সম্পাদকীয়
প্রকাশ : ২১ এপ্রিল ২০২৪ ১২:০৮ পিএম
চলমান দাবদাহে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। ২০ এপ্রিল প্রতিদিনের
বাংলাদেশের শীর্ষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘তাপে বিপর্যস্ত দেশ, হিট অ্যালার্ট জারি’।
বিক্ষিপ্তভাবে দেশের দুয়েকটি স্থানে বৃষ্টি হলেও দেশজুড়ে বৃষ্টির কোনো সম্ভাবনা আবহাওয়া
অধিদপ্তর সূত্রে মেলেনি। উপরন্তু বলা হয়েছে, দাবদাহ চলবে আরও কয়েক দিন। তীব্র দাবদাহের
কারণে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান
২৭ এপ্রিল পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। আমরা জানি, দীর্ঘ ছুটির পর আজ দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান
খোলার কথা ছিল। চলমান দাবদাহে শিক্ষার্থীদের বিশেষ করে শিশু শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য
সুরক্ষা বিবেচনায় এই সিদ্ধান্তকে আমরা স্বাগত জানাই। ঋতুর চরিত্রগত কারণে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ
মাসে গরম এমনিতেই থাকে। কিন্তু এবার এর তীব্রতা বেড়েছে। এই ভূখণ্ডে ষড়ঋতুর যে চারিত্রিক
বৈশিষ্ট্য একসময় মানুষের কাছে উপভোগ্য ছিল এখন ক্রমেই জলবায়ু পরিবর্তনজনিত এবং কতিপয়
মানুষের অপরিণামদর্শী কর্মকাণ্ডে তা প্রায় হারিয়ে গেছে। প্রকৃতি বিশেষ করে সবুজের ওপর
কারও কারও আক্রোশ জনজীবনে অসহনীয়তা সৃষ্টির জন্য অনেকাংশে দায়ী।
আমাদের প্রাকৃতিক রূপগত সৌন্দর্য এবং বছরের নির্দিষ্ট খণ্ড খণ্ড সময়ে
বৈশিষ্ট্য শুধু জনজীবনেই নয়, কৃষিপ্রধান এ দেশে শস্য উৎপাদন ব্যবস্থায়ও বহুমাত্রিক
ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু এখন সেক্ষেত্রেও অভিঘাত লেগেছে। গ্রীষ্মের দাবদাহে যখন
প্রাণ ওষ্ঠাগত, এক বিন্দু জলের জন্য প্রাণিকুলের হাপিত্যেশ, তখন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুর প্রকৃতিকে বলেছেন, ‘তুমি কত নির্মম হবে হও, সেই নির্মমতার সঙ্গেই হবে আমার মিলন’।
তিনি লিখেছেন, ‘নাই রস নাই, দারুণ দহনবেলা/ খেলো খেলো তব নিরব হইলো খেলা/ যদি ঝরে পড়ে
পড়ুক পাতা,/ ম্লান হয়ে যাক মালাগাঁথা/ থাক জনহীন পথে পথে মরীচিকাজাল ফেলা।/ শুষ্ক ধুলোয়
খসে পড়া ফুলদলে/ ঘূর্ণি-আঁচল উড়াও আকাশতলে।/প্রাণ যদি করো মরুসম/ তবে তা-ই হোক হে নির্মম,/তুমি
একা আর আমি একা/কঠোর মিলনমেলা’। কবির এ কাব্যপঙ্ক্তির মধ্য দিয়ে শুধু প্রচণ্ড দাবদাহের
রুষ্টতার চিত্রই চিত্রিত হয়নি, একই সঙ্গে প্রকৃতির ঊর্ধ্বমুখী তাপের সঙ্গে জনজীবনের
সহনীয়তার বিষয়টিও উঠে এসেছে। এই ভূখণ্ডের মানুষ নানারকম প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সঙ্গে
পরিচিত এবং প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করে টিকে থাকার সাহসের ঘাটতি নেই। কিন্তু তারপরও
কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরিস্থিতি মোকাবিলা করা মানুষের পক্ষে অনেক সময়ই দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে।
দেশে গত কয়েক দিন ধরে যে দাবদাহ চলছে, এর পরিপ্রেক্ষিতে জনস্বাস্থ্যের সুরক্ষায় উদ্বিগ্ন
না হওয়ার উপায় নেই। নানারকম রোগব্যাধি বাড়ছে, বিশেষ করে শিশু ও বয়স্কদের জন্য পরিস্থিতি
বেশি অসহনীয় হয়ে পড়েছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দেশে তাপমাত্রা বেড়েই চলেছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধি
কিংবা হ্রাস পাওয়া প্রকৃতির স্বাভাবিক বিষয় হলেও এই স্বাভাবিকতা বিনষ্ট হয়েছে। আগেই
বলেছিÑ একদিকে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে, অন্যদিকে কতিপয় মানুষের লোভাতুর মনোভাব প্রকৃতির
বৈরী আচরণ প্রকট করে তুলছে। চলমান দাবদাহে বিপাকে পড়েছে নিম্ন আয়ের খেটে খাওয়া মানুষেরা।
এর মধ্যে লোডশেডিং বাড়তি উপসর্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মহানগর-নগরে লোডশেডিং তুলনামূলক অনেকটা
