× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

আবহাওয়া কেন চরমভাবাপন্ন হলো

ড. মোহাম্মদ জহিরুল হক

প্রকাশ : ২২ এপ্রিল ২০২৪ ১৬:০৪ পিএম

আপডেট : ২২ এপ্রিল ২০২৪ ১৬:১৩ পিএম

আবহাওয়া কেন চরমভাবাপন্ন হলো

বিগত কয়েক বছর বাংলাদেশসহ সারা বিশ্ব অস্বস্তিকর আবহাওয়ার অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করছে, যা কেবল প্রাণিকুলের অস্তিত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ নয়; উদ্ভিদ তথা ফসল উৎপাদন ব্যবস্থাকেও নাজুক করে তুলেছে। আবহাওয়ার চরম রূপ কেবল গরম এলে তীব্র গরম বা তাপপ্রবাহের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং শীতকালে কোনো বছর তীব্র শীত আবার কোনো বছর একেবারে শীতের প্রভাব না পড়া, শীত ও গ্রীষ্মের সূচির পরিবর্তন, ঋতু হারিয়ে যাওয়া, সারা বছর গড় তাপমাত্রার পরিবর্তন, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টিসহ আবহাওয়ার প্রতিটি দিকের ব্যাপক তারতম্য পরিলক্ষিত হচ্ছে। সারা বিশ্বই আবহাওয়ার এই চরম আচরণের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করছে। কোথাও তা তীব্র, কোথাও কিছুটা সহনীয়। মূলত পৃথিবী ক্রমশ উষ্ণ হচ্ছে আর সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আবহাওয়া বৈরী আচরণ করছে। এটা হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য, যার প্রভাব আজ পৃথিবীর সর্বত্র। তবে অনেক দেশ জ্ঞান-বিজ্ঞান ও গবেষণার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে আবহাওয়ার বৈরী আচরণের সঙ্গে খাপখাইয়ে ক্ষতির পরিমাণ সীমিত রাখতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের মতো ক্রান্তীয় ও উপকূলবর্তী দেশগুলোর অবস্থা তথৈবচ।

জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিরূপ আবহাওয়ার প্রভাবের সবচেয়ে হুমকিতে থাকা অঞ্চল হচ্ছে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, লাওস, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামসহ ১১টি দেশ কয়েক বছর ধরে শুষ্ক মৌসুমে তীব্র তাপদাহে পুড়ছে। এসব দেশে বিগত বছরের প্রতিটি মাসেই মোটামুটি তাপমাত্রার রেকর্ড ভেঙে চলেছে। ১৯৬০ সাল থেকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়ছে এতদঞ্চলে। তাপমাত্রা ধীরে ধীরে বেড়ে ২০২৪ সালে এসে আবহাওয়ার অস্বস্তিকর প্রভাবের দরুন প্রাণী ও উদ্ভিদকুলকে অস্তিত্ব সংকটের মুখে ফেলেছে। ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ডও ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার বার্তা মিলেছে। হিট স্ট্রোকে প্রাণ হারাচ্ছেন অনেকে। এ তাপমাত্রা বৃদ্ধি কোথায় গিয়ে থামবে তার ভবিষ্যদ্বাণী পরিবেশ ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা আপাতত করতে পারছেন না। 

বাংলাদেশের জলবায়ুর বৈশিষ্ট্য ছিল মোটামুটি উষ্ণ, আর্দ্র ও সমভাবাপন্ন। এখনও জলবায়ু, আবহাওয়া ও পরিবেশ-সংক্রান্ত রচনায় বাংলাদেশের জলবায়ু সমভাবাপন্ন হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু বিগত কয়েক বছরের আবহাওয়ার বৈরী আচরণে বাংলাদেশের জলবায়ুকে আর সমভাবাপন্ন বলা চলে না; বরং সেটা চরমভাবাপন্ন। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বাংলাদেশে চরমভাবেই পড়ছে। বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়া ও কর্মকাণ্ড জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য ততটা দায়ী নয়; যতটা সর্বোচ্চ কার্বন নির্গমনকারী উন্নত দেশগুলো দায়ী। উন্নত ও শিল্পোন্নত দেশগুলো বায়ুমণ্ডলে কার্বন নির্গমন করে সবচেয়ে বেশি। আর এর নেতিবাচক প্রভাবের নির্মম শিকার বাংলাদেশের মতো দেশগুলো। কিন্তু বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের বৈরী প্রভাব মোকাবিলায় যা করণীয় এখনও তা থেকে অনেকটা দূরে। অনেকের অবিবেচক কর্মকাণ্ডের খেসারত বাংলাদেশকে হাড়ে হাড়ে দিতে হচ্ছে। চলতি সপ্তাহজুড়ে দেশব্যাপী তীব্র তাপদাহ হচ্ছে এর বাস্তবতা।

