× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধ

প্রতিবেশীদের সীমান্ত নিরাপত্তা ও বিশ্বসম্প্রদায়ের দায়

মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশীদ

প্রকাশ : ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ১০:০৯ এএম

মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশীদ

মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশীদ

২০ এপ্রিল প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯ এপ্রিল ভোরে টেকনাফের নাফ নদে বিজিপির ১৩ সদস্য কোস্টগার্ডের টেকনাফ স্টেশনের কাছে আত্মসমর্পণ করে। একই দিন মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে চলমান সংঘাতে বিদ্রোহী আরাকান আর্মির সঙ্গে টিকতে না পেরে দেশটির বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) আরও ১১ সদস্য সীমান্ত পেরিয়ে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। ওই দিন বিকালে টেকনাফের ঝিমংখালীর সীমান্ত দিয়ে তিনজন ও নাইক্ষ্যংছড়ির হাতিমারাঝিরি সীমান্ত দিয়ে আটজন বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। এখন পর্যন্ত মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধে পিছপা হয়ে পালিয়ে আসা জান্তা বাহিনীর ২৮৫ জন (বিজিপি সদস্য বাদে সেনা সদস্যও রয়েছে) ১১-বিজিবির নাইক্ষ্যংছড়ি ব্যাটালিয়নের অধীনে রয়েছে।


নিকট অতীতে মিয়ানমার থেকে বিজিপির অনেক সদস্য পালিয়ে আসে। তাদের এ পালিয়ে আসার ঘটনা দফায় দফায় ঘটেছে এবং বিদ্যমান পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে আশঙ্কা থেকেই যায়, এ রকম আরও ঘটতে পারে। তবে উত্তপ্ত পরিস্থিতিতেও বাংলাদেশ সীমান্ত সংকট নিরসনে সফলতা দেখিয়েছে। কিন্তু এমন পরিস্থিতিতে সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণে কিছু না কিছু পর্যবেক্ষণগত কিংবা তথ্যগত বিষয় দৃষ্টি এড়িয়ে যেতেই পারে। এ প্রেক্ষাপটে আমাদের সীমান্তরক্ষী বাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে নজরদারি সার্বক্ষণিক গভীর রাখার বিকল্প নেই। কারণ, অতীত পরিস্থিতিতে অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের তিক্ত অভিজ্ঞতা সঞ্চিত হয়েছে। মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা সে দেশের সীমান্তরক্ষী ও সেনা সদস্যদের ফেরত পাঠানো হয়েছিল। বাংলাদেশ তখন মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে কূটনৈতিক সহযোগিতামূলক আচরণের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে আবারও মিয়ানমার থেকে নতুন করে আশ্রিতদের ঢল আসবে কি না এ নিয়ে নানা মহলে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। কারণ সীমান্ত পাড়ি দিয়ে এভাবে অন্য দেশের মানুষ চলে এলে নিরাপত্তা সংকট দেখা দেবে এমনটিই স্বাভাবিক।

মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী, পুলিশ ও সেনা সদস্যদের পালিয়ে আসার কারণ একটু বিশদভাবে ব্যাখ্যা করা জরুরি। প্রথমত, বিজিপিই শুধু নয়, জান্তা সরকারের সামরিক বাহিনীর ব্যবস্থাপনায় ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। এ ঘাটতি সম্প্রতি বিদ্রোহী সশস্ত্র গোষ্ঠীর কারণে ঘটেছে এমনটি বলার অবকাশ নেই। জান্তা বাহিনী অস্ত্র সরবরাহ এবং সামরিক শক্তিবৃদ্ধির বিষয়টি নিয়েই বেশি ভেবেছে। অস্ত্রের ক্ষমতা পুঁজি করে তারা সামরিক ব্যবস্থাপনা করেছে বলেই প্রতীয়মান হয়। সামরিক ব্যবস্থাপনা করলেও সরকারি বাহিনীর রক্ষণাবেক্ষণ ও মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনায় ঘাটতি বরাবরই ছিল। সরকারি বাহিনীর সদস্যদের মানবিক নানা বিষয় নিশ্চিত করার বিষয়ে তাদের মনোযোগ ছিল কম। সামরিক বাহিনীর খাদ্য, চিকিৎসা এমনকি প্রশিক্ষণেও পর্যাপ্ত বিশ্রামের অভাবের অভিযোগ দেশি-বিদেশি অনেক সংবাদমাধ্যমেই উঠে এসেছে। মিয়ানমারে এখন যে গৃহযুদ্ধ চলছে সেখানে বিদ্রোহী সশস্ত্র গোষ্ঠী সরকারি বাহিনীকে কোণঠাসা করে ফেলছে। এ গৃহযুদ্ধ শুধু আরাকান রাজ্যে চলছে এমন নয়, গোটা মিয়ানমারেই চলছে। বিদ্রোহী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো অতর্কিত হামলা করছে। তা ছাড়া বিদ্রোহী সশস্ত্র গোষ্ঠী সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে থাকায় অনেক সময় তাদের শনাক্ত করা কঠিন হয়ে যায়। অতর্কিত হামলার মাধ্যমে জান্তা বাহিনী এমনকি বিজিপির ওপর হামলা করার পর তারা সামরিক ঘাঁটি ধ্বংস করে দিচ্ছে। কেড়ে নিচ্ছে সামরিক রসদ। অন্যদিকে সামরিক বাহিনীকে সব সময় তটস্থ থাকতে হচ্ছে। অক্লান্তভাবে তারা যুদ্ধ করে চলেছে।

এ স্তম্ভেই লিখেছিলাম, মিয়ানমারে জান্তা সরকার রাজনৈতিক সমাধানে না গিয়ে সামরিক সমাধানের পথ খুঁজছে। আর এ সামরিক সমাধান দীর্ঘমেয়াদি হওয়ায় তাদের সামরিক রসদ সরবরাহে ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। বহু আগে থেকেই মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর অবকাঠামোগত ব্যবস্থাপনায় ব্যাপক ঘাটতি ছিল, এ কথা আগেই বলেছি। একই সময়ে বিদ্রোহী সশস্ত্র গোষ্ঠীর প্রবল প্রতিরোধে যখন তারা কোণঠাসা হয়ে পড়ছে তখন স্বাভাবিকভাবেই সামরিক সদস্যদের মনোবল ভেঙে পড়ছে। বিগত কয়েক মাসে বহু জান্তা বাহিনী ও বিজিপি সদস্য তাদের ঘাঁটি বা সেনাদল ছেড়ে পালিয়ে বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করেছে। আমরা জানি, অনেকে ভারত ও চীনে আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করলেও তাদের দ্রুত সেখান থেকে ফেরত পাঠানো হয়। একইভাবে অনেক সেনা সদস্য বাংলাদেশেও নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে এসে সীমানা পাড়ি দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করছে।

প্রথমেই বলেছি, সামরিক সক্ষমতা ধরে রাখার ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনাগত যেসব দিকে মনোযোগ দেওয়া জরুরি তার কিছুই মিয়ানমার সরকার করেনি। প্রথাগতভাবে সামরিক বাহিনীর সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য যে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার সেগুলোরও কিছুই তারা করতে পারেনি। আর যেহেতু তারা এমন ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করতেই পারেনি তাই তাদের সামরিক বাহিনীর মানসিক অবস্থা বিঘ্নিত হচ্ছিল নানা কারণেই। বিশেষত যুদ্ধে বারবার পরাজয়ের ফলেও তাদের মনোবল ভেঙে পড়ছে এবং তারা সামরিক বাহিনী থেকে বারবার পালিয়ে আসছে। মূলত নেতৃত্বস্থানীয় পর্যায়ে অনেকেই আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছেন। মেইন কমান্ড যখন যুদ্ধে বিজয়ের আস্থা হারিয়ে ফেলেন তখন সঙ্গত কারণেই অধীন সেনারাও দিশাহারা হয়ে পড়ে। এ ধরনের অসহায়ত্ব যেকোনো সামরিক বাহিনীর জন্যই ক্ষতিকর। আর মূলত অসহায়ত্ব থেকেই তারা একসময় পালিয়ে যায়। কারণ তাদের একমাত্র যে লক্ষ্য তা-ই যখন পূরণ হচ্ছে না আর তখন বেশ কিছু সমস্যা দেখা দিতে শুরু করে। মনোবল ভেঙে যাওয়া এ সেনারা ক্রমেই নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ইতস্তত পালিয়ে বেড়ায়। একসময় তারা সীমানাও অতিক্রম করে। সেনাবাহিনী থেকে সেনা সদস্য পালিয়ে যাওয়ার ফলে জান্তা সরকার নানাভাবে ক্ষতির মুখে পড়ছে। এ অবস্থা থেকে পুনর্গঠনপ্রক্রিয়া শুরু করা কঠিন বইকি। তার পরও জান্তা সরকার সামরিক সমাধানের পথ খুঁজছে, এটি ভুল বলে মনে করি। বরং তাদের রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে বের করা উচিত।

