অলঙ্করন : প্রবা
বাজারে চিনির দাম বাড়ছে। হঠাৎ না, চিনির দাম বাড়বে, কথাটি হাওয়ায় ভাসছিল। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ক্রেতার কাছে এই কথাটি ছড়িয়েছেন খুচরা বিক্রেতারা। অনেক বিক্রেতাই পণ্যটি বিক্রির সময় পরিচিত ক্রেতার কানে কথাটি পৌঁছে দিতে ভুল করেননি। ক্রেতার মনে আশঙ্কা, প্রয়োজনের সময়ে তিনি হয়তো পণ্যটি হাতের নাগালে পাবেন না। ফলে ক্রেতাও প্রয়োজনের অতিরিক্ত কিনছেন। যার দরকার হয়তো মাসে দুই কেজি চিনি, তিনিও আতঙ্কে, গুজবে কিনছেন পাঁচ, ছয় কেজি বা তারও বেশি। এতে বাজারে তৈরি হয়েছে চিনির বাড়তি চাহিদা। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সত্যিকার অর্থেই বাজারে প্রয়োজনীয় জোগানের বিষয়টি।
সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন বলছে, ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) বাজারে চিনি সরবরাহরকারী একটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে চিনি সংগ্রহের জন্য একটি বড় চাহিদাপত্র দিয়েছে। চাহিদাপত্রের ভিত্তিতে চিনির জোগান দিতে স্বাভাবিকভাবেই প্রতিষ্ঠানটি বাজারে চিনি সরবরাহ কমিয়েছে। এতে করে সংকট তৈরি হয়েছে পাইকারি বাজারে। যার ফায়দা লুটে নিতে চাইছে হয়তো কিছু অসাধু ব্যবসায়ী। তাই হু হু করে বাড়ছে চিনির দাম। মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে পণ্যটির দাম বেড়েছে কেজিতে কুড়ি টাকারও অধিক। দুই সপ্তাহ আগে যে চিনির কেজি ছিল ৯০ টাকা, দুই সপ্তাহের ব্যবধানে তাই কিনতে ক্রেতাকে গুনতে হচ্ছে একশ দশ টাকা। এই যে পণ্যটির দাম বাড়ছে, বাড়ার এই চিত্রটিও কিন্তু স্থির না। কারণ, দাম বাড়তে বাড়তে শেষাবধি তা কোথায় দাঁড়াবে, সে প্রশ্নের উত্তর কারও জানা নেই। আর দাম যে আরও বাড়বে বা বাড়তে পারে, সে বিষয়টিই যখন ক্রেতার কানে পৌঁছে যাচ্ছে, তখনই তৈরি হচ্ছে বাড়তি চাহিদা। যা দাম বাড়ার প্রবণতাকে আরও উসকে দিচ্ছে।
আমাদের চিনির চাহিদা কত? আমরা কতটুকু উৎপাদন করি আর কতটুকুই বা আমদানি করি? এ প্রশ্নগুলোর উত্তর বা পরিসংখ্যান রয়েছে হাতের নাগালেই। টিসিবির তথ্য বলছে, দেশে চিনির চাহিদা ১৮ লাখ টন। আমাদের রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকল ১৫টি। তাদের উৎপাদনক্ষমতা প্রায় দেড় লাখ টন। তার মানে দেশের বাজারে চিনির চাহিদার বিপরীতে আমরা উৎপাদান করছি প্রায় দেড় লাখ টন। বাকি থাকছে প্রায় সাড়ে ১৬ লাখ টন। এই ঘাটতি মেটানো হয় চিনি আমদানির মাধ্যমে। দেশের বাজারের ঘাটতি পূরণে চিনি আমদানি করে আমাদের বেসরকারি খাতের চারটি শিল্পপ্রতিষ্ঠান। তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমদানি করে কাঁচা চিনি। এরপর আমদানিকৃত কাঁচা চিনি নিজেদের পরিশোধনাগারে পরিশোধনের মাধ্যমে ব্যবহার উপযোগী করে বাজারজাত করে। এখন প্রশ্ন , আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো কি চিনি আমদানি করছে না? তারা কি আমদানিকৃত কাঁচা চিনি পরিশোধন করছে না?
প্রথম প্রশ্নটির উত্তর ইতিবাচক। প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়মিত চিনি আমদানি করছে। অথচ সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন বলছে, দেশে স্বাভাবিক রয়েছে চাহিদা অনুযায়ী চিনির আমদানি। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত ৯ মাসে সাড়ে ১৬ লাখ টন চিনি আমদানি হয়েছে। এখনও চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে খালাসের অপেক্ষায় আছে জাহাজ।
তবে দেশের বেসরকারি খাতের চিনি পরিশোধনকেন্দ্রগুলো কিছুটা বিরূপ সময় পার করছে। কারণ, তাদেরকে উৎপাদন প্রক্রিয়া সচল রাখতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্বকে একটি বিরূপ সময়ের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। করোনায় ভেঙে পড়া অর্থনীতিকে সচল করে তোলার আগেই বিশ্বকে নতুন বিপর্যয় মোকাবিলায় শক্তি খরচ করতে হচ্ছে। এ অবস্থার বাইরে নয় বাংলাদেশও। জ্বালানি সংকটে নাকাল হয়ে পড়েছে বিশ্ব। যার প্রভাবে আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রক্রিয়াও বাধাগ্রস্ত হয়েছে। জ্বালানির অভাবে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো পূর্ণমাত্রায় উৎপাদন করতে পারছে না। যার ফলে কলকারখানার উৎপাদন প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে। একইভাবে দেখা দিয়েছে গ্যাসেরও সংকট। গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটের কারণে স্বাভাবিকভাবেই চিনির উৎপাদন কমেছে। এতে করে বাজারেও কমেছে চিনির সরবরাহ।
তবে এ প্রসঙ্গে আরও একটি কথা আমাদের আমলে নিতে হবে। দেশে চিনি পরিশোধকারী একটি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে সংবাদমাধ্যমকে বলা হয়েছে, তারা একাই অক্টোবর মাসে বাজারে সরবরাহ করেছে ৭৪ হাজার টন চিনি। প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকেই প্রশ্ন তোলা হয়েছে, ‘এক মাসে এর চেয়ে বেশি চাহিদাও থাকার কথা না। তাহলে এত চিনি কোথায় যায়?’ একই প্রশ্ন আমাদেরও।’
বাজারে চাহিদা বেড়েছে। অনেকের মধ্যে প্রয়োজনের অতিরিক্ত চিনি সংগ্রহেরও প্রবণতা দেখা দিয়েছে। কেউ কেউ বাড়তি পণ্য সংগ্রহও করছেন। এতে করে বাজারে এক ধরনের কৃত্রিম সংকট তৈরি হচ্ছে, এমন কথাও উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু কেন বাড়তে শুরু করেছে চিনির দাম? কেন চিনির সংকট তৈরির কথা ভাসছে? এর মানে বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে অন্য কেউ। যাদের নিয়ন্ত্রণে প্রতিটি নিত্যপণ্যের দাম বাড়তে থাকে। যাদের কাছে জিম্মি আমাদের বাজারব্যবস্থা। আমাদের কারও ভুলে যাবার কথা না, মাত্র দেড় বছর আগে, করোনার শুরুতে কীভাবে রাতারাতি বাজারে আদার মতো একটি পণ্যের দাম বাড়তে বাড়তে আকাশ ছুঁয়েছিল। পেঁয়াজের দাম নিয়ে ঘটা তুঘলকি কাণ্ডের তো শেষই নেই। একই অবস্থা প্রতিটি নিত্যপণ্যে। যখনই অসাধু চক্রটি চেয়েছে, তখনই নানাভাবে গুজব রটিয়ে, বাজার থেকে পণ্য সরিয়ে, কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। কয়েক দিনের ব্যবধানে হাতিয়ে নিয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকা।
আমাদের অর্থনীতি আমদানিনির্ভর। বিলাসদ্রব্য তো বটেই অধিকাংশ নিত্যপণ্যই আমাদেরকে আমদানি করতে হয়। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে দেশের বাজারের দামের সম্পর্ক। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বাড়লে আমাদের এখানেও বাড়ে। সেই বাড়ার প্রক্রিয়াটি কখনও কখনও তাৎক্ষণিকও হয়। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম কমলে আমাদের এখানে কমা তো দূরের কথা তার লক্ষণও দেখা যায় না। এক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের যুক্তি থাকে, তারা আগের দামে আমদানি করেছেন, তারা আগে এলসি খুলেছেন। এখন দাম কমলে কী করে তারা কমাবেন? কারণ তাদের পণ্য তো আগেই কেনা হয়েছে অধিক দামে। যদিও এই যুক্তিটি আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়লে খাটে না। তখন সঙ্গে সঙ্গে দাম বাড়ানো সম্ভব হয়, তখনও দেখানো হয় নানা যুক্তি। এবারে চিনির দামের বিষয়েও একই কথা প্রযোজ্য। গত ছয় মাস ধরে নানা কারণ দেখিয়ে যখন আমাদের বাজারে চিনির দামকে নাগালের বাইরে নিয়ে যাবার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, তখন সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন বলছে, আন্তর্জাতিক বাজারে ক্রমশ কমছে চিনির দাম। গত ছয় মাসে আন্তর্জাতিক বাজারে ধারাবাহিকভাবেই কমছে চিনির দাম।
ইন্টারন্যাশনাল সুগার অর্গানাইজেশনের তথ্য অনুযায়ী, ৩ নভেম্বর আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি টন চিনি বিক্রি হয়েছে ৫১৭ ডলারে। এর আগে ১৪ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি টন চিনি বিক্রি হয়েছে ৫৭১ ডলারে। অর্থাৎ মাত্র ৫২ দিনের ব্যবধানে আন্তর্জাতিক বাজারে চিনির দাম প্রতি টনে কমেছে ৫৪ ডলার। অথচ সে প্রভাব আমাদের বাজারে অনুপস্থিত। বরং এখানে উল্টো পথে হাঁটছে চিনির দাম। এখানের বাজারে সেপ্টেম্বর মাসে যেখানে চিনির কেজি ছিল ৮০ টাকা, সেই চিনিই এখন কেজিতে বেড়েছে ৩০ টাকারও বেশি।
প্রতিবছর, প্রতি মুহূর্তে এই যে মানুষকে জিম্মি করে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ানো, এ বুঝি আজ সমাধানহীন। সরকার চাইছে বাজারে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে। টিসিবির মাধ্যমে নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে স্বল্পমূল্যে নিত্যপণ্য পৌঁছে দিতে। কিন্তু সরকারি এই সাধু উদ্যোগের সুফল ভোগের সুযোগ মিলছে কই? নিত্যপণ্যের লাগামছাড়া দাম, নিয়ন্ত্রণহীনতায় নাভিশ্বাস উঠছে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের।
লেখক : সাংবাদিক ও কবি