স্বাস্থ্যখাত
ড. মুনীরউদ্দিন আহমেদ
প্রকাশ : ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ১০:৫০ এএম
ড. মুনীরউদ্দিন আহমেদ
৭ এপ্রিল প্রতিদিনের
বাংলাদেশ-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, টাকার অভাবে তিন কোটি মানুষ পায় না চিকিৎসা।
১৭ কোটি মানুষের একটি দেশে সংখ্যাটি কমই মনে হয়েছে। দেশের স্বাস্থ্য অবকাঠামোর কথা
বিবেচনায় দেশে আরও বেশি মানুষ চিকিৎসাসেবা পাচ্ছে না বলেই প্রতীয়মান হয়। এক্ষেত্রে
চিকিৎসা বলতে প্রকৃত চিকিৎসাসেবাকে বুঝিয়েছি। গ্রামীণ অঞ্চলে কবিরাজ, হাতুড়ে ডাক্তার,
ওষুধের দোকানে প্রেসক্রিপশন ছাড়া ওষুধ কেনা কিংবা বৈদ্যের মাধ্যমে শারীরিক সমস্যার
সমাধান করাকে চিকিৎসাসেবা বলা যায় না। প্রকৃত চিকিৎসার সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছে আধুনিক
চিকিৎসা অবকাঠামো, সুযোগ-সুবিধা ইত্যাদি। প্রকৃত চিকিৎসা নিশ্চিতকরণে প্রয়োজন ওষুধ,
অভিজ্ঞ ও লাইসেন্সধারী চিকিৎসক। চিকিৎসককে স্বাস্থ্যসেবার কাজ সুগম করে দেওয়ার জন্য
সহকারী এবং উন্নত সুযোগ-সুবিধা সংবলিত অনুমোদিত স্বাস্থ্য কিংবা চিকিৎসাকেন্দ্র। সমন্বিতভাবে
চিকিৎসাসেবা সারা দেশে খুব কম মানুষই পায়।
দেশের অনেকেই
এখনও চিকিৎসাসেবা সম্পর্কে সচেতন নন। মাথাব্যথা বা ছোটখাটো উপসর্গ দেখলে অনেকে নিজেই
নিজের চিকিৎসা করেন অর্থাৎ ফার্মেসিতে গিয়ে ওষুধ কিনেন। আবার অনেকে ডাক্তারের কাছে
না গিয়ে ফার্মেসিতে উপসর্গ বলে ওষুধ কিনে খান। এগুলোকে আমরা কোনোভাবেই চিকিৎসাসেবার
অন্তর্ভুক্ত করতে পারি না। ছাত্রজীবনে অধ্যয়নকালীন তো বটেই পরবর্তী সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের
শিক্ষকতার সুবাদে বহুবার ঢাকা মেডিকেল কলেজে রোগী পরিদর্শনে গিয়েছি। যতবারই সেখানে
গিয়ে দেখেছি, একটি ওয়ার্ডে দশটি বেড থাকলেও সেখানে প্রায় পঞ্চাশের ওপর রোগী রয়েছে।
কোনোবারই রোগীদের জন্য পর্যাপ্ত বেড নিশ্চিত করতে দেখিনি। দেখেছি বেডে রোগী থাকার পরও
অনেককে মেঝেতে জায়গা করে দেওয়া হয়েছে। আরও দেখেছি, অনেকে বারান্দায় কোনোভাবে চিকিৎসাসেবার
অপেক্ষায় কষ্ট করে আছেন। ব্যক্তিগতভাবেও আমার এক নিকটাত্মীয়ের সফল অস্ত্রোপচার শেষে
পোস্ট অপারেটিং ওয়ার্ডে নেওয়া যায়নি সিট স্বল্পতার দরুন। সেই নিকটাত্মীয়কে রুমের বাইরে
বারান্দায় একটি বিছানায় ঠাঁই নিতে হয়। মাথার ওপর কোনো ফ্যান নেই, অস্ত্রোপচারের ধকলের
মধ্যে স্বস্তি পাওয়ার কোনো কিছুই সেখানে ছিল না।
স্মরণে আছে, পরদিন
আমি আমার সেই নিকটাত্মীয়কে দেখতে যাই এবং গিয়ে আবিষ্কার করি তার তীব্র জ্বর। পাশেই
কয়েকজন নার্স বসে গল্প করছিলেন। আমি যখন তাদের দিয়ে রোগীর অবস্থা সম্পর্কে অবহিত করি,
তারা দায়সারাভাবে দুটো প্যারাসিটামল বের করে দিয়ে খাইয়ে দিতে বলেন। আমি তখন ক্ষুব্ধ
হয়ে বললাম, ‘আমার কাজ এটি নয়, এটি সেবিকার দায়িত্ব’। সেবিকারা রোগীর সার্বক্ষণিক অবস্থার
দিকে নজর রাখবেন এমনটিই নিয়ম। ফলে চিকিৎসাসেবা বলতে যে ধারণা সারা বিশ্বে প্রচলিত তা
রাজধানীতেই নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। সংগত কারণেই অনুমান করা যায়, গ্রামীণ অঞ্চলে এ
ব্যবস্থা আরও অনুন্নত। বিশেষত সরকারি হাসপাতালগুলোতে এমন দৃশ্য যেন স্বাভাবিক হয়ে গেছে।
সরকারি হাসপাতালে
সুচিকিৎসা নিশ্চিত হয় না বিষয়টি এমন নয়। সরকারি হাসপাতালে এখন উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা
রয়েছে, যা দেখলে বিস্মিত হতেই হয়। কিন্তু চিকিৎসাসেবা বলতে যে সমন্বিত প্রক্রিয়ার বিষয়ে
আলোচনা করি তা থেকে আমরা এখনও অনেক দূরে। চিকিৎসাসেবার মাধ্যমে রোগী আরোগ্য লাভ করবেন,
তার স্বজনরা ব্যবস্থার প্রতি আস্থাশীল হবেন চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট সবার সেবা প্রক্রিয়ায়।
অর্থাৎ অভিজ্ঞ চিকিৎসক তার রোগ নির্ণয় করবেন এজন্য তিনি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে রেফার
করবেন। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তাকে ওষুধ দেওয়া হবে। কোনো রোগীর অস্ত্রোপচার বা মেডিকেল
অ্যাটেনশন প্রয়োজন হলে নার্স বা অ্যাটেন্ড্যান্স থাকবেন সবসময়। তাকে আরোগ্য লাভের জন্য
ভালো ওষুধ ও যথাযথ সেবা দেবেন এটাই তো প্রত্যাশিত। প্রতিটি বিষয়ের সমন্বয়ে বা ধাপে
ধাপে রোগীকে সেবা দেওয়ার বিষয়টি আমরা এখনও প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। ফলে বাড়ছে রোগীদের
দুর্ভোগ। দেশে এখন দুই ধরনের চিকিৎসাসেবা প্রচলিত।
যাদের অর্থ আছে
তারা বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য যান। বেসরকারি হাসপাতালে যদি কাঙ্ক্ষিত সেবা
তারা না পান তাহলে বিদেশে উন্নত চিকিৎসার জন্য যান। অন্যদিকে সাধারণ মানুষ বলতে যাদের
বোঝানো হয় সেই মধ্যবিত্ত ও খেটে খাওয়া নিম্ন আয়ের মানুষরা সরকারি হাসপাতালের ওপরই নির্ভর
করেন। ঢাকার বাইরে অনেক সরকারি হাসপাতালে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার অভাব থাকে বলে রাজধানীতেই
পাঠানো হয়। তখন জটিল কোনো রোগ বা তাৎক্ষণিক জীবন শঙ্কার ক্ষেত্রে এক ধরনের জটিলতার
মধ্যে পড়তে হয় রোগী ও তাদের স্বজনদের। চিকিৎসাসেবার ক্ষেত্রে রোগী ও তার স্বজনদের সবসময়
দুর্ভোগের শিকার হতে হয়। জটিল কিংবা দুরারোগ্য ব্যাধির চিকিৎসার ক্ষেত্রে অনেক সময়
গ্রাম থেকে অনেকে শহরে আসেন। শহরে এসে কোনো হাসপাতালে গেলেই তারা প্রথমে সুচিকিৎসা
পাবেন এমনটি নয়। চিকিৎসার প্রক্রিয়া দীর্ঘমেয়াদি ও সুসমন্বিত নয়। অনেক ক্ষেত্রে সরকারি
হাসপাতালে সামান্য যা কিছু সম্বল নিয়ে রোগীরা আসেন তা নিঃশেষ হওয়ার পর জানতে পারেন
এত দিন চিকিৎসা পদ্ধতি সঠিক ছিল নাÑ এমন অভিযোগও নতুন নয়। তখন অনেকে ঋণ করে বেসরকারি
হাসপাতালে গেলে আরেক ধরনের দ্বিধায় পড়তে হয়। কোনো এক চিকিৎসকের চিকিৎসা পদ্ধতি আলাদা
হলেও রোগ শনাক্তের ক্ষেত্রে এক ধরনের দ্বিধা তৈরি করে রাখা হয়, যা ভোগান্তি আরও বাড়ায়।
সার্বিকভাবে এমনটিই আমাদের চিকিৎসা খাতের পরিস্থিতি। অর্থাৎ যারা চিকিৎসা পাচ্ছেন তারাও
যে চিকিৎসাসেবা পাচ্ছেন- এমনটি বলা যাবে না।
স্বাস্থ্য বিভাগের
হিসাবের বরাত দিয়ে প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গ্রামাঞ্চলে থাকা
কমিউনিটি ক্লিনিক, ইউনিয়ন সাব-সেন্টার, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও জেলা সদর হাসপাতাল
এবং নগরাঞ্চলে থাকা নগর স্বাস্থ্যকেন্দ্র, নগর প্রাইমারি হেলথকেয়ার ডেলিভারি সার্ভিসেস
প্রজেক্ট এবং মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে সরকারিভাবে মোট জনগোষ্ঠীর ৪০ শতাংশ স্বাস্থ্যসেবা
পাচ্ছে। বাকি প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষকে এখনও সেবার আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। টাকার অভাবে
অনেক মানুষ চিকিৎসাসেবা পাচ্ছেন না বিষয়টিকে আরেকটু ভিন্নভাবে দেখা জরুরি। কারণ চিকিৎসাসেবা
সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মনে তিক্ত অভিজ্ঞতার ধারণাই পোক্ত হয়ে গেছে। দেশের প্রত্যন্ত
অঞ্চলেও এখন স্বাস্থ্যকেন্দ্র, কমিউনিটি ক্লিনিক, বিশেষায়িত হাসপাতাল গড়ে তোলা হয়েছে।
অবকাঠামো গড়ে তোলা হলেও ধারাবাহিকতা বজায় রাখা সম্ভব হচ্ছে না। কেন হচ্ছে না এর অনুসন্ধানক্রমে
যথাযথ ব্যবস্থা কতটা নেওয়া হয়েছে?
চিকিৎসাসেবার
ক্ষেত্রে ওষুধ, অভিজ্ঞ লাইসেন্সধারী চিকিৎসক, সেবিকা, সহযোগী, পরীক্ষাকেন্দ্র, পর্যাপ্ত
সুযোগ-সুবিধাসহ আরও কিছু বিষয়ে সমন্বয় জরুরি। অধিকাংশ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পর্যাপ্ত জনবলের
অভাব যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে অভিজ্ঞ চিকিৎসকের অভাব। সম্প্রতি এক গবেষণায় বলা হয়েছে,
শতকরা ৯৩ ভাগ চিকিৎসক গ্রামে যেতে চান না। তাই অবকাঠামো গড়ে তোলার পরও সুচিকিৎসা থেকে
বঞ্চিত হচ্ছেন অনেকেই। মানুষকে চিকিৎসার জন্য মহানগরমুখো হতেই হচ্ছে। এই প্রবণতায় চিকিৎসাসেবা
প্রার্থীদের চাপ বাড়ছে শহরে। অন্যদিকে অবহেলা ও বরাদ্দের অভাবে সারা দেশে অনেক জায়গায়
চিকিৎসা অবকাঠামো গড়ে তোলার পরও ক্ষতি হচ্ছে রাষ্ট্রীয় অর্থ। বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসে
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সম্মিলিতভাবে কাজ করার স্লোগান নির্ধারণ করেছে। কিন্তু সম্মিলিতভাবে
স্বাস্থ্য খাতকে রোগীবান্ধব করার কোনো উদ্যোগ কি এখনও দৃশ্যমান হয়েছে, সংগত কারণেই
এ প্রশ্ন রাখতে হয়। গুরুত্বপূর্ণ এই খাতকে সমন্বিত করার জন্য যাদের কাজ করার কথা তাদের
জবাবদিহি ও দায়বদ্ধতা কতটা নিশ্চিত হয়েছে এ প্রশ্নও রাখতে হয়। কেন জবাবদিহি ও দায়বদ্ধতার
বিষয়গুলো নিশ্চিত হবে না?
স্বাস্থ্য খাতে রোগীবান্ধব কর্মসূচি কতটা কী নেওয়া হয়েছে এ উত্তর পাওয়া যায় জনমনের সাধারণ ধারণা থেকেই। অনেকে প্রায়ই বলেন, দেশে ভালো চিকিৎসা হয় না। অনেকে চিকিৎসার জন্য বিদেশেই চলে যাওয়ার পরামর্শ দেন। যেকোনো রাষ্ট্রের কল্যাণমুখী কার্যক্রমও একসময় মানুষের অধিকার হয়ে দাঁড়াতে পারে। দেশে অনেকগুলো মেগা প্রকল্পের মাধ্যমেও পরোক্ষভাবে রাষ্ট্রের মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার পথ অনেকাংশে সুগম করা গেছে। কিন্তু স্বাস্থ্য খাতের মতো জনগুরুত্বপূর্ণ এবং স্পর্শকাতর খাতকে কেন ঢালাওভাবে সাজানো যাচ্ছে নাÑ এটি বড় প্রশ্ন স্বাস্থ্য খাতের স্তরে স্তরে অনিয়ম-দুর্নীতির ব্যাধি দৃশ্যমান। সর্বাগ্রে এর উপশম করা বাঞ্ছনীয়। মানুষ যদি সুস্থ না থাকে কিংবা অসুস্থ হলে তার সবলতার পথ রুদ্ধ হয়ে যেতে থাকে, তাহলে জনকল্যাণমুখী উন্নয়নও অনেকাংশে ব্যর্থতার প্রশ্নের মুখোমুখি হয়। বিশেষত টাকার অভাবে প্রায় তিন কোটি মানুষ চিকিৎসা না পাওয়ার বিষয়টি অনাকাঙ্ক্ষিত-অনভিপ্রেত ও নাগরিকের মৌলিক অধিকারের মূলে কুঠারাঘাতসময়। সুশাসন নিশ্চিত হলে অনেক কিছুরই নিরসন হবে।