সাম্প্রদায়িকতা
মোস্তফা হোসেইন
প্রকাশ : ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ১৪:২৪ পিএম
ফরিদপুরের মধুখালীতে মন্দিরে মূর্তির পরনের শাড়ি আগুনে
পুড়ে গেছে। শাড়ি পোড়া ছাই চাপা পড়ার আগেই আগুন জ্বলে উঠেছে স্থানীয় অধিবাসীদের
আবেগে। বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে ছাই চাপা দেওয়া ক্ষোভের। ক্ষোভের আগুনে শেষ হয়ে গেছে দুটি
তরতাজা প্রাণ। এরপরও সংঘাত-সংঘর্ষ হয়েছে, হতাহতের মর্মস্পর্শী ঘটনা ঘটেছে। বিজিবি
মোতায়েনের খবরও জানা যায়। আগুন কেউ লাগিয়েছে কি-না কিংবা প্রদীপ থেকে বাতাসে
ছড়িয়েছেÑকোনোটাই নিশ্চিত হয়নি মন্দির কর্তৃপক্ষ। আগুন লাগার কিছু সময়ের মধ্যেই
অসংখ্য মানুষ ওখানে জড়ো হয়ে পাশে থাকা নির্মাণশ্রমিকদের ওপর হামলা করে।
নির্মাণশ্রমিকদের দুজন গণপিটুনিতে নিহত হন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যাপক
তৎপরতা শুরু হয় ঘটনাসূত্রে। পরিণতি, নিবন্ধ লেখাকালে মধুখালীর ডুমাইন ইউনিয়নের
পঞ্চপল্লীসহ আশপাশ গ্রামগুলো পুরুষশূন্য গ্রেপ্তার আতঙ্কে।
এলাকাবাসী এ ঘটনার জন্য কোনো কারণে পাশের নির্মাণশ্রমিকদের সন্দেহ করে তাদের
ওপর চড়াও হয়। তারা কি প্রকৃতই দোষী? প্রকাশিত সংবাদগুলোর কোথাও এমন ইঙ্গিত নেই
নির্মাণশ্রমিকরা মন্দিরে আগুন লাগিয়েছে। তাহলে কি এটাই বলতে হবে, গণরোষে পড়ে
নির্দোষ দুটি প্রাণ চলে গেছে? মনে রাখা প্রয়োজন, এ ধরনের উত্তেজনায় নির্দোষ মানুষও
ভোগান্তিতে পড়ে, প্রাণহানির ঘটনাও ঘটে। ফরিদপুরের ঘটনায় নিহতরা কি তেমন গণরোষের শিকার
হয়েছেন? তবে এমন ঘটনার পেছনে অবশ্যই কারণ থাকে। কারণ হতে পারে অভিযুক্ত ব্যক্তি
কিংবা ব্যক্তিরা সত্যিকারভাবে অপরাধে জড়িত। অথবা সন্দেহবশত আক্রমণের শিকার। আবার
ওই ছাই চাপা দেওয়া ক্ষোভের কথা বলছিলাম, সে রকমও হতে পারে।
একটা বিষয় স্পষ্ট হওয়া দরকার, এ নির্মাণশ্রমিকরা কি ঘটনার আগে স্থানীয় কাউকে
উত্ত্যক্ত করেছিলেন? এটা অবশ্য তদন্তসাপেক্ষ বিষয়। তদন্তকারীরা এমন কিছু আগে ঘটেছে
কি না তলিয়ে দেখবেন। প্রকাশিত সংবাদের সবকটিতেই বলা হয়েছে, কে আগুন লাগিয়েছে কেউ
জানে না। তবে একটা ক্লু আছে, তা হচ্ছেÑওইদিন সান্ধ্যপ্রদীপ জ্বালানো হয়েছিল তাদের
নিত্য পুজোর অংশ হিসেবে। মূর্তির গায়ের শাড়ি যদি ওই প্রদীপের ওপর পড়ে তাহলে তা
পুড়ে যেতেই পারে। এ ক্ষেত্রেও কেউ নিশ্চিত নন আসলে কীভাবে আগুন লেগেছে। প্রশ্ন
হচ্ছেÑকেউ যখন আগুন লাগার কারণ সম্পর্কে নিশ্চিত নন, তার পরও নির্মাণশ্রমিকদের ওপর
ক্ষোভ হওয়ার কারণ কী?
ফরিদপুরের মানুষ কেন এত উত্তেজিত হয়ে পড়ল? সে ক্ষেত্রে
একটু পেছন ফিরে তাকাতে হবে। তারা শুধু তাদের মূর্তির শাড়ি পুড়ে গেছে, এ কারণেই
উত্তেজিত হয়নি। তারা উত্তেজিত হয়েছে দেশে আরও এমন ঘটনার সূত্র ধরে। তাদের সামনে
প্রমাণ আছে, এ দেশে সংখ্যালঘুরা নির্যাতনের শিকার হলে এর প্রতিকার কিংবা বিচার হয়
না। হাতেনাতে ধরা পড়লেও অভিযুক্ত বিচারবহির্ভূত থাকে। শুধু তাই নয়, ক্ষতিগ্রস্তরাই
উল্টো হয়রানির মুখে পড়ে। এমনকি কারাগারেও যেতে হয় ভুক্তভোগীকে। এ মানুষগুলোর সামনে
রামু, শাল্লা, নাসিরনগর, কুমিল্লা, কোটালীপাড়ার মতো অসংখ্য ঘটনা জ্বলজ্বল করে
ভাসছে। আমাদের স্মরণে আছে, কুমিল্লায় মূর্তির পায়ে কুরআন শরিফ রাখা কেন্দ্র করে চারজনের
প্রাণ গেল, সারা দেশে দুর্গাপূজা পণ্ড হলো, আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের
মধ্যে। সঙ্গত কারণেই বিচার প্রত্যাশা করছিলেন ভুক্তভোগীরা। ২০২১ সালের এ ঘটনার
বিচার দ্রুতবিচার ট্রাইব্যুনালে হবে এমন ঘোষণা তৎকালীন আইনমন্ত্রী দিয়েছিলেন।
কিন্তু তিন বছরেও এর বিচার শেষ হয়নি!
অনেকে বিস্মৃত হলেও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মনে দাগ
কেটে আছে বিভিন্ন ঘটনা। যেমন ২০১৪ সালে যশোরের অভয়নগরে শত শত বাড়ি,
মন্দির, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা, লুটপাট; ২০১৬ সালের ৩০ অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার
নাসিরনগরে, ২০১৭ সালের ১০ নভেম্বর রংপুরের গঙ্গাচড়ায়, ২০২১ সালের ১৩ অক্টোবর কুমিল্লায়
হিন্দুধর্মাবলম্বীদের ওপর হামলা, গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ, সুনামগঞ্জের শাল্লাসহ বিভিন্ন
জায়গায় নানা সময়ে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনা।এক যুগ পেরিয়ে
গেছে রামুতে বুদ্ধমূর্তি ভাঙার। ওই ঘটনার বিচারও আজ পর্যন্ত শেষ হয়নি। শেষ হয়েছে
কি নাসিরনগরে শত শত হিন্দু বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়ার বিচার? সুনামগঞ্জের শাল্লায়
সংখ্যালঘু নির্যাতন ঘটনারও বিচার শেষ হয়নি এখনও। আমাদের সামাজিক শিক্ষা
সাম্প্রদায়িকতায় পূর্ণ, একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সঙ্গে অন্য সম্প্রদায়ের কথাবার্তা
চললেও সামাজিক সংযুক্তি নেই। যেমন একই দেশের নাগরিক একই ভাষায় কথা বলি, একই
দোকানের পণ্য কিনি, কিন্তু এক সম্প্রদায়ের সঙ্গে আরেক সম্প্রদায়ের বিয়ে নিষিদ্ধ! আমরা
রাষ্ট্রীয়ভাবে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা বলি কিন্তু সম্প্রীতি স্থাপনে রাষ্ট্র
কিংবা সমাজের কোনো ভূমিকা নেই। যখন সাম্প্রদায়িক নিপীড়ন হয়, আমাদের প্রশাসন লোক
দেখানো কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করে দায়িত্ব শেষ করে।সাম্প্রদায়িকতাবাদে সৃষ্ট নির্যাতন-নিপীড়নের
শাস্তি নিশ্চিত করাই শুধু রাষ্ট্রের দায়িত্ব নয়। সম্প্রীতি রক্ষায় মূল ভূমিকাও
পালন করতে হবে রাষ্ট্রকেই। দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, সেদিকে কোনো উদ্যোগ লক্ষ করা যায়
না।
ধর্মীয় বিদ্বেষমূলক প্রচারণা বন্ধে কার্যকর কোনো আইন আছে বলে জানি না। বিশেষ করে সমাজমাধ্যমে যে হারে সাম্প্রদায়িকতা ছড়ানো হচ্ছে তা বন্ধ করার কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। ইউটিউবে প্রচারিত ওয়াজগুলোর অনেকটিই আছে যেখানে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়ায়। সরাসরি আক্রমণ করা হয় সংখ্যালঘুদের। এ বিদ্ধেষ যে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করে তাই নয়, সংখ্যাগুরুদেরও যে আঘাত হানবে না তা-ও বলা যায় না। সংখ্যালঘুরা এসব শুনে নিজেরা যেমন নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে তেমন তাদের মধ্যে ক্ষোভেরও সৃষ্টি হয়। এ মুহূর্তে সমাজমাধ্যমে সাম্প্রদায়িকতা ছড়ানোর পথ বন্ধ করার উদ্যোগ সরকারকেই নিতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার লালন ও চর্চাই মুক্তির একমাত্র পথ। দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন টেকসই ধারায় নিয়ে যেতে হলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা অত্যন্ত জরুরি। এ জন্য সরকার, বুদ্ধিজীবীসমাজকে বড় ভূমিকা রাখতে হবে। যদি তাতে সফল হওয়া না যায় তাহলে ৩০ লাখ শহীদের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশের জন্মওয়াদা ভঙ্গের অপবাদই শুধু নয়, সামাজিক অশান্তিও রোধ করা সম্ভব হবে না।