কম হলেও মফস্বলে তা প্রকট রূপ নিয়েছে। নগণ্যসংখ্যককে তুষ্ট করে বৃহদাংশকে রুষ্ট করা
কোনোভাবেই সংগত নয় বলে আমরা মনে করি। দাবদাহের অসহনীয়তা থেকে মানুষকে রক্ষায় বিদ্যুৎ
সরবরাহে সাম্যের বিষয়টি আমলে রাখা প্রয়োজন। এ মৌসুমে স্বাভাবিক কারণেই বিদ্যুতের চাহিদা
তুলনামূলক হারে বাড়ে, কিন্তু এর মধ্যে অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে বিদ্যুৎ চুরি ও অপচয় এক্ষেত্রে
আরেকটি বাড়তি অনুষঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে আমরা সে দিকটিতেও গভীর নজর
দেওয়ার তাগিদ দিই।
পরিবেশ ও জলবায়ু গবেষকদের অভিমত, তাপমাত্রা বাড়লে স্বাভাবিকভাবেই
বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনাও দেখা দেয়। কিন্তু প্রকৃতির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য পরিবর্তনের ফলে
এক্ষেত্রেও বিভ্রাট দেখা দিয়েছে। বৃক্ষরাজি কিংবা বনভূমি প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায়
অন্যতম মুখ্য ভূমিকা পালন করে। কিন্তু নির্বিচারে বৃক্ষনিধন এবং সংরক্ষিত ও সামাজিক
বনায়নে সংশ্লিষ্ট অসাধু দায়িত্বশীল ও সমাজের বলবানদের লোভের আগ্রাসনের কারণেও দুর্বিষহ
পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। বন্দরনগরী চট্টগ্রামে চলমান দাবদাহে সুপেয় পানির সংকট নগরবাসীর
জীবন আরও অতিষ্ঠ করে তুলেছে। প্রশ্ন উঠেছে, এই জরুরি মুহূর্তে ওয়াসার ভূমিকা নিয়ে।
আমরা জানি, পানির অপর নাম জীবন। আর চলমান দাবদাহে তা আরও বেশি অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।
সুপেয় পানি-বিদ্যুতের ক্ষেত্রে বৈষম্য ঘোচানোয় বাড়তি নজর দেওয়া উচিত। আবহাওয়া অধিদপ্তরের
বরাত দিয়ে এও বলা হয়েছে, তাপপ্রবাহের কারণে জলীয়বাষ্পের আধিক্যের ফলে অস্বস্তি আরও
বাড়তে পারে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা থেকে বলা হয়েছে,
আবহাওয়ার দিকে তাদের বাড়তি নজর রয়েছে এবং হিট স্ট্রোকের মতো জরুরি স্বাস্থ্য পরিস্থিতি
মোকাবিলায় তারা প্রস্তুত রয়েছে। আমরা মনে করি, একেবারে প্রত্যন্ত অঞ্চলের স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্রগুলোর
সেবা নিরবচ্ছিন্ন করতে বিশেষ পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। প্রকৃতির ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর আমাদের
হাত নেই তা সত্য। কিন্তু মনে রাখতে হবে, মনুষ্যসৃষ্ট কারণে যাতে প্রকৃতি আরও ক্ষিপ্ত
হয়ে না ওঠেÑ এ ব্যাপারে সজাগ থাকতে হবেই। গত কয়েক বছরে সবচেয়ে বেশি বায়ুদূষণের নগর
হিসেবে রেকর্ড করেছে রাজধানী ঢাকা। বৈশ্বিক, আঞ্চলিক ও স্থানীয়Ñ এই তিনটি কারণে আমাদের
এই ভূখণ্ডে তাপমাত্রা ক্রমাগত বাড়ছে। এই প্রেক্ষাপটে সর্বত্র সবুজায়নের দিকে গুরুত্ব
দেওয়ার পাশাপাশি প্রকৃতির সুরক্ষায় দায়িত্ববান হওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। উচ্চ তাপমাত্রার
ফলে মানুষের শ্রম উৎপাদনশীলতা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় এর অভিঘাত লাগছে অর্থনীতিতেও।
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে জনস্বাস্থ্যের সুরক্ষায় সচেতন ও সতর্ক থাকতেই
হবে। আবহাওয়া অধিদপ্তর সতর্কবার্তা দিয়ে মানুষকে সচেতন-সতর্ক থাকার পরামর্শ দিলেও আমরা
মনে করি, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে মানুষকে কিছুটা হলেও যাতে স্বস্তি দেওয়া যায় সেই অনুষঙ্গগুলো
নিশ্চিত করার দায় সরকারের। ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার করণীয় কাজগুলো
সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে যূথবদ্ধভাবে করতে হবে। আমাদের ষড়ঋতুর পরিবর্তনজনিত কারণগুলো
চিহ্নিত করে এরও প্রতিবিধানে পদক্ষেপ নেওয়া বাঞ্ছনীয়। আমরা দেখছি, গ্রীষ্মকাল দীর্ঘায়িত
হচ্ছে, শীতকাল সংকুচিত হচ্ছে আর বর্ষাকাল অনেক দেরিতে আসছে। প্রকৃতির রুদ্ররূপ নিরসনে
তার ওপর অভিঘাত বন্ধ করতেই হবে।