তীব্র তাপদাহ বয়ে যাওয়া কেবল জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব হিসেবেই দেখলে হবে না। পরিবেশ সংরক্ষণে আমাদের চরম ব্যর্থতা ও পরিবেশের প্রতি আমাদের বৈরী আচরণের ফলাফল আবহাওয়ার অস্বস্তিকর অবস্থার জন্য কম দায়ী নয়। আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য নিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের সর্বত্র তাপপ্রবাহ বইছে। এ সপ্তাহে দেশে তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৪০ ডিগ্রির ওপরে। বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে তাপমাত্রা এত বেশি হওয়ার রেকর্ড খোদ আবহাওয়া অধিদপ্তরে নেই। আবহাওয়া অধিদপ্তর আশঙ্কা করছে এ সপ্তাহে তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়াতে পারে। এদিকে গত শনিবার (২০ এপ্রিল) বিকাল পর্যন্ত দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল চুয়াডাঙ্গায় (৪১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস)। সাতক্ষীরা ও টাঙ্গাইলে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস, কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে ৪০ দশমিক ২, খুলনায় ৪০ দশমিক ৭, খুলনার মোংলা, রাজশাহী ও পাবনার ঈশ্বরদীতে ৪১ এবং যশোরের তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৪১ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস (বাংলা ট্রিবিউন, ২০ এপ্রিল ২০২৪)। ২০১৬ সালে দেশের সার্বিক তাপমাত্রা ১ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লেও ২০২৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

যদি কোনো এলাকায় ৩ থেকে ৫ দিন তাপমাত্রা অতি বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাতাসে আর্দ্রতা বেড়ে যায়, তাহলে এই পরিস্থিতিকে তাপপ্রবাহ বলে। সেক্ষেত্রে দাবানলের ঝুঁকি থাকে। দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় হিট অ্যালার্ট জারি করা হয়েছে। স্কুল-কলেজ এক সপ্তাহের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। প্রয়োজনে তা আরও বাড়ানো হতে পারে। স্বাস্থ্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে এপ্রিল-মে মাসে তাপপ্রবাহ বয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটছে। হিট অ্যালার্ট আজ পরিচিত একটি প্রপঞ্চ। স্কুল-কলেজ বন্ধ ঘোষণার মতো ঘটনা তেমন একটা ঘটে না। তবে স্কুলের সময় এগিয়ে নেওয়ার সঙ্গে আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো পরিচিত। যাদের বাসা, গাড়ি, ও অফিস শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত তাদের তাপমাত্রায় কিছু আসে-যায় না। সমস্যা হলো খেটে খাওয়া মানুষের। যারা আগাম বন্যার ঝুঁকিতে থাকা হাওর এলাকায় বোরো ধান কাটার শ্রমিক তাদের। সঙ্গে রয়েছে কালবৈশাখীর চোখ রাঙানো ও বিগত কয়েক বছরে বেড়ে যাওয়া বজ্রপাতের হার। তাপপ্রবাহে ফসল ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি সম্পর্কেও এদেশের মানুষ ওয়াকিবহাল। অতিরিক্ত গরম বাতাস প্রবাহিত হলে ধানের শিষ থেকে পানি শুকিয়ে যাওয়ায় চারা থেকে ধান বের হয় না, শিষের শাখা বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। আবার ধান যদি বের হয় তা চিটা হয়ে যায়। জনস্বাস্থ্যও হুমকিতে।

তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রধান কারণ হিসেবে জীবাশ্ম জ্বালানির অতি ব্যবহারকে মূলত চিহ্নিত করা হয়। এর ফলে বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাস বিশেষ করে কার্বন নির্গমন বৃদ্ধি পায়। ফলে সূর্যের তাপ বায়ুমণ্ডলে কোনো ধরনের বাধাপ্রাপ্ত না হয়ে সরাসরি ভূমিতে পড়ে। বৃক্ষ বায়ুমণ্ডলের কার্বন শোষণ করে পরিবেশের ভারসাম্য নিশ্চিত করে। বন উজাড় বা অবাধে বৃক্ষ নিধনের ফলে গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমন বৃদ্ধি পেয়ে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন দায়ী হলেও বাংলাদেশে পরিবেশবিধ্বংসী কিছু কর্মকাণ্ড তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে দিন দিন ত্বরান্বিত করছে। যে বনের কাজ হলো বায়ুমণ্ডলের ক্ষতিকর গ্রিনহাউস গ্যাসসমূহকে শোষণ করা, সেই বন আমরা উজাড় করছি নির্বিঘ্নে। বনভূমি হলো পৃথিবীর ফুসফুস। বনভূমি কার্বন শোষণের পাশাপাশি এর গাছগুলো ছায়া সরবরাহের মাধ্যমে মাটিকে আর্দ্র রাখে। তাতে পরিবেশ থাকে সুরক্ষিত। দেশের মোট ভূমির ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকার কথা থাকলেও বাংলাদেশে বন উজাড়ের ফলে তা দাঁড়িয়েছে ১১ থেকে ১২ শতাংশে। বন ও পরিবেশ মন্ত্রী সংসদকে জানিয়েছেন, দেশে ১৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ বনভূমি রয়েছে। বাংলাদেশে স্বাধীনতা-পরবর্তী মাথাপিছু বনের পরিমাণ ০.৩৮ হেক্টর থাকলেও বর্তমানে রয়েছে মাত্র ০.০২ হেক্টর।

এ ছাড়া বন বিভাগের সম্পদ বা বনভূমি হিসেবে শ্রেণিকৃত ভূমি থেকে গাছপালা কেটে তাতে অবকাঠামো নির্মাণসহ নানাবিধ কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। খোদ মন্ত্রীই জাতীয় সংসদে জানিয়েছেন, ২ লাখ ৫৭ হাজার একর বনভূমি জবরদখল হয়েছে। বনভূমি হতে হলে প্রতি হেক্টর জমিতে অন্তত ০.০৫ হেক্টরে বিভিন্ন ধরনের গাছপালা থাকতে হবে। বাংলাদেশে বনভূমি হিসেবে স্বীকৃত ভূমিতে উপযুক্ত পরিমাণ বৃক্ষ নেই। বন উজাড় কোনো স্থানীয় ইস্যূ নয়; এটিও একটি বৈশ্বিক প্রপঞ্চ। সারা বিশ্বেই বন উজাড় হচ্ছে। তবে বাংলাদেশে বন উজাড়ের হার সারা বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। ২০০০-২০২৫ সালে সারা বিশ্বে বন উজাড়ের হার প্রায় ১ দশমিক ৪ শতাংশ হলেও বাংলাদেশে ছিল তা ২ দশমিক ৬ শতাংশ। দেশে বছরে গড়ে ২ হাজার ৬০০ হেক্টর বন উজাড় হচ্ছে। বাংলাদেশ সংরক্ষিত বনের গাছ কাটার ঘটনা একটি মামুলি ব্যাপার। শুধু বন উজাড় নয়; পার্বত্য চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম, সিলেট ও শেরপুর-নেত্রকোণা সীমান্তবর্তী অঞ্চলে টিলা কেটে সমতল ভূমিতে রূপান্তর করা এখন স্বাভাবিক ঘটনা। কেবল সিলেটে প্রায় ১ হাজার ৭৪৫টি টিলা কেটে সমান করা হয়েছে। এসব টিলার সবুজ ভূমি ধূসর হয়েছে।

জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিরোধ করার ক্ষমতা পুরোপুরি আমাদের হাতে নেই। জলবায়ু পরিবর্তনের নির্মমতার শিকার আমাদের মতো দেশগুলোকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দরকষাকষির পাশাপাশি এ পরিবর্তনের সঙ্গে খাপখাইয়ে নিয়ে টিকে থাকার পন্থা বের করা এ মুহূর্তে জরুরি। বন উজাড়, পাহাড়-টিলা ধ্বংস, নদ-নদী ও জলাশয় ভরাট রোধ করতে হবে আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে। হাওরের বুকে ১৪ কিলোমিটার রাস্তায় আল্পনার রেকর্ড না করে দেশে কয়েক কোটি গাছ লাগানো, টিকে থাকা টিলাগুলোকে সংরক্ষণ ও অন্তত ২৫ শতাংশ বনভূমি নিশ্চিতের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। কার্বন নির্গমন বন্ধ করে, গাছপালা লাগিয়ে, পাহাড়-টিলা, নদী-জলাশয় রক্ষা করে পরিস্থিত উন্নতির জন্য অন্তত এ সময়টুকু তথা কয়েক দশক অপেক্ষা করতেই হবে।

ড. মোহাম্মদ জহিরুল হক

জলবায়ু ও পরিবেশ গবেষক। উপাচার্য, মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটি, সিলেট

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা