× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

বিচারের নামে কেন কান ধরানো

মুহাম্মদ তাজুল ইসলাম

প্রকাশ : ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ১৮:২১ পিএম

আপডেট : ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ১৮:৪১ পিএম

বিচারের নামে কেন কান ধরানো

সম্প্রতি আরেকটি কান ধরানোর বিচার দেখল দেশের মানুষ। যদিও বিচারের নামে কান ধরানো নতুন ঘটনা নয়। মূলত এ ধরনের বিচারের শুরু ১ নভেম্বর ২০০৭ সালের পর। বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেসি যখন নির্বাহী তথা প্রশাসন বিভাগ থেকে একেবারে পৃথক হয়, তখন মোবাইল কোর্ট আইন ২০০৯ নামে নতুন একটি আইন প্রণয়ন করে নির্বাহী বিভাগ। বিচার বিভাগ বা বিচারিক হাকিম আদালত পৃথক হোক বা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা পুরোপুরি নিশ্চিত হোক, তা হয়তো অনেকেই চায় না। কেননা প্রশাসনে কর্মরত অনেকেই মনে করেন, বিচারিক ক্ষমতা না থাকলে তাদের দেওয়া আদেশ-নিষেধ জনগণ মানবে না। ফলে ভ্রাম্যমাণ আদালত আইন ২০০৯ নামে নতুন করে বিচার বিভাগের আদলে সমান্তরাল বিচারব্যবস্থা চালু। কিন্তু সমস্যা হলো, যারা নির্বাহী আদালতের হাকিম বা এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট বলে আত্মতৃপ্তির ঢেকুর তোলেন, তারা প্রায় কেউই আইনের ছাত্র নন। ফলে অনেক সময় বিচারের নামে অবিচার ঘটিয়ে বসেন। এই যেমন কান ধরিয়ে বিচার শেষ করা বা মুচলেকা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া বা শিশু আইন বলবৎ থাকা সত্ত্বেও শিশু আসামিকে মোবাইল কোর্ট আইনে সাজা প্রদান করা ইত্যাদি।

বিচার মানে সেখানে অপরাধ থাকবে এবং তা প্রমাণ হলে অপরাধী সাজা পাবে আর প্রমাণ না হলে খালাস হবে। শাস্তি বা পানিশমেন্টের থিওরি রয়েছে বা কখন কোন সাজা দিতে হবে বা কেন সাজা দিতে হবে, সেসব পড়ানো হয় আইন বিষয়ে। কিন্তু সাধারণ বিষয়ে শাস্তির মূলনীতি বা শাস্তির থিওরি পড়ানো হয় না। ফলে এ কথা সাধারণ বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ সহজে অনুমান করতে পারেন যে, আইন না পড়ে যখন একজন ব্যক্তি নির্বাহী হাকিম বা ইউএনও হন, তখন তার পক্ষে কান ধরিয়ে শাস্তি দেওয়া অসম্ভব নয়। কারণ আইন না জানলে এমন বিচার হবে, তা সহজেই অনুমেয়।

ঈদুল ফিতরের দিন, অর্থাৎ ১১ এপ্রিল শরীয়তপুরে জেলা প্রশাসন পরিচালিত একটি পার্কে টিকিট ছাড়া প্রবেশ করায় পাঁচ শিশুকে কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। তাদের বয়স ১০ থেকে ১৪ বছর। কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকা শিশুরা কাঁদতে থাকে। যাদের বয়স ১০ বছরের নিচে, তাদের কাছে পার্কে প্রবেশের টাকা রেখে ছেড়ে দেওয়া হয়। আর যাদের বয়স ১৩ বছরের ওপরে, এমন দুজনকে আটকে রাখা হয়। রাত সাড়ে ৯টার দিকে পার্ক বন্ধ করার সময় গ্রামপুলিশ সদস্যরা ব্যস্ত হয়ে পড়লে ওই দুই শিশু তাদের চোখ এড়িয়ে পার্ক থেকে বেরিয়ে যায়। এ খবর বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে আসে। এ বিষয়ে একটি দৈনিকের খবর এবং তাদের সম্পাদকীয় আমার নজরে আসে। দুই-তিনবার খবরটি পড়ে মনে হয়েছে, পাঁচ শিশুকে কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখা কোন ধরনের অপরাধের বিচার? ইউএনও যে আইন ফলো করে বিচার করেছেন, সেই আইনে এ ধরনের বিচারিক প্রক্রিয়া বা বিচারের ফলাফল কি সমর্থন করে? যদি কোনো আইন না থাকে, তাহলে এই কান ধরিয়ে বিচার সমাধা করার বুদ্ধি কে দিল? ইউএনও সাহেবকে কি উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে মাঠে নামানো হয়নি? নাকি নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা বিচারের নামে স্বেচ্ছাচারিতা করছেন? ইত্যাদি নানান প্রশ্ন সংবাদটি পাঠ করার পর থেকেই মনে উঁকি দিচ্ছে। তবে মনে যে প্রশ্নই আসুক, তা সমাধানের পথ নেই। কারণ মোবাইল কোর্ট নামে সমান্তরাল বিচারব্যবস্থা চালু হলেও উক্ত বিষয়ে প্রশিক্ষণের জন্য মূলধারার বিচারকদের মতো নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বা ইউএনওদের পৃথক প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা নেই। আর যেটুকু রয়েছে, তা পর্যাপ্ত নয়। যদি প্রশিক্ষণ যথাযথ হতো, তাহলে কান ধরিয়ে বিচার করার ঘটনা বারবার ঘটত না।

সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সন্ধ্যার পর পার্ক থেকে তাদের আটক করে গ্রামপুলিশ ও আনসার সদস্যরা। পরে তাদের কান ধরে দাঁড় করানো হয়। শিশুদের কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখার ছবি তোলেন ও ভিডিও করেন পার্কে আসা দর্শনার্থীরা। এ বিষয়ে ইউএনও সাহেব সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, ‘শিশুদের কান ধরিয়ে রাখার বিষয়টি তার জানা নেই। কয়েকটি শিশু দেয়াল টপকে পার্কে ঢুকেছিল। পাশে যারা ছিলেন, তারা তাদের ধরে এনেছেন। ওরা দাঁড়িয়ে ছিল, ভয়ে হয়তো কানে হাত দিয়েছে।’ এটা শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টামাত্র। কারণ ভয়ে কানে হাত দেওয়া আর কান ধরিয়ে রাখা এক  নয়।

ইউএনও একজন দায়িত্বশীল সরকারি কর্মকর্তা। তিনি উপজেলার প্রধান কর্মকর্তা। সে হিসেবে তার জানা থাকার কথা, শিশুদের শাস্তি দেওয়া যায় না। এ ছাড়া বিদ্যালয়গুলোতেও নির্দেশনা দেওয়া আছে, তাদের যেন শারীরিক ও মানসিক শাস্তি দেওয়া না হয়। ১৮ বছরের নিচে যাদের বয়স, তাদের সবাইকে শিশু হিসেবে গণ্য করা হয় এবং তাদের শাস্তি দেওয়া যায় না। শিশুদের শাস্তি বা তারা অপরাধ করলে তা শিশু আইন অনুযায়ী বিচার হবে। অথচ ইউএনও এবং ওই পার্কের রক্ষীরা তাদের কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখলেন!

ইউএনওদের আইন হাতে তুলে নেওয়ার ঘটনা এটাই প্রথম নয়। গত বছরের মার্চ মাসে বাগেরহাটের ফকিরহাট উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান শেখ মিজানুর রহমানকে থাপ্পড় দিয়েছিলেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মনোয়ার হোসেন। এজন্য তাকে প্রত্যাহার করা হয়েছিল। করোনাভাইরাসের প্রাদূর্ভাবে লোকসমাগম যেন না হয় সে বিষয়টি দেখভালের জন্য নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) উপজেলার বিভিন্ন স্থানে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেন। বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে মনিরামপুর উপজেলার চিনাটোলা বাজারে অভিযানের সময় প্রথমে ভ্রাম্যমাণ আদালতের সামনে পড়েন দুই বয়ঃবৃদ্ধ। এর মধ্যে একজন বাইসাইকেল চালিয়ে আসছিলেন, অপরজন রাস্তার পাশে বসে কাঁচা তরকারি বিক্রি করছিলেন। তাদের মুখে মাস্ক ছিল না। তখন সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে জানা যায়, পুলিশ ঐ দুই বৃদ্ধকে ভ্রাম্যমাণ আদালতে হাজির করলে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট শাস্তি হিসেবে তাদের কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখেন। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিজে তার মোবাইল ফোনে এ চিত্র ধারণ করেন। এরপর একজন বৃদ্ধ ভ্যানচালককেও অনুরূপভাবে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকার দণ্ড দেন। এসব ছবি দ্রুতই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিল। অনেকেই বয়স্ক নাগরিকদের এভাবে সাজা দেওয়া মেনে নিতে পারেননি। এমন দণ্ড ভ্রাম্যমাণ আদালতকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।

নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের মোবাইল কোর্ট আইনের ক্ষমতা প্রয়োগে আরও প্রশিক্ষণ দরকার কি না, তা ভেবে দেখা প্রয়োজন। বিজ্ঞ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের এমন কাজ কোনোভাবেই কাম্য নয়।

শিশুদের বা বৃদ্ধদের কান ধরানোর ছবি বা উপজেলা চেয়ারম্যানকে থাপ্পড় দেওয়ার ছবি দেখে বা এ রকম বিচারের কথা শুনে ও দেখে কেউ নিজের আবেগকে ধরে রাখতে পারবে না, সেটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশ সংবিধানের ৩৫ (৫) অনুচ্ছেদ অনুসারে এ ধরনের শাস্তি সম্পূর্ণ বেআইনি। স্বাধীনতার ৫৩ বছরে এসে বিচারের নামে কাউকে অসম্মান মেনে নেওয়া যায় না। আইনের মধ্যে যতটুকু ক্ষমতা (দায়িত্ব) দেওয়া আছে, তার মধ্যেই বিচার কার্যক্রম সীমিত রাখা উচিত। একটা সার্ভিসের যদি কেউ আইনের বাইরে কোনো কাজ করে, তার দায় সে ব্যক্তিকেই বহন করতে হবে। প্রত্যেক সার্ভিসেই এ রকম কিছু ব্যক্তি আছেন। তারাই সমস্যা তৈরি করেন। কিন্তু এর দায় পুরো সার্ভিস নেবে না।

শিশুদের কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখা বা বৃদ্ধ কাউকে কান ধরানো চড়-থাপ্পড়ের চেয়েও গুরুতর অপরাধ। এর মাধ্যমে শরীয়তপুর সদর উপজেলার ইউএনও ও তার সহযোগীরা মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছেন। ১৯৯০ সালে জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদে অনুস্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ। সে অনুযায়ী শিশু আইন ২০১৩ প্রণীত হয়েছে। স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্র হিসেবে কাগজে-কলমে অনেক উদ্যোগ নিলেও সামাজিক চর্চায় শিশুর অধিকার নিশ্চিত করা যায়নি, ইউএনওর কাণ্ডই তার প্রমাণ। শিশুরা কোনো অপরাধ করলে তার বিচার শিশু আইনে হবে। তড়িঘড়ি করে কান ধরিয়ে বিচার করতে চাইছে কেন ইউএনও সাহেব বা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা? কাউকে এভাবে শাস্তি দিলে যে সংবিধান বা বিদ্যমান মোবাইল কোর্ট আইন ও দেশের ফৌজদারি আইন সুস্পষ্ট লঙ্ঘন করা হয়, যে ইউএনও বা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বা বিচারক এ ধরনের ‘কান ধরানোর’ বিচার করলেন, তিনি তো তার নিজের ক্ষমতা দেওয়া মোবাইল কোর্ট আইন ২০০৯ ভালো করে পাঠ করতে পারতেন। সেটি তিনি না পড়েই বিচারকাজে নেমেছেন; যা তার কাজকেই শুধু নয়, পুরো প্রক্রিয়াটিকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

আইন জানা থাকলে মানতে ও প্রয়োগ করতে সুবিধা হয়। সেজন্য উপযুক্ত প্রশিক্ষণ জরুরি। আইনে আছে সহস্র অপরাধী ছাড়া পায় পাক, কিন্তু একজন নিরপরাধ লোক যেন অন্যায়ভাবে শাস্তি না পায়। বিচার করতে এ জুরিসপ্রুডেন্স সামনে রাখা জরুরি। বিচার করলেই শুধু হবে না, এটাও দেখাতে হবে সেখানে ন্যায়বিচার হয়েছে। যেকোনো ধরনের বিচারের দায়িত্ব পুরোপুরি মূলধারার বিচারকদের হাতে না আসা পর্যন্ত কান ধরানো বা শিশুদের বেআইনি সাজা প্রদান চলতেই থাকবে। তাই বিচার বিভাগের বাইরে ভিন্ন কোনো সমান্তরাল বিচারব্যবস্থা  যেন না চলে, তার ব্যবস্থা রাষ্ট্রকেই করতে হবে। 


  • কলামিস্ট ও আইন বিশ্লেষক
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা