ব্যাংক একীভূতকরণ
ড. নীলাঞ্জন কুমার সাহা
প্রকাশ : ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ১১:২২ এএম
আপডেট : ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ১১:২৩ এএম
ড. নীলাঞ্জন কুমার সাহা
দেশের ব্যাংক খাত নিয়ে নেতিবাচক আলোচনা দীর্ঘদিনের। অভিযোগ আছে, রাজনৈতিক বিবেচনায় যেসব ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল সেসব ব্যাংকই অধিকতর দুর্বল হয়ে পড়েছে। বিদ্যমান সংকট কাটাতে সবল ব্যাংকের সঙ্গে দুর্বল ব্যাংক একীভূত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ব্যাংকিং খাতে আর্থিক প্রতিষ্ঠান একীভূতকরণ নতুন ধারণা নয়। এমন একীভূতকরণের ঘটনা ঘটেছে। উল্লেখ্য, ২০২২ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকে ধস নামলে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক এবং সরকার আমানতের বীমা দিয়ে আপৎকালীন ব্যাংকার হিসেবে কাজ করেছে। কোনো একটি ব্যাংক যখন আর তার কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছে না তখন নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার এ ভূমিকা ইতিবাচক নিঃসন্দেহে।
সবচেয়ে বড় কথা, আমানতকারীরা যেন এ ক্ষেত্রে
কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হন সেদিকে বিশেষ মনোযোগ ও সঠিক নীতিমালার বাস্তবায়ন কার্যকর
ভূমিকা রেখেছে। এমনকি আমাদের পাশের ভারতে ১৭টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক একীভূত করে ১০টি
ব্যাংক বানানো হয়। এর সুফলও মিলেছে। কিন্তু আমাদের দেশের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। এখনও ব্যাংকিং
খাত সর্বজনীন করে তোলা যায়নি। ব্যাংক ব্যবহারে কিংবা ব্যাংকিং ব্যবস্থা সবার কাছে সহজলভ্য
করে তোলার কাজটিও সহজভাবে সম্পন্ন করা যায়নি। ব্যাংক সম্পর্কে জনসাধারণের মনে যে চিত্র
রয়েছে তা অনেক ক্ষেত্রেই নতুন আমানতকারী কিংবা ব্যবহারকারীকে অনুৎসাহিত করছে।
দুর্বল ব্যাংকের কোনোটিতে ধস নামলে সেটি টিকিয়ে
রাখতে চাওয়া এ ক্ষেত্রে সঠিক না-ও হতে পারে। দুর্বল ব্যাংকগুলোর উচ্চ খেলাপি ঋণ, কম
দক্ষতা ও সুশাসনের অভাব একীভূত করলেই সমাধান হবে এমন নয়। যদি দুর্বল ব্যাংকগুলোর বিদ্যমান
সমস্যার সমাধান করতেই হয় তাহলে অধিগ্রহণকারী ব্যাংককে ব্যবসায়িক নীতিতে পরিবর্তন আনতে
হবে এবং সমস্যাযুক্ত শাখাগুলোয় সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে বাড়তি উদ্যোগ নিতে হবে। কাজটি
জটিল এবং দীর্ঘমেয়াদি। এ কাজটি করতে গেলে অধিগ্রহণকারী ব্যাংকের মুনাফা ক্ষতিগ্রস্ত
হতে পারে, এমন আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কারণ দুর্বল ব্যাংক অধিগ্রহণের পর সংকট
সমাধানে ব্যাংকের ব্যবসায়িক নীতিমালায় পরিবর্তনের পাশাপাশি বাড়তি বিনিয়োগ শুরু করলে
ব্যাংকগুলো ভালো লভ্যাংশ দিতে পারবে না। আর এ পরিবর্তনের ফলে ক্ষতির শিকার হবেন বিনিয়োগকারীরা।
একীভূত অথবা অধিগ্রহণের নির্দেশনায় এবং এর বাস্তবায়নে আমানতকারী ও ব্যাংক কর্মকর্তা-কর্মচারী- এ
দুটি পক্ষ কিছুটা হলেও তটস্থ থাকনে। আমানতকারীরা তাদের জমাকৃত আমানতের বিষয়টি নিয়ে
দুশ্চিন্তায় থাকবেন। এখন পর্যন্ত ১০টি ব্যাংকের একীভূত হওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। পাঁচটি