মিয়ানমার থেকে জান্তা বাহিনী ও বিজিপি সদস্যদের সীমানা পাড়ি দিয়ে আসার ফলে আমাদের এখানে কিছু নিরাপত্তা সংকট দেখা দেওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। কারণ এই সামরিক সদস্যরা যখন পালিয়ে আসে তখন তাদের কাছে যতটুকু সামরিক রসদ থাকে তা নিয়ে আসে। আত্মরক্ষার তাগিদে তাদের কাছে কিছু অস্ত্র থাকে যা সীমানা পাড়ি দেওয়ার সময়ও তাদের কাছে থাকে। প্রশ্ন হচ্ছে, এসব অস্ত্র আসলে কাদের এবং কী ধরনের অস্ত্রÑএ বিষয়ে আমাদের কাছে এখনও বিস্তারিত কোনো তথ্য নেই। যেহেতু এ বিষয়ে এখনও আমাদের কাছে বিস্তারিত কোনো তথ্য নেই তাই নিরাপত্তা সংকটের বিষয়টিকে অন্যভাবে দেখা জরুরি। কারণ সীমানা পাড়ি দিয়ে আসা সামরিক বাহিনী বা বিজিপির এ সদস্যরা আপাতত বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর হেফাজতে রয়েছে। হেফাজতে থাকাকালে একসময় তাদের অর্থের প্রয়োজন হতে পারে বা অন্য কোনো প্রয়োজন দেখা দিতে পারে। তখন তারা এ অস্ত্র বিক্রি করে দেওয়ার চেষ্টা করবে। এটি শুধু হেফাজতকালেই করবে এমনটি নয়, বরং তারা পালিয়ে আসার পরও করতে পারে। আমরা জানি, বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত জঙ্গলাকীর্ণ ও সবুজে ঘেরা দুর্গম অঞ্চল। এ দুর্গম অঞ্চলে মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন বাদে আরও অনেক সংগঠন রয়েছে। তাদের কাছে যদি এভাবে অস্ত্র পৌঁছে যায় তাহলে বিষয়টি পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার পথে বড় বিঘ্ন হয়ে দাঁড়াবে।

বিষয়টি আমরা কীভাবে মোকাবিলা করব আর নিরাপত্তার এ সংকট পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে কীভাবে যাচাই করতে হবে তা নিয়ে ভাবতে হবে। যদি তা করা না যায় তাহলে বরং আমাদের সামনে কিছু সমস্যা দেখা দিতে পারে। মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘাত-সহিংস পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের শঙ্কার বড় কারণ নেই বলে মনে করি। তার পরও কিছু উদ্বেগের বিষয় রয়ে যায়। চলমান গৃহযুদ্ধে পরাজিত পক্ষ নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে বাংলাদেশের জঙ্গলাকীর্ণ কিংবা পার্বত্য অঞ্চলে আত্মগোপন করতে পারে। তাতে সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোয় নিরাপত্তা সংকট বাড়ার আশঙ্কা রয়ে যায়। তাই বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে নজরদারি বাড়াতে হবে। পাশাপাশি গোয়েন্দা নজরদারিও বৃদ্ধি করা জরুরি। সীমান্তবর্তী এলাকায় অহেতুক চলাচল বা গতিবিধি নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। সীমান্ত এলাকা দিয়ে নতুন কারও অনুপ্রবেশ ঠেকানোর প্রস্তুতিও রাখতে হবে। যেকোনো দেশে যখন অভ্যন্তরীণ বিবাদে চূড়ান্ত অর্থে গৃহযুদ্ধ চলে তখন এর বহুমুখী বিরূপ প্রভাব প্রতিবেশী দেশগুলোর ওপর নানাভাবে পড়ে থাকে। মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংকটের বড় ভুক্তভোগী আমরা। এর অন্যতম বড় নজির বছরের পর বছর স্বভূমি থেকে বিতাড়িত লাখ লাখ রোহিঙ্গার বোঝা বহন করে চলা।

বাংলাদেশ মানবিকতার তাগিদে সীমান্ত খুলে দিয়ে বিপন্ন-বিপর্যস্ত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে এবং বছরের পর বছর তাদের বোঝা বয়ে চলে যে নজির স্থাপন করেছে তা বিশ্ব ইতিহাসে নিঃসন্দেহে অনন্য দৃষ্টান্ত। কিন্তু বিশ্বসম্প্রদায় বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা রাখেনি এও নিঃসন্দেহে ইতিহাসে বিবর্ণ নজির হয়ে থাকবে। বিশ্বসম্প্রদায়ের উচিত বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে ন্যায়সঙ্গত ও গঠনমূলক পদক্ষেপ নেওয়া।

  • নিরাপত্তা-বিশ্লেষক ও নির্বাহী পরিচালক, ইনস্টিটিউট অব কনফ্লিক্ট ল অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা