× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীর প্রতিকৃতি

হোসেন আবদুল মান্নান

প্রকাশ : ২২ এপ্রিল ২০২৪ ১৬:১০ পিএম

আপডেট : ২২ এপ্রিল ২০২৪ ১৬:১৩ পিএম

প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীর প্রতিকৃতি

তিনি এতটাই রাশভারী গোছের মানুষ ছিলেন, সহজে কাছে ভেড়া যেত না। ছিলেন খুব মিতবাক এবং মূর্তিমান চেহারাসম্পন্ন বিরল ব্যক্তিত্ব। আমার কাছে বরাবরই তা মনে হয়েছে। অবশ্য সবার কাছে একই রকম ছিলেন না এবং সেটাই স্বাভাবিক। তবে নানা সময়ে সহকর্মীদের কাছ থেকে শোনা বা তার স্মৃতিধর্মী লেখা ও সাক্ষাৎকার পড়ে বা টেলিভিশনে পরিবারের সদস্যদের বক্তব্য থেকে তাকে বুঝতে পেরেছি। তিনি ছিলেন প্রকৃত অর্থে প্রজাতন্ত্রের একজন কর্মচারী এবং সত্যিকার দেশপ্রেমিক, সৎ, সাহসী ও বিবেকবান মানুষ।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও সরকারি কর্মকমিশনের চেয়ারম্যান প্রয়াত ড. সা’দত হুসাইনের কথা বলছি। পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের সদস্য এই কর্মকর্তা একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। চাকরির প্রথম দিকেই ঝুঁকি নিয়ে দেশমাতৃকার স্বাধিকারের ডাকে সাড়া দিয়ে প্রমাণ করেছিলেন তার নিঃশর্ত দেশপ্রেমবোধ। তরুণ বয়সেই মুজিবনগর সরকারের অধীনে দায়িত্ব পালন করে তার পেশাদারিত্ব প্রদর্শন করেন; যা সারা জীবন তিনি ধরে রেখেছেন নির্ভয়ে এবং সম্পূর্ণ বিচ্যুতিহীনভাবে। দীর্ঘ চাকরিজীবনে তিনি সরকারের অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর পদপদবি অলংকৃত করেছেন। বলা যায়, সামরিক-বেসামরিক- রাজনৈতিক-তত্ত্বাবধায়ক সব সরকারের অধীনে দায়িত্ব পালন করেছেন সততা ও নিরপেক্ষতার সঙ্গে।তিনি সব জায়গায় পরিবর্তন আনার চেষ্টা করে গেছেন। এমনকি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগেও। তিনি সব সময় প্রশিক্ষণ, পরিদর্শন এবং রিপোর্টিংয়ের ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করতেন। তার চারিত্রিক দৃঢ়তা, কঠিন মনোভাবাপন্নতা তথা অকুতোভয় হয়ে সিদ্ধান্ত প্রদান সিভিল সার্ভিসে তাকে লৌহমানবের অভিধায় পরিণত করেছিল। এমনকি তার বিরোধিতাকারীরা, বিপরীত মতাদর্শবাদীরা বা ঘোর অপছন্দকারীদেরও তার সততার প্রশ্নে কখনও দ্বিমত পোষণ করতে শুনিনি।

১৯৯৬ সালের শেষ দিকে তিনি তখন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা বিভাগের সচিব। আমি স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব ও বরেণ্য কথাসাহিত্যিক হাসনাত আবদুল হাইয়ের একান্ত সচিব হিসেবে কাজ করি। একদিন একটা চিঠির খাম হাতে দিয়ে সচিব আমাকে বললেন, ‘এটা ড. সা’দত হুসাইনের হাতে পৌঁছে দাও, ফোনে আলাপ করেছি।’ আমি পাশের ৬ নম্বর ভবনে গিয়ে অনুমতি নিয়ে তার হাতে খামটি তুলে দিলাম। তিনি মগ্নচিত্তে নথিতে লিখছিলেন। আমার দিকে সামান্য না তাকিয়ে বাঁ হাতে খামটা নিলেন। কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে ছিলাম, কিছু বলবেন কি না। না, তিনি বাঁ হাতের ইশারায় আমাকে চলে যেতে বললেন। সেদিন মনে বেশ কষ্ট পেয়েছিলাম। আশ্চর্য, তাকালেনও না কার কাছ থেকে কাগজটা নিলেন।

তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব। আমরা তখন সিনিয়র সহকারী সচিব পর্যায়ে সচিবালয়ে কাজ করি। আজিমপুর সরকারি কোয়ার্টারে থাকি। ছুটির দিনে বা এমনিতেই কাজে-অকাজে, বিনা প্রয়োজনে নিউমার্কেটে যাওয়া হতো। প্রায়ই দেখতাম তিনি হাতে ব্যাগ নিয়ে বাজার করছেন। অথচ সঙ্গে একজন সিভিল পোশাকের পুলিশের গানম্যান আছে। তার কাজ শুধু দূরে থেকে অনুসরণ করা। অনেকবার কৌতূহল নিয়ে দেখেছি তিনি কাঁচাবাজারে গিয়ে দামাদামি করছেন। আবার বাজারের ব্যাগ হাতে করে ফিরে এসে গেটের বাইরে থাকা গাড়িতে উঠছেন। আমরা বন্ধুরা মাঝেমধ্যে বিস্মিত হতাম, গল্প করতাম বিভিন্ন কর্মচারীর জীবনাচার নিয়ে। সিভিল সার্ভিস প্রশাসন ক্যাডারে কত সৎ ও ধার্মিক কর্মকর্তার মুখরোচক গল্প শুনেছি। কর্মস্থলে দুয়েকজনকে দেখেছিও। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে চাকরি করে ডিসির এলআর ফান্ড থেকে চা-নাশতার ব্যবস্থা করা হলে সে নাশতাও নিভৃতে এড়িয়ে গেছেন। তিনিও যেন তেমনি গল্পকথার এক অনন্য প্রতিচ্ছবি ছিলেন।

তাকে খুব কাছ থেকে দেখেছি অফিসার্স ক্লাব ঢাকার প্রেসিডেন্ট হিসেবে। ২০০৫-০৬ মেয়াদে আমি একবার সরাসরি ভোটে ক্লাবের নির্বাহী সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলাম। সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন শফিক আলম মেহেদী। বলা বাহুল্য, পরবর্তী (২০০৯-১০) মেয়াদে আমি ক্লাবের যুগ্মসম্পাদক পদেও একবার নির্বাচিত হয়েছিলাম। নির্বাহী কমিটির সভাপতি হিসেবে প্রতিটি সভা তার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হতো। নানা এজেন্ডা নিয়ে আলোচনা চলত। তিনি মনোযোগভরে শুনতেন, নোট নিতেন, সবাইকে বলতেও দিতেন কিন্তু সিদ্ধান্ত মনে হতো পূর্বনির্ধারিত। বিশেষ করে আর্থিক বিষয়ে তার কৃচ্ছ্রসাধনের নীতি শতভাগ বহাল থাকতে হবে। তিনি বলতেন, এখানে এত টাকা ব্যয় করা নিরর্থক, কোনো প্রয়োজন নেই; যা আছে তাতেই চলবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের মেধাবী ছাত্র ছিলেন। উচ্চতর পড়াশোনা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের বস্টনে। প্রায়ই বলতেন, অর্থনীতিতে মানুষ হলো ‘ইকোনমিক এজেন্ট’। 

অফিসার্স ক্লাব থেকে নির্বাচিত নির্বাহীরা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে যাবেন। এ ধরনের সাক্ষাৎ একটা ট্র্যাডিশন বা রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। নেতৃত্বে ক্লাব সভাপতি নিজেই। কমিটি যথারীতি যথাসময়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে গিয়ে হাজির হলো। একটু দূরে তবে সোজা প্রধানমন্ত্রীর মুখোমুখি বসেছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব হিসেবে তিনি এবং মুখ্য সচিব ড. কামাল সিদ্দিকী। আমরা কনিষ্ঠ সদস্যরা পেছনে দাঁড়িয়ে। দেখেছিলাম পা ক্রস করে বসে কতটা স্বতঃস্ফূর্ত ও নিঃসংকোচে তিনি তার স্বভাবসুলভ কথা বলেছেন। মনে হয়েছিল ঘরোয়া কোনো পরিবেশ। তার অসামান্য ও উঁচুমানের ব্যক্তিত্ব সর্বত্র প্রকাশিত ছিল।

এর পরে আর কোনো দিন তার সঙ্গে দেখা হয়নি, কথাও হয়নি। তিনি পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান। আমিও মাঠের বিভিন্ন পদে ঢাকার বাইরে কর্মরত। পরে পত্রিকায় তার কলাম পড়ে বা টেলিভিশন টকশো দেখে তার প্রতি শ্রদ্ধা ক্রমাগত আরও বেড়ে যায়। শুনেছিলাম তিনি ইংরেজিতে আত্মজীবনী লিখছেন। তবে ইংরেজি ভাষায় তার অপরিসীম দক্ষতা ছিল। ট্রেনিং, ডেভেলপমেন্ট বিষয়ে বেশ কিছু মূল্যবান বইয়ের লেখকও তিনি। মনে পড়ে পিএসসির চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি সম্ভবত তিন সরকারের সময়ই কাজ করেছিলেন। শেষের দিকে তার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ এনে শহীদ মিনারে দীর্ঘকালীন আন্দোলন চলতে থাকে। বিশেষ করে কোটা পদ্ধতি, মেধা তালিকা, প্রশ্নপত্র ফাঁস কত কিছুÑসব মনে পড়ছে না। উল্লেখ্য, এত সব সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে পূর্ণমেয়াদে দায়িত্ব পালন করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। তখন ব্যানারে অনেক কিছুর সঙ্গে ‘দুর্নীতিবাজ পিএসসি চেয়ারম্যানের অপসারণ চাই’ কথাটি দেখে আমরা হতাশ হয়েছিলাম এবং একই সঙ্গে মৃদু হেসে বলেছিলাম,‘ওরে বাছা, ওরে অর্বাচীনের দল, / তোরা মানুষ চিনিস না, / চিনেছিস শুধু টাকা।’

২০২০ সালে ড. সা’দত হুসাইন অনন্তলোকে পাড়ি দেন। মানুষের জীবৎকাল হ্রস্ব এবং ক্ষণস্থায়ী। কিন্তু তার কর্মগুলো অনেক দিন বেঁচে থাকে, কথা বলে, আলো ছড়ায়। আমাদের সময়ের প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের মধ্যে ড. সা’দত হুসাইন নিঃসন্দেহে এক অনুসরণীয় নাম। আজ তাঁর প্রয়াণ দিবসে বিনম্র শ্রদ্ধায় তাঁকে স্মরণ করি। 

হোসেন আবদুল মান্নান

সাবেক সচিব, গল্পকার 

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা