সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়
প্রকাশ : ১৭ এপ্রিল ২০২৪ ১৩:৪৫ পিএম
১৯২৩ সালে মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট ক্যালভিন কুলিজ প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করে প্রথমেই
বলেছিলেন, ‘মানুষের জীবনের নিরাপত্তা রক্ষার চেয়ে বড় কোনো কিছুই নেই’। আমেরিকান রাজনীতিক,
লেখক, শিক্ষাবিদ রালফ নাদের বলেছিলেন, ‘সমাজে জনগণের স্বাস্থ্য এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত
করার চেয়ে ভালো নীতি আর নেই’। আর যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের আটত্রিশতম
গভর্নর আর্নল্ড শোয়ার্জনেগারের মতে, ‘সরকারের প্রথম দায়িত্ব এবং সর্বোচ্চ দায়িত্ব হলো
জননিরাপত্তা নিশ্চিত করা’। যেকোনো রাষ্ট্রের নাগরিক সমাজের অধিকার এবং নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে
এ রকম অনেক গুরুত্বপূর্ণ উক্তি বা মন্তব্য রয়েছে রাষ্ট্র পরিচালনা ও বিশ্বরাজনীতির
ইতিহাসে। এই গৌরচন্দ্রিকার প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে ১৬ এপ্রিল প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ
প্রকাশিত জননিরাপত্তাহানিজনিত একাধিক সংবাদ শিরোনাম। এই সম্পাদকীয় স্তম্ভেই ঈদের আগে
আমরা বলেছিলাম, টানা কয়েক দিনের ছুটিতে যাতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কোনো অবনতি না ঘটে,
এজন্য নজরদারি বাড়ানোর পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোকে সতর্ক অবস্থানে
থাকতে হবে। ২ এপ্রিল ‘তিন মাসে সহিংসতায় ২৩ জন নিহত, আহত ২৩৬৮’ শিরোনামে প্রতিদিনের
বাংলাদেশ-এ প্রকাশিত সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা এই তাগিদ দিয়েছিলাম। কিন্তু ঈদ ও নববর্ষের
টানা ছুটির মধ্যে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নানা ধরনের অঘটনের যেসব খবর
উঠে এসেছে তাতে আমাদের আশঙ্কা যে অমূলক ছিল না, তা-ই প্রতীয়মান হয়েছে।
রাজধানীর হাতিরঝিল
থেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্ট্যামফোর্ডের শিক্ষার্থীর লাশ উদ্ধারের পাশাপাশি রাজধানীতেই
এটিএম বুথের নিরাপত্তাকর্মীকে হত্যা, পল্লবীতে বাসচালকের সহকারীকে খুন, নাটোরে উপজেলা
পরিষদ নির্বাচন সামনে রেখে নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী ও তার ভাইকে চরম নিপীড়ন-নির্যাতন,
রূপগঞ্জে চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে স্থানীয় যুবলীগ নেতার গাড়িতে আগুন, নরসিংদীতে ইউপি
সদস্যকে গুলি করে ও গলা কেটে হত্যা এবং দেশের আরও অন্যান্য স্থানে চারজনকে পিটিয়ে হত্যার
খবর আমাদের উদ্বিগ্ন না করে পারে না। বিগত এক সপ্তাহের এই খতিয়ানই বলছে, আইনশৃঙ্খলা
পরিস্থিতির অবনতি কতটা ঘটেছে। যেকোনো স্থিতিশীল সমাজের অন্যতম শর্ত জননিরাপত্তা। টেকসই
উন্নয়নের সঙ্গেও জননিরাপত্তার বিষয়টি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। সন্দেহ নেই, উন্নয়ন-অগ্রগতির
মহাসড়কে আমরা উঠেছি; কিন্তু জননিরাপত্তা-সামাজিক শৃঙ্খলা এবং প্রাতিষ্ঠানিক-অপ্রাতিষ্ঠানিক
ক্ষেত্রে নিয়মনীতির যথাযথ প্রতিপালন ইত্যাদি জরুরি বিষয় এখনও অনেকাংশেই নিশ্চিত করা
সম্ভব হয়নি। অপরাধ সমাজের অন্যতম গুরুতর ব্যাধি এবং এই ব্যাধি উন্নয়ন-অগ্রগতির অন্যতম
প্রতিবন্ধকও বটে। স্বাধীনতার তিপ্পান্ন বছরে এ রকম তিক্ত অভিজ্ঞতা আমাদের কম নয়।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে
সমাজে অপরাধ বৃদ্ধির মতো উদ্বেগজনক পরিস্থিতির উদ্ভব কিংবা জিইয়ে থাকা অনেকটাই অপ্রত্যাশিত।
কারণ টানা চতুর্থবারসহ পঞ্চমবারের মতো আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার
সরকারের শাসনকালে বাংলাদেশের উন্নয়ন-অগ্রগতির চিত্র কোনো গল্প নয়, আমূল বদলে দেওয়ার
দৃশ্যমান বাস্তবতা। কিন্তু এর পাশাপাশি যদি দৃশ্যমান হয় জননিরাপত্তার ছায়া, তাহলে তা
সাফল্যের অবয়বে প্রশ্নবোধক চিহ্ন যুক্ত করে। অতীতেও আমরা বলেছি, অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধির
ক্ষেত্রে শুধু রাজনৈতিক অস্থিরতাই প্রত্যক্ষ কারণ নয়; এর সঙ্গে রাজনৈতিক ও ক্ষমতার
অপব্যবহারের মতো অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয়গুলোও সম্পৃক্ত। তা ছাড়া প্রযুক্তির উৎকর্ষের এই
যুগে অনেক ক্ষেত্রেই এর সদ্ব্যবহার না করে সমাজের কিংবা প্রজন্মের একটি উল্লেখযোগ্য
অংশ অপব্যবহারে মেতে উঠেছে। আমাদের অভিজ্ঞতায় এও আছে, রাজনৈতিক হীনস্বার্থ চরিতার্থকরণের
জন্যও কোনো কোনো রাজনীতিক সমাজবিরোধীদের নানাভাবে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেন এবং এর বিরূপ প্রভাব
ভয়াবহ হয়ে ওঠে। বিদ্যমান বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে এর পেছনে এমন কোনো যোগসূত্র রয়েছে কি
না, তা খতিয়ে দেখার তাগিদও আমরা দেই। তবে একই সঙ্গে এও সত্য, এমন পরিস্থিতিতে ত্বরিত
আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের বিকল্প নেই। অনাকাঙ্ক্ষিত তবে এ-ও অনস্বীকার্য, আমাদের সমাজে
‘বিচারহীনতার অপসংস্কৃতি’ শব্দযুগল বহুল প্রচলিত হয়ে পড়েছে। আমরা দেখছি, অনেক ক্ষেত্রে
ন্যায়বিচার প্রাপ্তির আশা ছেড়ে দিয়েছেন ভুক্তভোগী। এর পেছনে মুখ্যত দায়ী বিচারপ্রক্রিয়ার
জরুরি অন্যতম অনুষঙ্গ সুষ্ঠ তদন্ত কার্যক্রমে অনাকাঙ্ক্ষিত বিলম্ব এবং অভিযোগপত্র গঠনে
ধীরগতি। এমন উপসর্গগুলো জিইয়ে রেখে জননিরাপত্তা নিশ্চিত করা যে সহজ নয়, এর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ
নতুন করে নিষ্প্রয়োজন।
জননিরাপত্তা নিশ্চিত
করতে হলে অবশ্যই অপরাধের উৎসে নজর দেওয়ার পাশাপাশি প্রতিবিধানমূলক ব্যবস্থার পথ মসৃণ
করতে হবে। সমাজে যদি অপরাধপ্রবণতা বাড়ে তাহলে সামাজিক ভারসাম্য নষ্ট হবে এবং আইনশৃঙ্খলা
নিয়ন্ত্রণে না থাকলে উন্নয়ন কষ্টসাধ্য হবে। আমরা মনে করি, অন্যায়কারীর শাস্তি যদি নিশ্চিত
হয়, তাহলে সমাজবিরোধীরা নিরুৎসাহিত হতে বাধ্য। জননিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায় সরকারের।
আর সরকারের গৃহীত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের দায়িত্ব বর্তায় মাঠপর্যায়ের প্রশাসনিক দায়িত্বশীলদের
ওপর। অপরাধ কিংবা অপরাধী চক্রের মূলোৎপাটনে বিচারহীনতার অপসংস্কৃতির নিরসন ঘটাতেই হবে।
আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার সমাজের স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার জন্য নিঃসন্দেহে জরুরি। উল্লেখ্য,
স্থির জলাশয়। কেউ ঢিল ছুড়লেন জলে, সঙ্গে সঙ্গে জলের স্তর ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। কিন্তু
অল্প কিছুক্ষণের জন্য সব আবার আগের মতো হয়ে গেল। অর্থাৎ ঢিল ছোড়া জলে যে চঞ্চলতা সৃষ্টি
হয়েছিল, তা খানিকটা সময় পর আবার স্থির হয়ে গেল। এটাই বাস্তব এবং এই বাস্তবতার সঙ্গে
সমাজেরও অনেক ক্ষেত্রেরই মিল খুঁজে পাওয়া যায়। জরুরি হলো, এই দিকটায় সমগুরুত্বে নজর
বাড়ানো।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী
বাহিনীর দায়িত্বশীলরা প্রায়ই ‘পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে’ দাবি করে আত্মতুষ্টিতে ভোগেন।
সমাজে যখন অপরাধপ্রবণতা বাড়ে, তখন এ ধরনের দায়িত্বহীন সন্তোষে জনমনে অনাস্থা জন্মায়।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী প্রতিটি বাহিনীর জনবল-সক্ষমতা-দক্ষতা বাড়ানোর পাশাপাশি অপরাধ
দমনে তাদের সাফল্যের চুলচেরা বিশ্লেষণ প্রয়োজন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা এবং জননিরাপত্তা নিশ্চিত
করায় কোনোভাবেই উদাসীন থাকা কিংবা ছাড় দেওয়ার অবকাশ নেই। আমরা মনে করি, রাজনীতিকরা
যদি জনকল্যাণ ও গঠনমূলক রাজনীতিচর্চার পথ সুগম করে প্রজন্মকে সুস্থ চিন্তা অনুশীলনের
রাস্তা বের করে দিতে পারেন, তাহলে সমাজে এর ইতিবাচক প্রভাব দৃশ্যমান হতে বাধ্য। আইনশৃঙ্খলা
রক্ষাকারী বাহিনীগুলো অপরাধপ্রবণতার রাশ টানতে পারবে যদি না অধিকার ও জননিরাপত্তা নিশ্চিত
করায় সরকারের দায়িত্বশীল সব পক্ষের যূথবদ্ধ প্রয়াস জোরদার না হয়। একই সঙ্গে সুশাসনের
ব্যাপারে মনোযোগ গভীর করাও জরুরি। আমরা বিশ্বাস করি, আইনের শাসন নিশ্চিত হলে অনেক অনিশ্চয়তাই
কেটে যাবে।