সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়
প্রকাশ : ৩০ এপ্রিল ২০২৪ ১০:০০ এএম
অস্থিতিশীল বাজার
পরিস্থিতি সাধারণ মানুষকে কতটা চাপে-তাপে রেখেছে নতুন করে এর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ নিষ্প্রয়োজন।
বাজারকে কোনোভাবেই বাগে আনা যাচ্ছে না। ক্রমাগত বাড়তে থাকা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নানারকম পরীক্ষা সত্ত্বেও কীভাবে ব্যর্থ হয়েছে এরই চিত্র উঠে এসেছে
২৯ এপ্রিল প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর প্রধান প্রতিবেদনে। মুদ্রা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন
এনেও মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা থামানো যায়নি। নিকট অতীতে আমরা এই সম্পাদকীয়
স্তম্ভেই বলেছিলাম, মুদ্রানীতির সুফল দৃশ্যমান করাই বড় চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জে যে
সংশ্লিষ্ট সব পক্ষই হেরে গেছে এরও চিত্র উঠে এসেছে প্রতিবেদনে। আমরা এও বলেছিলাম, যখন
কোনো নীতিমালা কিংবা সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, তখন দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায় এর যথাযথ বাস্তবায়ন।
নীতি যত ভালো কিংবা জনকল্যাণমূলকই হোক না কেন এর বাস্তবায়ন না হলে তা অর্থহীন। আমাদের
অভিজ্ঞতায় আছে, সুনীতির বাস্তবায়ন কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যপূরণের পথ সুগম করে। কিন্তু প্রশ্ন
হচ্ছে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে গৃহীত পদক্ষেপ কিংবা নীতি কেন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলো?
আমরা অতীতেও দেখেছি
এবং এখনও দেখছি, বাজার ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি রয়েছে এই অজুহাত দাঁড় করিয়ে বারবার নিজেদের
ব্যর্থতা আড়াল করতে চাচ্ছে আর্থিক নেতৃত্বদানকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংক। আমাদের
অভিজ্ঞতায় আছে, ইতঃপূর্বে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মুদ্রানীতি যে লক্ষ্য নিয়ে প্রণীত
হয়েছিল এর উদ্দেশ্য অনেক ক্ষেত্রেই সফল হয়নি। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, খেলাপি ঋণে লাগাম
টানা ও আর্থিক খাতে সুশাসন নিশ্চিত করার মতো জরুরি বিষয়গুলো অগ্রাধিকার দিয়ে সমন্বিত
প্রয়াসের ওপর জোর দেওয়ার তাগিদও আমরা এই স্তম্ভেই দিয়েছিলাম। সমন্বয়ের ভূমিকায় বাংলাদেশ
ব্যাংককে দৃঢ়ভাবে অবতীর্ণ হওয়ার কথাও আমরা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু দেখা যাচ্ছে,
মুদ্রানীতি ঘোষণার প্রায় চার মাস অন্তিমেও এর কোনোই সুফল দৃশ্যমান হয়নি। ‘সিন্ডিকেট’
শব্দটি আমাদের সমাজে বিশেষ করে বাজারের ক্ষেত্রে বহুল প্রচলিত। অদৃশ্য শক্তি ‘সিন্ডিকেট’-এর
অস্তিত্বের কথা সরকারের অনেক মন্ত্রীই বারবার স্বীকার করেছেন। আবার কোনো কোনো মন্ত্রী
সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়ার ব্যাপারে বক্তব্য রাখতে গিয়ে এমন বক্তব্যও রেখেছেন; যার মাধ্যমে
তাদের অসহায়ত্বের চিত্রই উঠে এসেছে। আমরা স্পষ্টতই মনে করি, আইন এবং সরকারের শক্তির
চেয়ে সিন্ডিকেটের শক্তি কখনও, কোনোভাবেই বড় হতে পারে না। আমরা আরও স্পষ্ট করে বলতে
চাই, বাগডাস যেন হাঁসের ডিম আর খেয়ে না যায়, তা নিশ্চিত করার দায় যাদের তাদের ব্যর্থতা
ঘোচাতেই হবে।
অচ্ছেদ্য সিন্ডিকেট
ভেঙে, মধ্যস্বত্বভোগী এবং সিন্ডিকেটের হোতাদের নিয়ন্ত্রণ মুক্ত করে স্বাভাবিক বাজার
ব্যবস্থা গড়ে তোলার দায় যাদের, তাদের তরফে কোনো অজুহাত সাধারণ মানুষ মেনে নিতে চায়
না। সরবরাহ ব্যবস্থায় ত্রুটি থাকায় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যাচ্ছে
নাÑ অর্থনীতির বিশ্লেষকরা বারবারই এ কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন। আমরা জানি, বাজার ব্যবস্থাপনার
ত্রুটির সমাধান তথা সরবরাহ ব্যবস্থা স্বাভাবিক রাখতে সহায়তা করে রাষ্ট্রের বিভিন্ন
সংস্থা। এই প্রেক্ষাপটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের ব্যর্থতার দায় সংশ্লিষ্ট কারোই এড়ানোর
অবকাশ নেই। আমাদের স্মরণে আছে, ২০২২ সালের জুলাইয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ১২তম গভর্নর হিসেবে
আব্দুর রউফ তালুকদার দায়িত্বভার গ্রহণ করে বলেছিলেন, কার্যকর মুদ্রানীতি গ্রহণের মাধ্যমে
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করবেন। কিন্তু আমরা দেখলাম, লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়ে গত জানুয়ারিতে
ঘোষিত মুদ্রানীতির কাঠামো বদলে ফেলে তা সংকোচনমূলক করা হলো। বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২২-২৩
অর্থবছরে প্রচলিত ব্যাংকগুলোকে ১৩ লাখ কোটি টাকা তারল্য সহায়তা দিয়েছেÑ যা আগের বছরের
তুলনায় প্রায় সাড়ে সাত গুণ বেশি; এও বলা হয়েছে প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর প্রতিবেদনে।
সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক উল্টো কাজ করায় মূল্যস্ফীতি কমেনিÑ এই
বক্তব্য অর্থনীতিবিদদের।
আমরা জানি, মূল্যস্ফীতি
নিয়ন্ত্রণের জন্য উৎপাদন বাড়ানো যেমন জরুরি, তেমনি সরবরাহ ব্যবস্থায় সব প্রতিবন্ধকতা
দূর করে বাজার ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা সমভাবেই গুরুত্বপূর্ণ। দেশে কর্মহীন
মানুষের সংখ্যা বর্তমানে প্রায় ৭৮ শতাংশ। এ অবস্থায় সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি আত্মহত্যার
শামিলÑ এই বক্তব্য বাংলাদেশ ব্যাংকেরই সাবেক এক গভর্নরের। সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণে
দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক গৃহীত সিদ্ধান্ত এবং বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নানামুখী
গলদ রয়েছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্য সামনে রেখে অর্থনীতিবিদদের পরামর্শ কতটা
আমলে নেওয়া হয়েছে; প্রশ্ন আছে এ নিয়েও। আমরা এও জানি, মূল্যস্ফীতির অভিঘাতে শুধু নিম্ন
আয়ের মানুষই নয়, এখন প্রায় সব শ্রেণির মানুষের ওপরই এর কশাঘাতের বিরূপ ফল দৃশ্যমান।
বাজারে নাটাই ঘোরায় যে দুষ্টচক্র; এর হোতারা অনেক বেশি বলবান। আমরা মনে করি, সর্বাগ্রে
এর প্রতিবিধান নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে, সুদহারে হেরফের ঘটিয়ে কিংবা আমদানি ক্ষেত্রে
সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়ে এবং আমদানিকারকদের প্রণোদনা দিলেও কার্যত কোনো সুফল মিলবে না।
আমরা স্পষ্টতই মনে করি, সরকারের সামনে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। এক্ষেত্রে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়সহ পক্ষগুলোকে শুধু বাজারের তদারকি-নজরদারি বাড়িয়েই দায় শেষ করার অবকাশও নেই। আর্থিক খাতে বিদ্যমান বিশৃঙ্খলা নিরসন করে খেলাপি ঋণ আদায়ে নির্মোহ কঠোর অবস্থানের কোনো বিকল্প নেই। এক কথায় সর্বাগ্রে প্রয়োজন সুশাসন। আমরা বারবারই বলছি, সুশাসন নিশ্চিত হলে কদাচারের ছায়া স্বাভাবিকভাবেই দূরীভূত হবে এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে শুধু আর্থিক খাতেই নয়, সব খাতেই শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হবে। দুর্বল বিপণনব্যবস্থা, অসাধুদের বিরুদ্ধে আইনানুগ পদক্ষেপ গ্রহণ ইত্যাদি বিষয়েও আমরা ইতোমধ্যে বহুবার তাগিদ দিয়েছি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, সিন্ডিকেটের হোতাদের লোমশ হাতের থাবায় সবই যেন উবে গেছে। বাজার নিয়ন্ত্রণে দায়িত্বশীলরা কথা বলেছেন যত, কাজ করেননি এর কিয়দংশও; বিদ্যমান বাস্তবতা এরই সাক্ষ্যবহ। আমরা প্রত্যাশা করি, বাংলাদেশ ব্যাংক অসাফল্যের খতিয়ান ঘুচিয়ে ব্যর্থতার বৃত্ত ভেদ করে সাফল্যের আলো ছড়িয়ে জনজীবনে স্বস্তি ফেরাতে সক্ষমতার পরিচয় দেবে, বিলম্বে হলেও।