× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

সম্পাদকীয়

কিশোর গ্যাং কি সর্বনাশের সর্বনাম হয়ে দাঁড়াল

সম্পাদকীয়

প্রকাশ : ২৯ এপ্রিল ২০২৪ ১০:০২ এএম

কিশোর গ্যাং কি সর্বনাশের সর্বনাম হয়ে দাঁড়াল

যেকোনো রাষ্ট্র কিংবা সমাজের বড় সম্পদ যৌবন তথা তারুণ্যের অপরিমেয় শক্তি। এই তারুণ্যের পূর্বভাগই কিশোর। তারুণ্যের বৈশিষ্ট্য, পরিবর্তনের ধারা সৃষ্টি করা এবং তারুণ্যের শৌর্যদীপ্ত ভূমিকাই সমাজের অগ্রযাত্রা ত্বরান্বিত করে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, এই ভূখণ্ডের প্রতিটি গৌরবময় অর্জনের সার্থক রূপকার তরুণ সমাজ। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীন বাংলাদেশেও প্রতিটি গণতান্ত্রিক-সাংস্কৃতিক-অধিকার আদায়ের আন্দোলন-সংগ্রামে তারুণ্যের রয়েছে গৌরবদীপ্ত ভূমিকা। কবি হেলাল হাফিজ লিখেছেন, ‘এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাবার শ্রেষ্ঠ সময় তার…’। এই যুদ্ধ মানে নিশ্চয় কারও ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা নয়, এই যুদ্ধ অন্যায়-অসত্য-অনিয়মের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। আজকের কিশোররাই আগামীর তারুণ্য।

যে তারুণ্যের এত গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা ইতিহাসে বিস্তৃত, সেই তারুণ্যের পূর্বভাগ আজকের কিশোরদের একাংশ মূল্যবোধের অবক্ষয়ের গ্রাসে আজ আমাদের সামনে কতটা ভয়ংকর হয়ে উঠেছে এরই উদ্বেগজনক চিত্র উঠে এসেছে ২৮ এপ্রিল প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর একাধিক প্রতিবেদনে। ‘ছোট ডনরাই এখন এলাকার বড় ত্রাস’ শিরোনামের প্রতিবেদনের গর্ভে যে চিত্র উঠে এসেছে তা নিঃসন্দেহে দুর্ভাবনার। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেপরোয়া হয়ে উঠেছে কিশোর গ্যাং, বিস্তৃত হচ্ছে অপরাধের পরিসর। কিশোর অপরাধীদের এখন মাদক ও অস্ত্র ব্যবসা, চাঁদাবাজি, দখল এবং টার্গেট কিলিংয়ে জড়িত হতে দেখা যাচ্ছে এবং এর বেশিরভাগের নেপথ্যেই রয়েছে রাজনৈতিক ‘বড়ভাই’দের মদদ।

ভিন্ন একটি প্রতিবেদনে ডিএমপি কমিশনারের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে ঢাকার মিরপুর, মোহাম্মদপুর, যাত্রাবাড়ী ও উত্তরা এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের দাপট অনেক বেশি। অন্য আরেকটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চট্টগ্রামে ডাক্তার কোরবান আলী হত্যা মামলার সাক্ষীদের ভয়ভীতি প্রদর্শন করছে কিশোর গ্যাং। একই সঙ্গে প্রশ্ন উঠেছে, চট্টগ্রাম শহরে দাপিয়ে বেড়ানো কিশোর গ্যাং সদস্যদের পুলিশ ধরছে না কেন। প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর শীর্ষ প্রতিবেদনের পার্শ্ব প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাজধানীসহ সারা দেশে কিশোর অপরাধীদের তালিকা তৈরি করছে পুলিশ। আরও বলা হয়েছে, এলাকাভিত্তিক কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের নাম ডেটাবেজে অন্তর্ভুক্ত করার পর তাদের কঠোর নজরদারির আওতায় আনা হবে। কিন্তু আমাদের প্রশ্ন, অনেক আগেও আমরা শুনেছি এখনও তাই শুনছি এবং প্রকৃতপক্ষে ‘হবে’, ‘হচ্ছে’র জটাজাল ছিন্ন হবে কবে?

‘তারুণ্যের প্রত্যেক আঘাতে কম্পমান উর্বর-উচ্ছেদ/অশরীরী আমি আজ তারুণ্যের তরঙ্গের তলে সমাহিত উত্তপ্ত শয্যায়/ক্রমাগত শতাব্দীর বন্দি আমি অন্ধকারে খুঁজে ফিরি/ অদৃশ্য সূর্যের দীপ্তি উচ্ছিষ্ট অন্তরে…।’ গদ্য-পদ্য কিংবা গীতিকাব্যে তারুণ্যকে এভাবেই বর্ণনা করেছেন, কবি-সাহিত্যিকরা। কিন্তু এমন প্রত্যাশার যবনিকাপাত ঘটে আমরা যখনই দেখি বিপথগামী কিশোরদের বেপরোয়ানা-উচ্ছৃঙ্খলতায় সমাজে-পরিবারে ক্রমাগত ক্ষত সৃষ্টি হচ্ছে। সঙ্গত কারণেই এই প্রেক্ষাপটে অনুসন্ধানের তাগিদ উঠে আসে জীবনের কেন এমন ক্ষয়? ইতঃপূর্বে প্রতিদিনের বাংলাদেশসহ সহযোগী সংবাদমাধ্যমে বহুবার উঠে এসেছে অপরাজনীতির ধারক-বাহকদের পৃষ্ঠপোষকতায় সম্ভাবনাময় অনেক জীবন অপরাধীর কাতারভুক্ত হচ্ছে। বিভিন্ন মহল থেকে বহুবার এ অভিযোগও উত্থাপিত হয়েছে, সমাজের এ বিবর্ণ চিত্র নষ্ট রাজনীতির বিনষ্ট সংস্কৃতির বিরূপ ফল। কিশোর চক্রগুলো গ্যাংয়ে রূপান্তরিত হওয়ার প্রেক্ষাপট কীভাবে তৈরি হয়েছে, ক্রমেই কীভাবে এর পরিসর বিস্তৃত হচ্ছে এবং কীভাবে কিশোর গ্যাং বেপরোয়া হয়ে উঠছেÑ এই তথ্যগুলো সংবাদমাধ্যমে অনুসন্ধানে স্পষ্টরূপে বারবার উঠে আসার পরও কেন এই অবক্ষয়ের স্রোত ঠেকানো যাচ্ছে না, আমরা এই প্রশ্ন সরকার, প্রশাসন সমান্তরালে রাজনীতির নীতিনির্ধারকদের কাছেও রাখতে চাই। আমরা মনে করি, কারোরই দায় এড়ানোর অবকাশ নেই। ‘গ্যাং-কালচার’ ভয়ের শাসনের প্রতিধ্বনি এবং গভীর সামাজিক ও প্রজন্মের এই ব্যাধির নিরাময় শুধু যে আইনানুগ ব্যবস্থায় সম্ভব নয়, এর জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গীকারও, এ কথা আমরা নিকট অতীতেও এই সম্পাদকীয় স্তম্ভেই লিখেছি। কিন্তু পরিস্থিতি এখন যে পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে তাতে আরও যুক্ত করে বলতে হয়, সর্বনাশের সর্বনাম হয়ে ওঠা কিশোর গ্যাং দমনে এবং তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে রাষ্ট্রের সব পক্ষের যূথবদ্ধ প্রয়াসের বিকল্প নেই। পরিবার থেকে শুরু করে শিক্ষাঙ্গন এবং সমাজের স্তরে স্তরে কিশোরদের দুরাচারী হয়ে ওঠার পথ রুদ্ধ করার সময় এখনও শেষ হয়ে যায়নি, আমরা এ কথাটিও স্মরণ করিয়ে দিতে চাই।

ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টার যে শহরটি শিল্প-শ্রমিকের শহর বলে পরিচিত সেখানে উনিশ শতকের মাঝামাঝি কিশোর গ্যাংয়ের দাপট ভয়াবহতার সৃষ্টি করেছিল। শেষ পর্যন্ত এর নিরসনে ব্যাপকভাবে প্রশাসনিক উদ্যোগের পাশাপাশি সামাজিক উদ্যোগ নেওয়া হয় এবং শহরজুড়ে তরুণদের বিনোদনের জন্য উর্বর ক্ষেত্র তৈরি করা হয়েছিল। সেই ম্যানচেস্টারে একপর্যায়ে ফুটবলের উন্মাদনায় দূর হলো সমাজের অন্ধকার। আর এর পরে সব অংশই শুধু ইতিহাস। এই প্রেক্ষাপটে আমরা আমাদের বিদ্যমান পরিস্থিতির আলোকে আবারও তাগিদ দিই, যথাযথ প্রশাসনিক ব্যবস্থার পাশাপাশি অনেকটাই রাজনৈতিকভাবে সৃষ্ট এই ক্ষত উপশমে মনোযোগ বাড়ানো হোক। নেওয়া হোক বহুমুখী সামাজিক উদ্যোগ। ক্রীড়া ও সংস্কৃতির অনুশীলনসহ নানাবিধ উদ্যোগ নেওয়া হোক যাতে বিপথগামীরা অন্ধকার কাটিয়ে আলোর সন্ধান পায়।

রাজনৈতিক অঙ্গন কিংবা সমাজে যেসব বলবান হীন স্বার্থবাদীরা নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থকরণে সম্ভাবনাময় জীবনগুলোকে অপব্যবহার করে সর্বনাশের দিকে ঠেলে দিচ্ছে তাদের চিহ্নিত করা হোক। সর্বাগ্রে তাদের অপরাধের প্রতিবিধান নিশ্চিত করা জরুরি। সমাজ ও রাষ্ট্রের পাশাপাশি পরিবারকেও প্রতিষ্ঠান হিসেবে যথাযথ ভূমিকা রাখতে হবে। পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী প্রত্যেকটি বাহিনীর দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। মূলত কিশোর গ্যাং একসময় পাশ্চাত্য সমাজে আলোচনায় থাকলেও আমাদের সমাজে এর ক্রমবর্ধমান অপচ্ছায়ার পরিসর বৃদ্ধির অনেক কারণের মধ্যে বৈষম্যও অন্যতম একটি কারণ। আমরা একই সঙ্গে রাজনীতিকদের দায়বদ্ধতা ও শুদ্ধাচারের বিষয়টিও স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। কোনো রাষ্ট্র কিংবা সমাজে যদি ভবিষ্যতের আলোকবর্তিকা হিসেবে অভিহিত কিশোররা অনাচার-দুরাচার-কদাচারের সংক্রমণে সংক্রমিত হয় তাহলে সেই রাষ্ট্র ‍কিংবা সমাজ বিকশিত তো নয়ই, উপরন্তু শান্তিপ্রিয় মানুষের বসবাসের অনুপযোগী হয়ে ওঠার সব পথ সুগম হয়। এমনটি কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না।

প্রশাসনের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের তো বটেই জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে রাজনীতিকদেরও। কিশোর গ্যাং যাতে দুরারোগ্য ব্যাধি হয়ে না দাঁড়ায় তা নিশ্চিত করার সময় এখনও শেষ হয়ে যায়নি। মানবিক মূল্যবোধের চর্চা ও সমাজে সৌহার্দ্য-সংস্কৃতি-ঐক্য ও শৃঙ্খলা বজায় রাখায়ও সমগুরুত্ব দিতে হবে। যেখান থেকে পচনের শুরু ‘দাওয়াই’ দিতে হবে সেখানে আগে। পরিবারের অভিভাবকদের নজরদারি বাড়াতে হবে। স্বল্পায়ু কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য তারুণ্যের জয়গান গেয়ে লিখেছিলেন, ‘এদেশের বুকে আঠারো নেমে আসুক’। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তারুণ্যের বন্দনা গেয়েছেন। সেই তারুণ্যের ক্ষয় আমরা কোনোভাবেই মেনে  নিতে পারি না। 

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা