সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়
প্রকাশ : ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ১০:১৫ এএম
গায়ে আঁটা গরম জামা, পুড়ে পিঠ হচ্ছে ঝামা;/ রাজা বলে, “বৃষ্টি নামা—নইলে
কিচ্ছু মিলছে না”/ …ঝাঁ ঝাঁ রোদ আকাশ জুড়ে, মাথাটার ঝাঁঝ্রা ফুঁড়ে,/ মগজেতে নাচছে
ঘুরে রক্তগুলো ঝ্নর্ ঝন্;/ ঠাঠা-পড়া দুপুর দিনে, রাজা বলে, “আর বাঁচিনে,/ছুটে আন্
বরফ কিনে, ক’চ্ছে কেমন গা ছন্ছন্।” -সুকুমার রায়ের ‘আবোল তাবোল’ বইয়ের ‘নেড়া বেলতলায়
যায় ক’বার?’ শিরোনামের ছড়াটিতেই শুধু নয়, আজকে গরমের তীব্রতায় রাজা-প্রজা সবারই এটি
মনের কথা। বিশ্বজুড়েই উষ্ণায়নের যে আশঙ্কা করছিলেন বিজ্ঞানীরা, সেটাই আজ হাতেনাতে টের
পাচ্ছে মানুষ। দেশজুড়েই তীব্র গরম। দেশের ৭ জেলায় তীব্রসহ ২৮টি জেলায় মাঝারি ও মৃদু
তাপদাহে জনজীবন বিপর্যস্ত। গরমের এই তীব্রতা আরও বাড়ার সতর্কবার্তার সঙ্গে আবহাওয়া
অধিদপ্তরের তরফে তৃতীয় দফায় দেশব্যাপী তাপ সতর্কবার্তা জারি করা হয়েছে। সঙ্গে আগামী
২৭ বা ২৮ এপ্রিল দেশে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বেড়ে ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ওঠারও আশঙ্কার কথা
জানিয়েছেন আবহাওয়াবিদরা। গরমের এই দীর্ঘস্থায়ী অভিজ্ঞতা আমাদের জন্য বিরল। এপ্রিল মাসে
গরমের এমন তীব্রতা এবং স্থায়িত্ব আগে দেখা যায়নি। আবহাওয়া অধিদপ্তরের যে পূর্বাভাস,
তাতে আগামী এক সপ্তাহেও তাপমাত্রার খুব পরিবর্তন হবেÑ এমন আশা করার সুযোগও কম। ফলে
স্বাভাবিকভাবেই দীর্ঘ হবে অস্বস্তিকর দিনের সংখ্যা।
বিশ্ব উষ্ণায়ন নতুন নয়। গ্রীষ্ম যে ক্রমশ প্রখর থেকে প্রখরতর হচ্ছে- তা গত কয়েক বছরে স্পষ্ট। জলবায়ু পরিবর্তনের এই গতি বাড়ছে বিকৃত এবং দ্রুত নগরায়ণের
ফলে উষ্ণায়নের হাত ধরে। মানুষ যত রাজধানীমুখো হচ্ছে, পরিবেশের ওপর চাপ তত বাড়ছে। গত
এক দশকে রাজধানীতে নির্মাণ ক্ষেত্রের পরিমাণ বাড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কমেছে সবুজ অংশের
পরিমাণ। রাজধানীতে সড়ক, ফুটপাথ, সড়ক বিভাজক সম্প্রসারণের প্রয়োজনে শত শত গাছ কেটে ফেলার
ঘটনাও ঘটেছে। সবুজ ধ্বংস করে কিংবা নদী, খাল, জলাভূমি ভরাট করে সুউচ্চ ভবনও নির্মাণ
চলছে। চুনসুরকির দেওয়াল কিংবা খড়খড়ি দেওয়া জানালার স্থান দখল করেছে কংক্রিট, স্টিল,
কাচ, অ্যালুমিনিয়াম। পিচের কালো রাস্তা বায়ুমণ্ডলের তাপ শুষে নিজেও তেতে উঠছে। আর কংক্রিটের
নির্মাণ কাঠামোর কারণে আটকে যাচ্ছে বায়ু চলাচলের স্বাভাবিক গতিপথ।
এমনটা যে অপ্রত্যাশিত, তা নয়। দীর্ঘদিন ধরেই একটু-একটু করে জলবায়ু
পরিবর্তনের চিহ্নগুলো স্পষ্ট হয়েছে। তাপমাত্রা বাড়ার ফলে যে পরিবর্তনগুলোর আশঙ্কা করা
হয়েছে, তার অধিকাংশই এখন বাস্তব। বিশ্বজুড়ে কোথাও অতিবৃষ্টি, কোথাও অনাবৃষ্টি। ঘন
ঘন ঘূর্ণিঝড়ে তছনছ হচ্ছে উপকূল। এর সবই সর্বনাশের দিকে ইঙ্গিতের পাশাপাশি বিশ্ব উষ্ণায়ন
যে ক্রমশ প্রখর থেকে প্রখরতর হচ্ছে তা-ও স্পষ্ট করে। ২৩ এপ্রিল প্রতিদিনের বাংলাদেশে
প্রকাশিত ‘ঢাকা এখন তপ্ত দ্বীপ’ শিরোনামের প্রতিবেদনটিতে ঢাকার ২৫টি স্থানকে তপ্ত
দ্বীপ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের উদ্ধৃত করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকারি
দাপ্তরিক, প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক কার্যক্রম থেকে শুরু করে কর্মসংস্থানÑ সবকিছুরই কেন্দ্রবিন্দু
হওয়ায় রাজধানীতে জনসংখ্যার চাপ বাড়ছে। ফলে উন্মুক্ত প্রান্তর কমছে, গাছপালা ও জলাশয়ও
আশঙ্কাজনক হারে কমছে, পানির স্তর নেমে যাচ্ছে।
পরিবেশবিজ্ঞানীরা বারবারই বলেছেন, জলবায়ু বদল পুরোপুরি ঠেকানো সম্ভব
নয়। তবে পরিবর্তনের গতি কমানো সম্ভব। এজন্য পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে
হবে। ২৩ এপ্রিল প্রতিদিনের বাংলাদেশে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ন্যাশনাল এডাপটেশন
প্ল্যান (ন্যাপ) এক্সপ্রো ২০২৪-এর উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুদ্ধে
অর্থ ব্যয় না করে বিশ্বনেতাদের সেই টাকা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় খরচ করার আহ্বান
জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর এ আহ্বানকে আমরা স্বাগত জানাই। সেই সঙ্গে দেশের ভেতরে গাছ
লাগানোর সঙ্গে সঙ্গে গাছ রক্ষার দিকেও মনোযোগ দেওয়ার আহ্বান জানাই। উন্নয়নের নামে যেভাবে
গাছ কাটা হচ্ছে, সেই তুলনায় গাছ লাগানোর সংখ্যা কিন্তু কম। আর এ কথা তো অস্বীকার করার
সুযোগ নেই, একটি পরিপূর্ণ গাছ যেভাবে প্রকৃতিকে সুরক্ষা দেয়, নতুন লাগানো গাছগুলোর
সেই অবস্থানে আসতে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন। তাই আমরা প্রশ্ন রাখতে চাই, জলবায়ু বদলের বিপদ
ঠেকাতে নীতিনির্ধারণে তাপসূচকের মতো প্রাকৃতিক ঘটনাকে কি সরকারের সঙ্গে সঙ্গে সংশ্লিষ্ট
সংস্থা এবং সাধারণ মানুষও গুরুত্ব দেবে?
শিল্পবিপ্লবের পর পৃথিবীর তাপমাত্রা ১ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে।
বলা হচ্ছে, ২০২৩ সালের মধ্যে তাপমাত্রা বাড়লেও তা যেন ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে না পৌঁছায়,
সে জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। কিন্তু শিল্পায়নের এ যুগে বিষয়টি আদৌ সম্ভব কি-না,
তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা মোকাবিলা কোনো দেশের একার পক্ষে
সম্ভব নয়। পৃথিবীর সব দেশ যদি সমন্বিতভাবে দুর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় এগিয়ে
আসে, তা হলে আমরা ইতিবাচক পরিবর্তন দেখতে পাব। প্রত্যেক দেশকেই কার্বন নিঃসরণ কমানোর
জন্য এগিয়ে আসতে হবে। মনে রাখতে হবে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ কোনো ধারাবাহিকতা অনুসরণ করছে
না। কারণ বৈশ্বিক জলবায়ুর পরিবর্তনে প্রত্যক্ষভাবে অবদান রাখছে মানবসৃষ্ট অনিয়ন্ত্রিত
কর্মকাণ্ড। আমরা প্রকৃতিপ্রদত্ত বাস্তুসংস্থানের সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ না করে নির্বিচারে
ভূমির ব্যবহারের সঙ্গে অনিয়ন্ত্রিতভাবে কংক্রিট স্থাপনার সম্প্রসারণের মাধ্যমে ভূমিরূপের
ক্ষয়সাধন ত্বরান্বিত করছি। প্রকৃতির স্বাভাবিক চক্র বিনষ্ট হচ্ছে মানুষের অতি ভোগবাদী
মানসিকতায়। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের পরিবেশ সংরক্ষণে আমরা অনেকেই সুনাগরিকের পরিচয় দিতে
পারছি না। এজন্য সিটি করপোরেশন, স্থানীয় সরকার এবং নাগরিকÑ প্রত্যেকের নিজ নিজ অবস্থান
থেকে দায়িত্বপালন করতে হবে। চিহ্নিত সমস্যাগুলোকে মাথায় রেখে পরিকল্পনার গলদগুলো দূর
করতে হবে। তা না হলে সমস্যা সামনে আরও প্রকট আকার ধারণ করতে পারে। আমাদের ভুলে গেলে
চলবে নাÑ এ দুর্যোগের হাত থেকে কেউ-ই নিরাপদ নয়।