সরকারি, পাঁচটি বেসরকারি। সরকারি পাঁচটি হলো সোনালী ব্যাংক, বিডিবিএল (বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট
ব্যাংক), কৃষি ব্যাংক, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক ও বেসিক ব্যাংক। সরকারি ব্যাংকগুলোর
মধ্যে সোনালীর সঙ্গে বিডিবিএল, কৃষি ব্যাংকের সঙ্গে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক বা
রাকাব একীভূত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। আর বেসরকারি যে পাঁচটি ব্যাংকের একীভূত করার সিদ্ধান্ত
হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে এক্সিম ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, ইউসিবিএল, ন্যাশনাল ব্যাংক ও পদ্মা
ব্যাংক।
একীভূত করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি
নীতিমালাও জারি করেছে। কিন্তু ১৭ এপ্রিল প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর শীর্ষ প্রতিবেদনে বলা
হয়েছে, ব্যাংকের ভুল শোধরাতে গিয়ে আবার ভুল করা হয়েছে। যেমন যারা ব্যাংকের অর্থ লোপাট
করেছেন তাদের শাস্তির ব্যবস্থা নীতিমালায় নেই অথচ তাদেরই ফের পরিচালক হওয়ার সুযোগ রাখা
হয়েছে। সমস্যা হচ্ছে, ব্যাংক একীভূত করার প্রক্রিয়া নিয়ে ব্যাংক খাতে ইতোমধ্যে আতঙ্ক
ছড়িয়ে পড়েছে। দুর্বল সূচকের অধিকারী ব্যাংকগুলোর পাশাপাশি কিছুটা ভালো তালিকায় থাকা
ব্যাংকগুলোও অস্বস্তিতে পড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে কখন কাকে ডেকে কোনো দুর্বল ব্যাংকের
দায়িত্ব নিতে বলা হবে, তা আগে থেকে জানানো হচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংক এখন এক সিদ্ধান্তে
জানিয়েছে, আপাতত স্বেচ্ছায় নতুন করে আর কোনো ব্যাংক একীভূত হবে না। এ সিদ্ধান্ত নিয়েও
প্রশ্ন উঠেছে।
তীব্র তারল্য সংকট ও সুশাসন ঘাটতিতে থাকা কিছু
ব্যাংক একীভূত করার প্রক্রিয়ার বাইরে রয়ে গেছে। এসব সমস্যার সমাধান না করলে একীভূত
করার প্রক্রিয়ার সুফল পাওয়া যাবে না। অন্যদিকে একীভূতকরণের লক্ষ্যে যে নীতিমালা তৈরি
করা হয়েছে সেটা মোটেই যুক্তিসঙ্গত নয় এবং এ ক্ষেত্রেও সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক নির্মোহ
থাকতে পারেনি এ অভিযোগও উঠেছে। শুধু একীভূত করে ব্যাংক খাত ভালো করা সম্ভব নয়। ঋণখেলাপি,
দুর্নীতিবাজ ও অনিয়মে যুক্ত পরিচালক ও কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে হবে।
জোর করে ভালো ব্যাংকের সঙ্গে খারাপ ব্যাংক একীভূত করে দিলে ভালো ব্যাংকও খারাপ হয়ে
যেতে পারে। এটা সংক্রামক ব্যাধির মতো পুরো ব্যাংক খাতে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
বেসিক ব্যাংক, বিডিবিএল, রাকাব, পদ্মা, ন্যাশনাল
ব্যাংকের অবস্থা একেবারেই নাজুক। বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির বিষয়টি নানা মহলে আলোচনার
ঝড় তুললেও এর কোনো প্রতিবিধান নিশ্চিত হয়নি। কথা ছিল সিটি ব্যাংকের সঙ্গে যাবে বেসিক
ব্যাংক। ১৮ এপ্রিল প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ প্রকাশÑবেসরকারি সিটি ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত
না হওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ। তাদের
এ সিদ্ধান্তের ব্যাপারে কয়েকটি বিষয় ভাবা জরুরি। প্রথমেই বলেছি, ব্যাংক একীভূত করার
ক্ষেত্রে সবল ব্যাংক-সংশ্লিষ্টদের কিছু দুর্ভাবনা থাকে; একই সঙ্গে দুর্বল ব্যাংকগুলোও
এক ধরনের অস্তিত্বসংকটে ভোগে। ফলে তাদের এমন সিদ্ধান্ত মন্দ কিছু নয়। মনে রাখা জরুরি,
খেলাপি ঋণ, অর্থ পাচার ইত্যাদি আমাদের অর্থনীতির জন্য সংকট ক্রমেই প্রকট করে তুলছে।
খেলাপি ঋণ আদায়ে সরকারের তরফে বারবার অঙ্গীকার ব্যক্ত হয়েছে বটে কিন্তু কার্যত কোনোই
সুফল দৃশ্যমান হয়নি।
অর্থ পাচার রোধেও একই অঙ্গীকার ব্যক্ত হয়েছে।
এ ক্ষেত্রেও একই চিত্র পরিলক্ষিত হয়। এর প্রধান কারণ ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান তদারকি
কিংবা নজরদারির অধীনে রাখবে এসব প্রতিষ্ঠান যেসব নীতিমালা তৈরি করে সেখানে কিছু দ্বিধামূলক
নিয়ম থাকে। বিশেষত পরিচালকদের পাঁচ বছর পর পর্ষদে ফেরার যে সুযোগ রাখা হয়েছে অনেক অর্থনীতিবিদই
বলেছেন তা এক ধরনের দায়মুক্তি। আর্থিক খাতে সুশাসনের কথা বা প্রতিশ্রুতি সমাধান হতে
পারে না। অর্থনীতি চলে কার্যক্রম ও গতিশীলতার ভিত্তিতে। প্রতিশ্রুতি বা বক্তব্য এখানে
গুরুত্বপূর্ণ নয়। তবে ব্যাংকিং খাতে নীতিমালা প্রণয়নের ক্ষেত্রে সুষ্ঠু কার্যক্রম ও
গতিশীলতার এক ধরনের সমন্বয় গড়ে তোলা জরুরি। যদি তা করা না যায় তাহলে সংকট দেখা দেবে।
আর্থিক খাতে বিশৃঙ্খলা নতুন নয়।
শৃঙ্খলা ফেরানোর চেষ্টা যে হয়নি তা-ও নয়। কিন্তু এই চেষ্টা কতটা নির্মোহ ও রাজনৈতিক
চিন্তার বাইরে হয়েছে এ নিয়ে প্রশ্ন আছে। আর্থিক খাত তো বটেই, জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট যেকোনো
ব্যাপারে রাজনৈতিক বিবেচনার ঊর্ধ্বে ও মোহহীন থাকতেই হবে। আর্থিক খাতে অতীতে যেমন সাম্প্রতিকও
তেমন কিছু ভুল নীতির অনুসরণে সুযোগসন্ধানীরা অপতৎপরতা কিংবা নিজেদের উদরপূর্তির পথ
পায়। এ বিষয়গুলো যেন গুরুত্বের সঙ্গে
আমলে থাকে। আমরা দেখেছি, কিছুদিন আগে গোপালগঞ্জে রূপালী ব্যাংকের একটি শাখায় অসাধু
কর্মকর্তাদের যোগসাজশে গ্রাহকের বিপুল অঙ্কের টাকা নয়ছয় হয়েছে। এমন ঘটনা এবারই যে প্রথম
তা-ও নয়। প্রশ্ন হচ্ছেÑব্যাংক খাতের মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে যেখানে মানুষের অর্থ
গচ্ছিত থাকে সেখানে দুর্নীতিবাজরা এমন কেলেঙ্কারি করার সুযোগ পান কী করে? এখানেও সেই
একই প্রসঙ্গ চলে আসে। কিন্তু ভবিষ্যতে যাতে এমনটি আর না ঘটে তা নিশ্চিত করাই বড় চ্যালেঞ্জ।
বাংলাদেশ ব্যাংক এসব ক্ষেত্রে সুষ্ঠুভাবে তদারকি, নজরদারি ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে পারেনি। অতীতে আর্থিক প্রতিষ্ঠানে যে অনিয়ম হয়েছে তার জের এখন গোটা আর্থিক খাতকে টানতে হচ্ছে। বিভিন্ন মহল থেকে বারবার বলা হচ্ছে, সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হলে ব্যাংক খাতে জিইয়ে থাকা অনাচার-দুরাচার-কদাচারের নিরসন ঘটানো সম্ভব হবে। সুশাসন প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সরকারেরও প্রতিশ্রুতি রয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে- তার পরও কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় তা প্রতিভাত হচ্ছে না কেন? নীতিমালায় অস্পষ্টতা এবং তড়িঘড়ি সমাধানের পথে হাঁটতে যাওয়ায় আর্থিক খাতে দীর্ঘমেয়াদি সংকট দেখা দিচ্ছে। এ বিষয়টি যত দ্রুত সমাধান করা যাবে ততই আর্থিক খাতের জন্য মঙ্গল।