× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

লোকসভা নির্বাচন

বাংলাদেশ শুধু ভারতের প্রতিবেশীই নয়, কৌশলগত মিত্রও

আবদুল মান্নান

প্রকাশ : ২১ এপ্রিল ২০২৪ ১২:০৪ পিএম

বাংলাদেশ শুধু ভারতের প্রতিবেশীই নয়, কৌশলগত মিত্রও

১৯ এপ্রিল পড়শি ভারতে শুরু হলো সাধারণ নির্বাচন। প্রায় ৯৭ কোটি নিবন্ধিত ভোটার ৪৪ দিনব্যাপী এ নির্বাচনে ৫৫ লাখ ইভিএমে ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন। ভারতে ব্যালট পেপারে এখন আর ভোট হয় না আর তা নিয়ে কোনো হইচইও কেউ করেন না; যেমনটি দেখা যায় বাংলাদেশে। ভোটাররা ভারতের পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ তথা লোকসভার জন্য ৫৪৩ জন সদস্য নির্বাচন করবেন। সম্পূর্ণ ভোট পর্ব শেষ হবে ১ জুন। ভোট গণনা শেষ হবে ৭ জুন। সরকার গঠনে যেকোনো দল বা জোটকে ২৭২ জন সংসদ সদস্যের সমর্থন প্রয়োজন হবে। বহুদলীয় গণতন্ত্র হিসেবে ভারতের নির্বাচনে বিভিন্ন জাতীয় ও আঞ্চলিক দল ভোটের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। কিন্তু দুটি প্রধান জোট জাতিকে নেতৃত্ব দেওয়ার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে সরাসরি মুখোমুখি হচ্ছেÑপ্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) নেতৃত্বাধীন জাতীয় গণতান্ত্রিক জোট (এনডিএ) এবং ২৬টি দলের একটি জোট, যাকে বলা হচ্ছে ভারতীয় জাতীয় উন্নয়ন-অন্তর্ভুক্তি মূলক জোট, যার নেতৃত্বে আছে প্রধান বিরোধী দল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস। এ নির্বাচনে কোনো একটি দল এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হবে তা সচেতন কেউ আশা করেন না।

নানা কারণে ভারতের নির্বাচন বিশ্বের প্রায় সব দেশের চেয়ে ব্যতিক্রমী। ভারত এখন বিশ্বের একটি উদীয়মান অর্থনৈতিক পরাশক্তি। ভারতের মতো বিশ্বের কোনো দেশে এত বেশি ভোটার নেই। এত দীর্ঘ সময় ধরে কোনো দেশে ভোটপর্বও অনুষ্ঠিত হয় না। স্থানীয় পর্যায়ে কোনো দেশে এত রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশগ্রহণও করে না। আসলে বাস্তবে ভারত হচ্ছে একটি দেশের মধ্যে অনেক দেশ। এক অঞ্চলের ভাষার সঙ্গে অন্য অঞ্চলের ভাষা, সংস্কৃতি বা ইতিহাস-ঐতিহ্য কোনো কিছুরই তেমন একটা মিল নেই। দেশটিতে আছে কয়েক ডজন পৃথক নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠী। উত্তর-পূর্ব ভারতের কোনো কোনো অঞ্চল আছে যেখানে মানুষ ভারতের শাসন মানতেও নারাজ। মণিপুর, নাগাল্যান্ড এর অন্যতম। সেখানেও ভোট হয় নিরাপত্তা বাহিনীর সহায়তায়। এবার নির্বাচনের আগে কিছু ঘটনা ঘটেছে; যা বিভিন্ন দলের ভোটের প্রচারাভিযান ও নির্বাচনী রাজনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। আমাদের পাশের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায়। এর আগে ১৯৭৭ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত এ রাজ্য বামফ্রন্ট শাসন করেছে। ২০১১ সালে মমতার তৃণমূলের কাছে পরাজিত হওয়ার পর তাদের সূর্য অনেকটা অস্তমিত। অদূর ভবিষ্যতে তাদের ক্ষমতায় ফেরার কোনো সম্ভাবনা নেই। তারও আগে দীর্ঘ সময় ধরে পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস সরকারে ছিল; তা-ও এখন ইতিহাস। পশ্চিমবঙ্গে যে দলই ক্ষমতায় থাকুক তারা অনেকটা নিজেদের স্বার্থে বাংলাদেশের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করেছে। কিছুটা ব্যতিক্রম মমতার নেতৃত্বাধীন তৃণমূল। মমতার কারণে এখন পর্যন্ত তিস্তা নদীর পানি বণ্টন সমস্যাটি ঝুলে আছে এবং এ নিয়ে সংবাদমাধ্যম তো বটেই, দুই দেশের সামাজিক-রাজনৈতিক পরিসরেও কথা কম হয়নি বা হচ্ছে না।

চলমান নির্বাচনের আগে দুটি দল খানিকটা চাপে পড়েছে। এর একটি তৃণমূল কংগ্রেস। কিছুদিন ধরে তাদের দলের শীর্ষ পর্যায়ের কিছু নেতা দুর্নীতির দায়ে আটক আছেন। এর মধ্যে যেমন আছেন মন্ত্রী তেমন আছেন স্থানীয় পর্যায়ের নেতা যারা এ নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারতেন। কয়েকজন অনেকটা চাপে পড়ে দলছুটও হয়েছেন। তার পরও মমতা সাহস হারাননি। জনগণের মধ্যে তার একটা গ্রহণযোগ্যতা আছে; কারণ তার বিকল্প এখনও পশ্চিমবঙ্গে তৈরি হয়নি। কেন্দ্রের শাসকদল বিজেপি চেষ্টা করছে কিন্তু এখনও তেমন একটা সুবিধা করতে পারেনি। কংগ্রেসের তেমন একটা অস্তিত্বও এ রাজ্যে চোখে পড়ে না। ভারতে মুসলমানের সংখ্যা প্রায় ২০ কোটি। সরকারে যে-ই থাকুক তারা তাদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা চান। এটি সত্য, তারা শাসকদল বিজেপির হিন্দুত্ববাদী স্লোগানে অস্বস্তি বোধ করেন; কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিরাপত্তার অভাবও আছে। তার পরও তাদের সামনে তেমন কোনো বিকল্প নেই। তারা ভোট না দিয়ে ভোটের দিন ঘরে বসে থাকতে পারেন।

দিল্লির আম আদমি পার্টির সভাপতি অরবিন্দ কেজরিওয়াল। তিনি দিল্লির মুখ্যমন্ত্রীও। সাধারণ মানুষের কাছে বেশ জনপ্রিয়। তাকে কদিন আগে দুর্নীতির দায়ে আটক করা হয়। তিনি নির্বাচনে অংশ নিতে পারছেন না, তবে তার দল অংশ নিচ্ছে। অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের একাধিক হেভিওয়েট নেতাকে নানা অভিযোগে জেলে পোরা হলেও দলটি সব কটি আসনে প্রার্থী দিয়েছে। পাকিস্তানের ইমরান খান কারাবন্দি থাকলেও তার দল নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। ভারত-পাকিস্তানের রাজনীতিকদের সঙ্গে এখানেই বাংলাদেশের বিএনপির তফাত। তৃণমূল বা আম আদমি পার্টি গোঁ ধরেনি তাদের নেতাদের মুক্তি না দিলে নির্বাচনে অংশ নেবে না। একটি রাজনৈতিক দলের জন্য নির্বাচন বর্জনের চেয়ে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত আর কিছু হতে পারে না। এ মুহূর্তে আগাম বলা কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ হলেও অভিজ্ঞতা থেকে বলা যেতে পারে পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল, দিল্লিতে আম আদমি পার্টি আর কেন্দ্রে বিজেপি নেতৃত্বাধীন জোট এনডিএ’র জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তাই যদি হয় তাহলে নরেন্দ্র মোদি টানা তৃতীয়বারের মতো ভারতের প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।

বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যেমন ভারতের প্রচুর আগ্রহ থাকে, একই রকমভাবে ভারতের নির্বাচন নিয়েও বাংলাদেশের আগ্রহ আছে। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের যেমন আছে বড় ধরনের বাণিজ্যস্বার্থ, তেমন আছে রাজনৈতিক তথা নিরাপত্তাজনিত স্বার্থ। বাংলাদেশ ভারত থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য ছাড়াও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে শিল্পজাত কাঁচামাল আমদানি করে। দু’দেশের মধ্যে সম্পর্কের রূপরেখা বহুমাত্রিক। বাংলাদেশের বন্দর, রেলপথ, সড়কপথ ও জলপথ ব্যবহার করে ভারত তাদের উত্তর-পূর্বের সাতটি রাজ্যের সঙ্গে সহজে ও কম খরচে যোগাযোগ রাখতে পারে, তাদের পণ্য পরিবহন করতে পারে। অতীতে দেখা গেছে, বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট ক্ষমতায় থাকাকালে পাকিস্তানের আইএসআই বাংলাদেশকে ব্যবহার করে উত্তর-পূর্ব ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোকে উদারভাবে সহায়তা করেছে। বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে এ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের জন্য চোরাই পথে অস্ত্র পাচার ছিল নিয়মিত ঘটনা। ২০০৪ সালে চট্টগ্রামে ১০ ট্রাক অস্ত্রের চোরাচালান আটক ছিল তার বড় প্রমাণ। শেখ হাসিনা সরকার গঠন করার পর সে অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি হয়েছে।

বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বেশ কিছু পীড়াদায়ক অমীমাংসিত সমস্যা রয়ে গেছে। এর মধ্যে আছে তিস্তাসহ কিছু অভিন্ন নদ-নদীর সুষম পানিবণ্টন সমস্যা। এটি যেমন নির্ভর করে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর, একইভাবে নির্ভর করে রাজ্য সরকারের সুমতির ওপরও। মনে রাখতে হবে, একজন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই শেষ মুহূর্তে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি আটকে দিতে পারেন। ১৯৯৬ সালে প্রথমবারের মতো ক্ষমতায় এসে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের সঙ্গে ৩০ বছর মেয়াদি ঐতিহাসিক গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন। তখন দিল্লিতে ক্ষমতায় ছিল দেবগৌড়া নেতৃত্বাধীন একটি জোট সরকার। পশ্চিমবঙ্গে ছিল বামফ্রন্ট। এ চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে ২০২৬ সালে। তারপর কী হবে তা দুই দেশের সরকারই ঠিক করবে। এ চুক্তি করার সময় পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বেশ সহায়তা পাওয়া গিয়েছিল। তৃণমূল সরকার গঠন করলে এবার সে সহায়তা পাওয়া যাবে কি না এ রকম সংশয়মূলক প্রশ্ন থেকেই যায়। সীমান্তে ভারতীয় নিরাপত্তারক্ষীদের গুলিতে নিয়মিত বাংলাদেশের নাগরিক প্রাণ হারাচ্ছে। দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে নিয়মিত বৈঠক হয়। সিদ্ধান্ত হয় সীমান্তে আর কোনো হত্যাকাণ্ড ঘটবে না। কিন্তু বাস্তবে এর কোনো প্রতিফলন নেই। সীমান্তহত্যা বন্ধ করা সময়ের গুরুত্বপূর্ণ দাবি। এ রকম কথাও ছিল, সীমান্তহত্যা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে প্রাণঘাতী নয়, প্রয়োজনে রাবার বুলেট ব্যবহার করা হবে। বাংলাদেশিদের জন্য ভারত ভ্রমণের ভিসা পেতে দীর্ঘসূত্রতারও দ্রুত অবসান প্রয়োজন।

বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ পড়শি ভারত। ভারতের কাছেও বাংলাদেশ নানা কারণে খুব গুরুত্বপূর্ণ পড়শি। ভারতে একটি স্থিতিশীল সরকার থাকলে তা তার প্রতিবেশীদের জন্যও নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। আছে আর্থসামাজিক আর নিরাপত্তার বহুমাত্রিক কারণও। বাংলাদেশে একটি স্থিতিশীল সরকার থাকলে লাভ বেশি ভারতের কারণ তার জাতীয় নিরাপত্তা। জাতীয় নিরাপত্তার চেয়ে মূল্যবান যে কিছু হতে পারে না তা ভারতের চেয়ে এ অঞ্চলে অন্য কোনো দেশ বেশি বুঝতে পারবে না। বাংলাদেশ শুধু ভারতের প্রতিবেশীই নয়, তার কৌশলগত মিত্রও। ভারতের চলমান নির্বাচনে তাদের দেশের মানুষ প্রতিনিধি বাছাই করবে তারাই সরকার গঠন করবেন। তবে বাংলাদেশের প্রত্যাশা থাকবে অতীতের সব সমস্যার দ্রুত সমাধান। যে বা যারাই লোকসভা নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করুন না কেন, তাদের লক্ষ্য যেন থাকে উভয়ের স্বার্থ ও প্রয়োজনের দিকে গুরুত্ব দেয়া। বাংলাদেশ ও ভারতের মাঝে বন্ধুত্বের সম্পর্ক সমতার ভিত্তিতে আরও উচ্চতায় যাক, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।  


  • শিক্ষাবিদ। রাজনীতি ও সমাজ বিশ্লেষক
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা