পর্যবেক্ষণ
মহিউদ্দিন খান মোহন
প্রকাশ : ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ১১:১৮ এএম
মহিউদ্দিন খান মোহন
মহান মুক্তিযুদ্ধে
শহীদ বুদ্ধিজীবী তালিকার চতুর্থ পর্ব গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়েছে গত ২৪ মার্চ । আরও
১১৮ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এ নিয়ে মোট ৫৬০ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর
তালিকা গেজেট আকারে প্রকাশ করল সরকার। নিঃসন্দেহে এটি একটি ভালো উদ্যোগ। আমাদের মহান
মুক্তিযুদ্ধে যারা অকাতরে প্রাণ দিয়েছেন, তাদের নাম-পরিচয় প্রকাশ করা আমাদের জাতীয়
দায়িত্ব ও কর্তব্য। যদিও সারা দেশের ৩০ লাখ শহীদের তালিকা গ্রন্থিত করা অত্যন্ত দুরূহ,
তবে মুক্তিযুদ্ধের যারা প্রত্যক্ষদর্শী, যারা এখনও বেঁচে আছেন তাদের কাছ থেকে তথ্য
নিয়ে নাম সংগ্রহ করে প্রতিটি ইউনিয়নে একটি স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন করে তাতে নামগুলো উৎকীর্ণ
করা যেতে পারে। সংশ্লিষ্ট এলাকাবাসী জানতে পারবে, স্বাধীনতাযুদ্ধে তাদের এলাকার কারা
কারা প্রাণ দিয়েছিলেন। কাজটি কঠিন নয়। দরকার সরকারি সদিচ্ছা ও উদ্যোগ। ইউনিয়ন পরিষদকে
সম্পৃক্ত করে এ কাজটি সহজেই করা যেতে পারে। মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে মাঝেমধ্যে
যে অহেতুক বিতর্কের সৃষ্টি হয় তারও অবসান ঘটবে।
পত্রিকার খবরে
বলা হয়েছে, চার পর্বে গেজেটভুক্ত শহীদ বুদ্ধিজীবীর তালিকায় আছেন ১৮ জন সাহিত্যিক, একজন
দার্শনিক, তিনজন বিজ্ঞানী, একজন চিত্রশিল্পী, ১৯৮ জন সাংবাদিক, ৫১ জন আইনজীবী, ১১৩
জন চিকিৎসক, ৪০ জন প্রকৌশলী, ৩৭ জন সরকারি ও বেসরকারি কর্মচারী, ২০ জন রাজনীতিক ও ২৯
জন সমাজসেবী। এ ছাড়া সংস্কৃতিসেবী, চলচ্চিত্র, নাটক, সংগীত, শিল্পকলার অন্যান্য শাখার
সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন ৩০ জন। এসব শহীদ বুদ্ধিজীবীর কে কোন পর্যায়ে দেশ, জাতি ও শিক্ষা-সংস্কৃতির
জন্য অবদান রেখেছেন তা বলা হয়নি। হয়তো সরকারি দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা তা ভালোভাবে
যাচাই করেই তালিকাটি প্রকাশ করে থাকবেন। তবে সরকারি-বেসরকারি কর্মচারী, রাজনীতিক ও
সমাজসেবীরা কী কারণে বুদ্ধিজীবীর কাতারে স্থান পেলেন তা অনেকেরই বোধগম্য নয়। সরকারি
কর্মচারীরা ‘শহীদ পেশাজীবী’ হতে পারেন, বুদ্ধিজীবী নন। তেমন রাজনীতিকরা ‘শহীদ রাজনীতিক’,
সমাজসেবীরা ‘শহীদ সমাজসেবী’র সম্মান পেতে পারেন, কিন্তু বুদ্ধিজীবী হতে পারেন না। শহীদ
বুদ্ধিজীবীর এ তালিকায় স্থান পেয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনের স্বত্বাধিকারী
শহীদ মধুসূদন দে। তিনি কীভাবে বুদ্ধিজীবী হলেন, এ নিয়ে অনেকেরই প্রশ্ন রয়েছে।
আজ যেটা মধুর
ক্যান্টিন নামে পরিচিত শুরুতে তা এ নামে ছিল না। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত
হওয়ার পর মধুসূদনের বাবা আদিত্যচন্দ্র দে ক্যাম্পাসে এ ব্যবসার গোড়া পত্তন করেন। সেই
থেকে এ রেস্তোরাঁটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। ১৯৩৪-৩৫ সালে
ছেলে মধুসূদন ব্যবসার হাল ধরেন। স্বাধিকার আন্দোলনের অন্যতম কেন্দ্রভূমি হিসেবে ১৯৭১
সালে ক্যান্টিনটি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর রোষানলে পড়ে। ওরা ক্যান্টিনটা পুড়িয়ে
দেয়। সেই সঙ্গে হত্যা করে মধুসূদন দে ও তার পরিবারে সদস্যদের। বর্তমানে তার কনিষ্ঠপুত্র
অরুণ দে ক্যান্টিনটি পরিচালনা করছেন। একটি সাধারণ ক্যান্টিন ঐতিহাসিক আন্দোলনসমূহের
সাক্ষী হিসেবে কীভাবে ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হতে পারে, মধুর ক্যান্টিন তার
জীবন্ত উদাহরণ। সেই সঙ্গে মধুসূদন দেও আমাদের জাতীয় ইতিহাসে মর্যাদার আসনে স্থান করে
নিয়েছেন।
আমরা কাদের বুদ্ধিজীবী
বলে অভিহিত করব? বুদ্ধিজীবীর সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ‘বুদ্ধিজীবী হলেন কোনো ব্যক্তি, যিনি
সমাজ সম্পর্কিত জটিল চিন্তা ও প্রভাব বিস্তারের ন্যায় বুদ্ধিবৃত্তিক কাজে সংশ্লিষ্ট
থাকেন। বুদ্ধিজীবীরা প্রায়ই অন্যের চিন্তাভাবনা মূল্যায়নের জন্য মানব অনুসন্ধানের বিমূর্ত,
দার্শনিক এবং রহস্যজনক দিকগুলো ব্যবহার করে সাংস্কৃতিক মতবাদ এবং লেখনীকে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম
বিশ্লেষণ করেন। তা ছাড়া প্রাত্যহিক কাজে যেসব দক্ষতায় শিক্ষার উপাদান রয়েছে, যেমন চিকিৎসা
কিংবা শিল্পকলার ক্ষেত্র, কিন্তু এ দুটি চিন্তার জগতের সঙ্গে পেশাদার হিসেবে অপরিহার্যভাবে
জড়িত নয়।’ (সূত্র : উইকিপিডিয়া)। অন্যত্র বলা হয়েছে, ‘যারা সমাজ ও সংস্কৃতি সচেতন এবং
জ্ঞানবিজ্ঞানে দক্ষ, সুশিক্ষিত মানুষ হিসেবে শ্রম বা বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রম দেন, তারাই
বুদ্ধিজীবী।’
প্রতি বছর ১৪
ডিসেম্বর আমরা শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করি। এত দিন মুক্তিযুদ্ধে হানাদার বাহিনীর
সহযোগী আলবদর বাহিনীর হাতে জীবনদানকারী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, সাংবাদিক, আইনজীবী, ক্রীড়াবিদদেরই
আমরা শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে শ্রদ্ধা জানাতাম। এখন এর সঙ্গে যুক্ত হলেন সরকারি কর্মচারী,
রাজনীতিক ও সমাজসেবীরাও। এতে ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী’র মহিমা ক্ষুণ্ন হলো কি না ভেবে দেখার
বিষয়। প্রশ্ন উঠেছেÑমধুর ক্যান্টিনের মালিক মধুসূদন দে বুদ্ধিজীবীর তালিকায় উঠে এলেন
কোন যুক্তিতে? এটা ঠিক, ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা সংগ্রাম পর্যন্ত আন্দোলন-সংগ্রামের
প্রতিটি স্তরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনের নাম জড়িয়ে আছে। সেই সঙ্গে জড়িয়ে
আছে শহীদ মধুসূদনদের নাম। তার ক্যান্টিন থেকেই প্রতিবাদ মিছিল বের হতো, যা একসময় দাবানল
সৃষ্টি করে স্বৈরশাসকের গদি ভস্ম করে দিয়েছে। গণতান্ত্রিক ও স্বাধিকার আন্দোলনের নীরব
সহযোগী হিসেবে মধুসূদন দে আমাদের ইতিহাসে অবিস্মরণীয় হয়ে আছেন এবং ভবিষ্যতেও থাকবেন।
মুক্তিযুদ্ধের শহীদের তালিকায় তার নাম প্রথম দিকেই স্থান পাবে নিঃসন্দেহে। কিন্তু তাকে
বুদ্ধিজীবীর তালিকাভুক্ত করা কতটা সুবিবেচনাপ্রসূত হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা অসমীচীন
নয় বোধহয়।
এ প্রশ্নটি আমি
ফেসবুকে তুলেছিলাম আমার এলাকার এক বড় ভাই সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ও বিশিষ্ট ব্যাংকার জয়নাল
আবেদীনের পোস্টের বিপরীতে। জবাবে তিনি লিখেছেন, ‘তাকে (মধুসূদন দে) শহীদ বুদ্ধিজীবীর
তালিকাভুক্ত করেছে, মোটা মাথার দলীয় বুদ্ধিজীবীরা। ২৫ মার্চ, ১৯৭১ সালে অপারেশন সার্চলাইটের
শিকার মধু দাদা, তাঁর স্ত্রী যোগমায়া দে, বড় ছেলে রঞ্জিত দে ও রঞ্জিত দের নববিবাহিতা
স্ত্রী। সংসারের সিনিয়র চারজনকে হত্যা করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। সে ক্ষেত্রে শহীদের
তালিকাভুক্ত করাই ছিল যথাযথ। তবে মধু দাদার পরিবারকে সম্মানি ভাতা দেওয়া উচিত।’ মধুসূদন
দেকে নিয়ে আমরা বিক্রমপুরবাসী গর্ব করি। বিক্রমপুরের শ্রীনগর উপজেলা সদরের মথুরাপাড়া
গ্রামে তার বাড়ি। আমি যে কলেজে পড়েছি, সেই শ্রীনগর কলেজের পাশেই বাড়িটির অবস্থান। অনেক
বছর তা বেদখল থাকলেও কয়েক বছর আগে দখলমুক্ত করে মধুসূদনের উত্তরাধিকারীদের বুঝিয়ে দিয়েছে
স্থানীয় প্রশাসন।
অবিমৃশ্যকারী সিদ্ধান্তের কারণে আমাদের অনেক মর্যাদাসম্পন্ন জাতীয় পুরস্কার-পদক নিয়ে নানা সময়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। অনাকাঙ্ক্ষিত-অনভিপ্রেত এই পরিস্থিতির দায় সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলরা এড়াতে পারেন না। মহান মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলন এসবই আমাদের গর্ব ও অর্জনের স্মারক। এ নিয়ে সব কিছু বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকুক।