেশনগুলোকে সিঙ্গাপুর তৈরি করতে মরিয়া। দেশ এখন বহু বিষয়ে বিশ্বের রোল মডেল হয়ে গেছে। আমরা বিশ্বে কোটিপতির সংখ্যাবৃদ্ধিতে সেরা। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, টানেল ইত্যাদির মতো মেগা প্রকল্পে দেশ ভরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বিদেশ থেকে খিচুড়ি রান্না, পুকুর কাটা, গ্রাম উন্নয়ন ইত্যাদি শিখে এসে দেশ ও জাতির কল্যাণে নিবেদিত হচ্ছেন আমলারা। শিক্ষার্থীদের আধুনিক মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে নতুন শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে।
দক্ষ জনশক্তি তৈরির জন্য আবালবৃদ্ধবনিতাকে মাত্র জিপিএ-২ পেলেই ভর্তির ব্যবস্থা করে দেওয়া হচ্ছে। মুদ্রাস্ফীতি বাড়ছে, রিজার্ভ কমছে, লাখো কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে, ঋণের পরিমাণ ঊর্ধ্বমুখী তার পরও দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা মজবুত আছে! জনপ্রতিনিধিদের সম্পদ পাঁচ বছর দায়িত্ব পালনের মধ্যে ব্যবসা করে ১০ কোটি ৫০০ কোটিতে উন্নীত হচ্ছে। এত সহজ আয়ের দেশে জনগণ যদি কষ্টে থাকে তাহলে সরকার কিবা করতে পারে? বুঝদার জনগণ তাই দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতি দেখে কেমন আছে এ এক অন্তহীন প্রশ্ন।
এম আর খায়রুল উমাম
সাবেক সভাপতি, ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশ (আইডিইবি)