× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

ফিরে দেখা

মেহেরপুরের আম্রকাননের প্রেক্ষাপট

সৈয়দ মাহবুবুর রশিদ

প্রকাশ : ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ১৩:২৩ পিএম

সৈয়দ মাহবুবুর রশিদ

সৈয়দ মাহবুবুর রশিদ

১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল বাংলাদেশের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা একত্রিত হয়ে নিজেদের সমন্বয়ে যথাযথভাবে একটি গণপরিষদ গঠন করেন এবং জনগণের সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক সুবিচার নিশ্চিতকরণার্থে গণপ্রজাতন্ত্ররূপ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা করেন। প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম। গণপরিষদ ইতোমধ্যে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ঘোষিত স্বাধীনতা দৃঢ়ভাবে সমর্থন এবং অনুমোদন করে। মুজিবনগর থেকে জারিকৃত এই ঘোষণাপত্রে একজন প্রধানমন্ত্রী এবং প্রয়োজনীয় সংখ্যক মন্ত্রী নিয়োগের বিধান রাখা হয়। এরপর ১৭ এপ্রিল তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী এবং অপর তিনজনকে মন্ত্রী নিয়োগ দিয়ে মেহেরপুরের আম্রকুঞ্জে শপথ পাঠ করানো হয়। ওই সরকারই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম সরকার, অস্থায়ী বলা ভুল, আর মুজিবনগর প্রতীকী।


বাংলাদেশবিরোধী অনেকে যুক্তি হিসেবে বলে থাকেন, ’৭০-এর নির্বাচনে জনগণ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করার জন্য ভোট দেয়নি। বঙ্গবন্ধু একটা কথা পরিষ্কার বলেছেন, এই নির্বাচন ছয়দফার ম্যান্ডেট। জেনারেল ইয়াহিয়া খান যে নির্বাচনের নির্দেশ দিয়েছিলেন, যা এলএফও বা লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার, সেখানে কিন্তু সংবিধান প্রণয়ন করার কথাই বলা হয়েছিল। পাকিস্তানি বাহিনীর হঠকারিতার জন্য বাংলাদেশ বাধ্য হয়ে তার নিজের দেশের সংবিধান প্রণয়ন করার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৫৬ সালের ২৩ মার্চ পর্যন্ত এই ভূমি সরকারিভাবে পূর্ব বাংলা নামে পরিচিত ছিল। আওয়ামী লীগ ১৯৫৬ সালের পাকিস্তান শাসনতন্ত্রের পক্ষে সমর্থন দিয়ে দুটো অন্যায়কে সমর্থন করেছিল, একটি পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের সমতা, অপরটি হলো পূর্ব বাংলার নাম পরিবর্তন করা। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর ঊষালগ্নে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী তার মন্ত্রিসভার বেশ কয়েকজন মন্ত্রীকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাঠিয়েছিলেন প্রকৃত অবস্থা বোঝানোর এবং নৈতিক সমর্থনের জন্য। একেবারে শেষ পর্যায়ে স্বয়ং ইন্দিরা ব্রিটেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিলেন। তবে জাতিসংঘে চূড়ান্ত ভোটাভুটির ফলাফলে এটাই প্রতীয়মান হয় যে তারা সবাই শূন্য হাতে ফিরেছিলেন। বিশ্বের যেসব নেতা নেহরুর সঙ্গে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনে কাজ করেছেন, তারাও কার্যত কোনো সমর্থন দেননি। কিন্তু আমাদের মুক্তিযুদ্ধ বিশ্বের হেন কোনো প্রান্ত নেই যেখানে নাড়া দেয়নি।

৭০ বছর বয়সি বিখ্যাত ঔপন্যাসিক এবং দ্য গলের সংস্কৃতিমন্ত্রী আদ্রে মালরো ইয়াহিয়া খান সরকারের নিন্দা করেন এবং নিজে বাংলাদেশের পক্ষে অস্ত্র হাতে যুদ্ধে যাওয়ার ঘোষণা দেন। নোবেল বিজয়ী পদার্থবিদ আলফ্রেড কাসলার বাংলাদেশের বিয়োগান্ত ঘটনাকে হিরোশিমা ড্রেসডেন এবং আউশভিৎজের সঙ্গে তুলনা করেন। বাংলাদেশের সংকট বিশ্বচেতনায় সবচেয়ে বেশি গেঁথে গিয়েছিল কনসার্ট ফর বাংলাদেশের পর। নিউইয়র্কের ম্যাডিসন গার্ডেন স্কয়ারে ১৯৭১-এর ১ আগস্ট এই কনসার্ট অনুষ্ঠিত হয়। আয়োজনের মূল উদ্যোগ নেন ভারতের বিখ্যাত সংগীতজ্ঞ পশ্চিম বাংলার বাঙালি পণ্ডিত রবিশংকর, আর অংশগ্রহণে আলোকিত করেন জর্জ হ্যারিসন এবং তার সঙ্গীরা। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ সম্পর্কে অনেক তথ্য এবং সর্বশেষ পরিস্থিতি জানতে চেয়েছে অনেক রাষ্ট্র এবং তাদের কৌতূহল মেটাতে পেরেছে ভারত সরকার বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে। বাংলাদেশ সরকারের এই ভূমিকা অস্বীকার করতে পারে অতি বুদ্ধিমান অথবা বেকুবরা। আমস্টারডাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ইতিহাসের অধ্যাপক মি. ভ্যান সেন্ডেল বাংলাদেশের ওপর একটি গবেষণামূলক বই প্রকাশ করেছেন। এর নাম এ হিস্ট্রি অব বাংলাদেশ। নিঃসন্দেহে এটি বাংলাদেশের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছে, যদিও কয়েকটি ক্ষেত্রে এর ঘাটতি পরিলক্ষিত।

তাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশ সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী এবং বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহকর্মী। তিনি সাফল্যের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নেতৃত্ব দেন। এ ছাড়া বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ভারত সরকার বাংলাদেশ সরকারকে সিভিল সার্ভিসের সদস্য দিয়ে সাহায্য করতে চেয়েছে। কিন্তু তিনি কলকাতায় বসেই সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন। এমন একজন ব্যক্তিত্বের নাম একবারও উচ্চারিত হয়নি বইটিতে। তা ছাড়া ১৯৪৭ সাল থেকে এই বই লেখা পর্যন্ত এ অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেওয়া হয়েছে। সেখানে কুখ্যাত মোনেম খানের নাম রয়েছে। এ বইয়ে মিসেস রওনক জাহানের লেখার উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, ‘একদল বীর মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রাম করে বিজয় অর্জন করেছেন আর অন্যেরা কলকাতায় থেকে আনন্দ উৎসব করেছেন’। পাকিস্তান সরকার যথাযথভাবে বুঝতে পেরেছিল যে যদি মুক্তিযোদ্ধারা কিছু স্থান দখল করে বাংলাদেশের সরকারের স্থায়ী শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করে তাহলে পাকিস্তানের পরাজয় অনিবার্য। সেজন্য তারা মে মাসের ভেতরে সমস্ত বাংলাদেশ দখল করে ফেলে। মেহেরপুরের আম্রকাননে ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশ সরকার শপথ গ্রহণ করে। তার এক দিন পর ১৮ এপ্রিল সন্ধ্যায় পাকিস্তান বাহিনী সেই স্থানটি দখল করে নেয়। এ দখল তারা চূড়ান্ত পর্যায়ের পরাজয়ের পূর্ব পর্যন্ত বহাল রেখেছিল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল জনযুদ্ধ, অবস্থান থেকে মুক্তিযুদ্ধকে সাহায্য করেছে।

লেখক কিছু বামপন্থি বুদ্ধিজীবী/মেধাজীবী কর্তৃক বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছেন। এটা আরও পরিষ্কার হয়ে যায় তার তৎকালে প্রকাশিত বাংলা সাপ্তাহিক বিচিত্রার ভূয়সী প্রশংসা দেখে। স্বাধীনতার পরপর এই পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়ে যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করে। মি. সেন্ডেলের নিকট তারা তাজউদ্দীন এবং প্রবাসী সরকারের সাফল্যের কথা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছেন। এসব জ্ঞানী ব্যক্তির চিন্তাধারা অনেক উচ্চপর্যায়ের। তারা দেশের চাইতে বিদেশ তথা গোটা বিশ্বের কথা চিন্তা করেন। পাকিস্তান আমলে আমরা দেখেছি যে তাদের চিন্তা সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং চীনকে নিয়ে। তাদের সঙ্গে আমাদের মতো সাধারণ মানুষ আলোচনা করতে গেলে অনেক তুচ্ছতাচ্ছিল্যের শিকার হতে হয়। তাদের মহান উচ্চ চিন্তাধারাকে যে ছকের ভেতর বেঁধে ফেলেন তা থেকে তারা সরে আসেন না এবং কোনো আলোচনা করতেও রাজি নন। মি. সেন্ডেলের বইটির কিছু বিরূপ আলোচনা সত্ত্বেও বইটির যথেষ্ট মর্যাদা রয়েছে এবং বাংলার ইতিহাসে এটি অমূল্য সংযোজন। প্রবাসী সরকারকে অনেক বিরূপ পরিবেশের সম্মুখীন হতে হয়। আবার কেউ কেউ এ ধরনের সরকার গঠন না করে বিপ্লবী কাউন্সিল গঠনের প্রস্তাবও দিয়েছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতি অবিচল থেকে এবং গণতান্ত্রিক আদর্শের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে ১০ এপ্রিল যে বাংলাদেশ সরকার গঠন করা হয় তা একটি নির্ভুল সিদ্ধান্ত। কেননা দলীয় শ্রদ্ধাবোধ ভঙ্গুর ছিল না। পক্ষান্তরে যারা খুব বিপ্লবী ঐক্যের মনোভাব দেখিয়েছেন, স্বাধীনতার পর মাসাধিককালের ভেতর তাদের মধ্যে ভাঙন ধরে যায় এবং আমরা দেখেছি জাতিকে কীভাবে এর মূল্য দিতে হয়েছে।

  • মুজিবনগর সরকারের কর্মকর্তা ও আর্থিক খাত বিশ্লেষক
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা