তাপদাহ
শহিদুল ইসলাম
প্রকাশ : ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ১০:৪৬ এএম
শহিদুল ইসলাম
রবীন্দ্রনাথ যখন
‘দারুণ অগ্নিবানে
রে…’ গানটি লিখেছিলেন, তখন তাপমাত্রা কত
ছিল? প্রশান্তকুমার পাল বা প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের বইয়ে কি তা পাওয়া যাবে? বর্তমানে
সমগ্র দেশের ওপর দিয়ে প্রচণ্ড তাপপ্রবাহ বয়ে চলেছে। অনেক জায়গাতেই তা ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস
অতিক্রম করেছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যেমন- বন্যা, খরা, ভূমিকম্প, ঝড় ইত্যাদির কারণে
বহু পশুপাখি, কীটপতঙ্গের প্রাণহানি হচ্ছে। ইতিহাসের শুরু থেকে আমরা তার যৎসামান্য পরিচয়
পাই। সভ্যতার শুরু বা ইতিহাস লেখার আগের খবরের সামান্যই জানি আমরা। তখনও এমনি প্রাকৃতিক
দুর্যোগে প্রকৃতি ধ্বংস হয়ে গেছে। মারা গেছে পশুপ্রাণী, কীটপতঙ্গ, গাছপালা। পঞ্চম
বরফ যুগে ছয় কোটি বছর রাজত্ব করার পর ডাইনোসর নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। তাদের কঙ্কাল সে
প্রমাণ বহন করে নিয়ে চলেছে।
প্রচণ্ড তাপমাত্রার
কারণে এক সপ্তাহের জন্য বাংলাদেশের সকল স্কুল-কলেজ বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ভারতের বেলুড়
মঠ থেকে হাতে লেখা একটি বিজ্ঞপ্তি ফেসবুকের পাতায় ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তার শিরোনাম
হলোÑ ‘এসি কোনো উপায় নয়’। বলা হয়েছেÑ সামনে বর্ষা। প্রত্যেকে দুটি করে গাছ লাগন।
তাপমাত্রা ৪০ থেকে ৪৫, ৫০ হয়ে ৫৬-তে পৌঁছলে মানুষের বেঁচে থাকা কষ্টকর হয়ে পড়বে।
আমরা যদি এখনই সচেতন না হই, কেউ আমাদের বাঁচাতে আসবে না। ফেসবুকের পাতায় অনেকেই তাপমাত্রা
নিয়ে পোস্টের পর পোস্ট দিয়ে আমাদের সচেতন করার চেষ্টা করে চলেছেন। ভয়ানক তাপপ্রবাহে
দেশের বিভিন্ন স্থানে হিটস্ট্রেকে প্রাণহানির খবর আসছে। কত পশুপ্রাণী, কীটপতঙ্গ ও গাছগাছড়া
মারা যাচ্ছে, সে খবর আমরা রাখি না। তাপমাত্রা ৪৫ ডিগ্রি হলে রেললাইনগুলো বাঁকা হয়ে
যেতে পারে। ফলে দুর্ঘটনার আশঙ্কা বৃদ্ধি পাবে। রাস্তার পিচ গলে যাবে। ঈশ্বরদীর একজন
সাংবাদিকের ভিডিওতে দেখা যাচ্ছেÑ আজ ৪১ ডিগ্রি তাপমাত্রায় রাস্তার পিচ গলে গেছে। গলা
পিচে জুতা আটকে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে রোগবালাই।
শিশু ও বৃদ্ধদের স্বাস্থ্যঝুঁকি দেখা দিয়েছে।
এসির কথা এসেছে।
এসি কোনো প্রাকৃতিক বস্তু নয়। আমাদের সভ্যতার এক অতি প্রয়োজনীয় আবিষ্কার। আমার এক
ছেলে গতকাল একটি পোস্টে জানিয়েছে যে ঢাকার লাখ লাখ বাড়িতে ততধিক এসি ঢাকার বাতাস
উত্তপ্ত করে তুলছে। খাঁটি কথাই লিখেছে। এটা আমি বিশেষ করে উল্লেখ করলাম এজন্য যে, বর্তমানের
এই তাপমাত্রার বৃদ্ধির কারণ কেবল প্রাকৃতিক নয়। গবেষণায় প্রমাণিত যে আকাশস্পর্শী
বহুতল ভবন ও বর্ধিত মানুষের জলের সরবরাহের কারণে চীনের অর্ধেক শহর তলিয়ে যাচ্ছে। তার
মধ্যে রাজধানী বেইজিং ও বাণিজ্যিক শহর তিয়ানজিওও আছে। গবেষকরা বলছেন, শহর তলিয়ে যাওয়ার
ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক কারণ থাকলেও ভবন নির্মাণ ও ভূগর্ভস্থ পানি হ্রাস পাওয়াই মানবসৃষ্ট
প্রধান কারণ। বাংলাদেশের সর্বত্র ভূগর্ভস্থ পানি দ্রুত নেমে যাচ্ছে বলে গবেষকরা বলছেন।
তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে মানুষের অবদান ক্রমশই প্রাকৃতিক কারণগুলোকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। ১৯৬০
সাল থেকেই বিজ্ঞানীরা জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহতা সম্পর্কে সতর্কবাণী উচ্চারণ করে
আসছেন। অসত্য নয়, বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অপব্যবহার অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে।
ইতঃপূর্বে পাঁচটি
বরফ যুগ অতিক্রম করে আমরা ষষ্ঠ বরফ যুগের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। পঞ্চম বরফ যুগে প্রবল
প্রতাপশালী ডাইনোসর বিলুপ্ত হয়েছিল। তার আগে তারা প্রায় ছয় কোটি বছর পৃথিবী দাপিয়ে
বেড়িয়েছিল। তারপর জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে মাত্র তিন-চারশ বছরের মধ্যেই তারা বিলীন
হয়ে যায়। তখন পৃথিবীতে মানুষ নামের কোনো প্রাণী ছিল না। প্রকৃতির ক্ষতি করার জন্য
অন্য কোনো প্রাণীরও অস্তিত্ব ছিল না। সেসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছিল সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক।
কিন্ত মানুষের উদ্ভব মাত্র এক লাখ বছর। এক লাখ বছরের মধ্যে পঁচাত্তর হাজার বছর মানুষ
ছিল খাদ্যসংগ্রহকারী একটি পশু। মাত্র বারো হাজার বছর আগে মানুষ কৃষিকাজ করার মধ্য দিয়ে
সভ্যতার আদিম যুগে প্রবেশ করে। তারপর থেকে একটু একটু করে নানা অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক
ও সামাজিক পরিবর্তনের মাধ্যমে আজকের জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে। সভ্যতার এই ক্রমবিবর্তন
সম্পর্কে ইতিহাসবিদরা নানাভাবে বিভক্ত। তবে এর মধ্য থেকেই একটি সাধারণ ধারা চিহ্নিত
করা যায় এবং তা হলো মানুষের জ্ঞানবৃদ্ধি। মানুষ প্রকৃতির যেসব পরিবর্তন লক্ষ করত,
তা কোনো না কোনো দেবদেবীর কাজ বলে মনে করত একসময়। ক্রমে মানুষ মনে প্রকৃতির অভ্যন্তরীণ
ঐক্য লক্ষ করে। বর্তমানে তা সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত।
প্রাযুক্তিক ও
বৈজ্ঞানিক জ্ঞানবৃদ্ধির সঙ্গে তাল রেখে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির ধারা বর্তমানের
এক সংকটাপন্ন অবস্থার সৃষ্টি করেছে। একই সঙ্গে মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধির হার দ্রুততর
হয়েছে। বর্তমানে জনসংখ্যা আট বিলিয়ন অতিক্রম করেছে। এই বিপুলসংখ্যক মানুষের থাকা,
খাওয়া, পরার সব দায়িত্ব এসে পড়েছে মানুষেরই কাঁধে। জীবনযাপনের জন্য দরকার খাদ্য, জল,
বিশুদ্ধ বায়ু; সেজন্য দরকার ক্রমবর্ধমান আবাসিক এলাকা; বাড়তি মুখে খাবার তুলে দেওয়ার
জন্য দরকার কৃষিজমির সম্প্রসারণ; সুপেয় পানি সরবরাহের জন্য দরকার বিশালাকার পানি সংশোধনাগার;
তাদের চলাচলের জন্য দরকার উন্নতমানের যাতায়াত ব্যবস্থা ইত্যাদি। এর প্রত্যেকটির জন্য
প্রয়োজন মাটি, ভূমি। প্রয়োজন বাস্তবায়নের জন্য আমরা প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্ত জমির
ওপর চাপ সৃষ্টি করে চলেছি। এজন্য প্রতিদিন জঙ্গলাকীর্ণ পৃথিবীর জঙ্গল সাফ করছি। নদী-নালা-খাল-বিল
ভরাট করছি। বিশালাকার মনোমুগ্ধকর শহর, নগর, বন্দর গড়ার ফলে প্রকৃতির জল, স্হল, বনের
প্রাকৃতিক ভারসাম্য হারিয়ে যাচ্ছে। শুধু তাই নয়; বন্য প্রাণী হারাচ্ছে তাদের প্রাকৃতিক
আবাসস্হল। মানুষের দুর্দম গতি ও শক্তির কাছে তারা ক্রমান্বয়ে পরাজিত হয়ে বিলুপ্তির
মহাসড়কে যোগ দিতে বাধ্য হচ্ছে। ১৯৭০ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে পৃথিবীর শতকরা ৬৫ ভাগ প্রাণের
বিলুপ্তির কারণ হয়েছি আমরা অর্থাৎ মানুষ।
প্রকৃতির ওপর
নিয়ন্ত্রণ যেন আমাদের সর্বগ্রাসী। প্রকৃতিকে পরিবর্তন করার ক্ষমতার অধিকারীও যেন আমরাই।
এই সর্বগ্রাসী শক্তির অধিকার অর্জনই আজ মানুষের জন্য নয় শুধু, সমগ্র প্রাণের জন্য
হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুই দুটি বিশ্বযুদ্ধ ও অ্যাটম বোমা নিক্ষেপ তার ভয়াবহ উদাহরণ।
সামনে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাবনা দিন দিন গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। আজই নয়া ঔপনিবেশিক
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মধ্য প্রাচ্যের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ প্রলম্বিত করা ও মানুষ মারার
জন্য ছয় বিলিয়ন ডলারের বেশি বরাদ্দ করেছে। বিশ্বের ওপর প্রকৃতির প্রভাব কমে আসছে এবং
মানুষের নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। এতে বিপদের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সমাজ পরিবর্তনের
মূল শক্তি হিসেবে আজ আর এককভাবে প্রকৃতিকে দায়ী করা যায় না। মানুষের শক্তি প্রকৃতির
সে দায়িত্ব অনেকাংশেই দখল করেছে। আগামী ষষ্ঠ বরফ যুগ ত্বরান্বিত করছে মানুষের তৎপরতা।
তাই পৃথিবীকে
বাঁচাতে হলে অবশ্যই জাতিসংঘের জলবায়ুবিষয়ক সিদ্ধান্তটি কার্যকর করার কোনো বিকল্প
নেই। কিন্ত বাধা কোথায়? কে দিচ্ছে বাধা? খবরেই প্রকাশ, জি-২০ গ্রুপের ২০টি দেশ পৃথিবীর
মোট কার্বন প্রিন্টের ৮০ ভাগ উৎপাদন করছে। ফলে বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাসের মাত্রা
ক্রমশই বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। তদুপরি গ্রিনহাউস গ্যাস ও জ্বালানি হিসেবে কয়লা, তেল
ও গ্যাসের ব্যবহার প্রকৃতির ধ্বংসসাধন করছে। জাতিসংঘ তার সকল দেশের উপস্থিতিতে সিদ্ধান্ত
নিয়েছে, এগুলোর ব্যবহার সর্বনিম্ন পর্যায়ে নামিয়ে আনতেই হবে। ইতিহাস প্রমাণ করে,
শেষ না হওয়া পর্যন্ত কেবল সাবধানবাণী উচ্চারণে প্রকৃতির ক্রমাবনতির রাশ টানা যাবে না।
সেদিনের জন্য অপেক্ষা করা বনাম জাতিসংঘের সর্বসম্মত প্রস্তাবটি কার্যকর করা- কোন পথটি আমরা বেছে নেব?