মানবতা
মযহারুল ইসলাম বাবলা
প্রকাশ : ১৭ এপ্রিল ২০২৪ ১৩:৩৮ পিএম
মযহারুল ইসলাম বাবলা
দুঃখজনক হলেও অসত্য নয়, অনেক ক্ষেত্রেই শিক্ষা, চিকিৎসাসহ সবকিছু মুনাফাভিত্তিক
ব্যবসায় পরিণত হয়ে পড়েছে। প্রতিটি রাষ্ট্রের দায় আছে নাগরিকের মৌলিক চাহিদাগুলো নিশ্চিত
করার। সমষ্টিগত মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে শিক্ষা ও চিকিৎসাসেবা থেকে। অনেকেই শেষ সম্বল বিক্রি
করে চিকিৎসা ব্যয় নির্বাহে নিঃস্ব হচ্ছে্ন, নয়তো বিনা চিকিৎসায় ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুবরণ
করছেন। বিত্তবানেরা দেশের অত্যাধুনিক ব্যয়বহুল চিকিৎসাসেবা কেনার পাশাপাশি বিদেশে ছুটছে
আরও ব্যয়সাপেক্ষ উন্নত চিকিৎসা প্রাপ্তির অভিপ্রায়ে। মুনাফার আধিপত্যের এরকম পরিস্থিতিতে
আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের কলকাতায় গড়ে উঠেছে সামাজিক মালিকানাধীন ‘ক্যালকাটা
হার্ট ক্লিনিক অ্যান্ড হসপিটাল’। এ চিকিৎসাকেন্দ্রটির প্রতিষ্ঠাতা বাংলাদেশের ঢাকার
সন্তান ডা. ননী গুহ, যিনি নিজ অর্থে সল্টলেকের ৩ নম্বর সেক্টরে সোসাইটির নামে জমি কিনে
গড়ে তুলেছেন স্বল্পমূল্যে সাধারণের চিকিৎসা প্রদানের সামাজিক মালিকানার এক অনন্য প্রতিষ্ঠান।
ডা. ননী গুহের জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঢাকায়। পৈতৃক নিবাস তৎকালীন বিক্রমপুরের (মুন্সীগঞ্জ)
মীরকাদিমে। তার পরিবার স্থায়ীভাবে বসবাস করত ঢাকার ওয়ারীতে। সেখানে ছিল তাদের বিশাল
বাড়ি। সেখানেই তার জন্ম। ব্রাহ্মসমাজ পরিচালিত ইস্ট বেঙ্গল ইনস্টিটিউশন স্কুল থেকে
১৯৩৭ সালে ম্যাট্রিকুলেশন এবং ১৯৩৯ সালে আইএসসি কৃতিত্বের সঙ্গে পাস করেন। ছাত্রাবস্থায়
যুক্ত ছিলেন অনুশীলন সমিতির সঙ্গে। পরে তিনি কলকাতা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। ঢাকায়
স্বদেশী আন্দোলনের যুক্ততার ধারাবাহিকতায় কলকাতার যুগান্তর দলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন।
মেডিকেলে পড়ালেখার পাশাপাশি স্বদেশী আন্দোলনের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ততায় দ্রুতই গোয়েন্দাদের
নজরে পড়ে যান। পরিণতিতে ১৯৪২ সালে গ্রেপ্তার হন। শিকাগো থেকে ডিগ্রিপ্রাপ্ত পিতা ডা.
এন সি গুহ তার মেধাবী এ সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে উৎকণ্ঠায় পড়ে যান। ছেলেটি আর ডাক্তার
হতে পারবে কি না-এ হতাশা নেমে আসে ঢাকায় অবস্থিত পুরো পরিবারে। প্রমাণের অভাবে শেষ
পর্যন্ত তাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় ব্রিটিশ সরকার।
কারামুক্তির পর এমবিবিএস পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের
জন্য ১৯৪৮ সালে ইংল্যান্ড যান। ১৯৪৭ সালের মধ্য আগস্টে দেশভাগ হয়। তার পরিবার মাতৃভূমি
ত্যাগ না করার সিদ্ধান্তে অটল ছিল। কিন্তু পঞ্চাশের দাঙ্গায় পরিবারের ওপর নেমে আসে
দাঙ্গার জের। সেটা সম্প্রদায়গত কারণে যতটা নয়, তার চেয়ে অধিক তাদের ওয়ারীর বিশাল বাড়িটি
দখলের অভিপ্রায়ে। তাই সম্পত্তির জন্য প্রাণ যাবে ভেবেই নিরুপায়ে ডা. এন সি গুহের পুরো
পরিবার দেশত্যাগের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়। তারা চলে যান কলকাতায়। বিদেশ থেকে ঢাকার
পরিবর্তে কলকাতায় পরিবারের কাছে ফিরে যান ননী গুহ। কলকাতায় ফিরে সিঙ্গাপুরে লোভনীয়
চাকরির প্রস্তাব সম্মতির জন্য বাবাকে জানালে বাবা উপহাস করে তাকে বলেছিলেন, ‘চাকরিই
যদি করবে তবে ডাক্তার হয়েছ কেন?’ ডা. ননী গুহ সিঙ্গাপুরের সেই চাকরির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান
করে সাধারণ মানুষের চিকিৎসাসেবা প্রদানে আত্মনিয়োগ করেন। প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছুটে গেছেন
হতদরিদ্র অসহায় মানুষের চিকিৎসাসেবা দিতে। প্রয়োজনে ওষুধ পর্যন্ত নিজে কিনে দুস্থদের
দিতেন। মতাদর্শিক রাজনৈতিক অঙ্গীকার ধারণ করে সাধারণ মানুষকে জীবনভর চিকিৎসাসেবা দিয়ে
গেছেন।
তিল তিল করে সল্টলেকের এ হাসপাতালটি গড়ে তোলেন তিনি। হাসপাতালের ভিত্তিপ্রস্তর
স্থাপন এবং আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু। ১৯৯১
সালের ২২ নভেম্বর ননী গুহর আকস্মিক মৃত্যুতে হাসপাতালটি চরম ঝুঁকির মুখে পড়ে। একটি
সমাজবিরোধী চক্র তার পরিবারের কিছু সদস্যকে উস্কে দিয়ে হাসপাতাল উচ্ছেদ করে ওই জমিতে
বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মাণে তৎপর হয়ে ওঠে। দীর্ঘ কয়েক বছরের মালিকানার মামলাটি শেষ
পর্যন্ত উচ্চ আদালতের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে নিষ্পত্তি হলে হাসপাতালটি রক্ষা পায়। পরিবারের
ওই সদস্যরা এবং সুযোগসন্ধানী চক্র সরে যেতে বাধ্য হয়। এ দুঃসময়ে এগিয়ে আসেন ডা. গুহর
স্ত্রী সুজাতা গুহ। ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করে সামাজিক মালিকানার হাসপাতালটির ট্রাস্টি
বোর্ডের প্রধান করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক সুশীল কুমার মুখোপাধ্যায়কে।
বিশিষ্টজনদের পাশাপাশি প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ এবং ডাক্তারদের পেশাজীবী
সংগঠনের বিভিন্নজনকে ট্রাস্টি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তারা প্রত্যেকে স্বেচ্ছাসেবী
হিসেবে হাসপাতাল পরিচালনায় নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। ডাক্তাররা তাদের দায়িত্ব পালনে
নিষ্ঠ। নিরলসভাবে দিয়ে থাকেন রোগীর সুস্থতার জন্য অপরিমেয় চিকিৎসাসেবা যা ভারতের অন্য
কোনো চিকিৎসাকেন্দ্রে খুঁজে পাওয়া ভার।
লোকমুখে প্রচারের পর বাংলাদেশ থেকে অনেক রোগী চিকিৎসাসেবা নিতে সেখানে যাচ্ছেন।
চিকিৎসা বাণিজ্যের প্রতারণার ঘৃণিত এ নষ্ট যুগে হাসপাতালটি কেবল অনন্য নয়, অসাধারণও
বটে। হাসপাতালের অভ্যন্তরের বিষয়গুলোও চমকপ্রদ। ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে ট্রস্টি বোর্ড
এবং কর্মচারী ইউনিয়ন যৌথভাবে নীতিনির্ধারণী, ব্যবস্থাপনাসহ সব সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে।
এককভাবে ট্রাস্টি বোর্ড কিংবা কর্মচারী ইউনিয়নের সিদ্ধান্ত গ্রহণের এখতিয়ার নেই। এ
জন্যই তারা পেশার চেয়েও অধিক দায়িত্বশীল হয়ে হাসপাতালের সব কর্মকাণ্ডে সক্রিয় ভূমিকা
পালন করেন। তারা কেবল চাকরি করছেন না, করছেন মতাদর্শিক চেতনায় ভিন্মাত্রার জনস্বাস্থ্যের
সুরক্ষায় দায়িত্ব পালন। তারা এ হাসপাতালের অংশ বলেই প্রত্যেকে মনে করেন। সবাই চিন্তায়
মননে সেটা গভীরভাবে ধারণ করেন। বিশেষজ্ঞ ডাক্তার, কর্মকর্তা, কর্মচারী থেকে পরিচ্ছন্নতা
কর্মীÑসবাই একই ক্যান্টিনে আহার করেন। প্রত্যেকে প্লেটের স্তূপ থেকে প্লেট নিয়ে নির্দিষ্ট
স্থান থেকে খাবার সংগ্রহ করে খাবারের টেবিলে বসে খাওয়া শেষে যার যার প্লেট ধুয়ে যথাস্থানে
রেখে দেন। জাত বা শ্রেণিবৈষম্যের ছিটেফোঁটাও সেখানে দৃশ্যমান নয়। সমঅধিকার, সমমর্যাদা
ও সমতার এ অনন্য প্রতিষ্ঠানটির অনুরূপ এ অঞ্চলের কোথাও আছে বলে জানা নেই।
হাসপাতালটি বাণিজ্যিক অভিপ্রায়ে প্রতিষ্ঠিত হয়নি, তাই মুনাফার বিষয় সেখানে সম্পূর্ণ পরিত্যাজ্য। ওই হাসপাতালের ট্রাস্টি এবং সিনিয়র ডাক্তার সুভাষ দাশগুপ্ত জানান, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ চিকিৎসাসেবা প্রদানে সর্বোচ্চ ৭ শতাংশ মুনাফা করে থাকে। মুনাফার ওই অর্থ হাসপাতালের উন্নয়নেই ব্যয় হয়। হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দেখানোর ফি ভারতীয় মুদ্রায় মাত্র ২০ টাকা। পরীক্ষানিরীক্ষার ক্ষেত্রেও স্বল্পমূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে, যাতে সাধারণের ওপর আর্থিক চাপ না পড়ে। যেহেতু হাসপাতালটি ব্যক্তিমালিকানার নয়, সামাজিক মালিকানায় পরিচালিত, সে কারণে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আর্থিক ঘাটতি রয়েছে। অধিক মূল্যের অত্যাধুনিক রোগ নিরূপণ যন্ত্রপাতিতে তারা আর্থিক কারণে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারেনি। অনেক হৃদয়বান ব্যক্তি ওই হাসপাতালে মূল্যবান পরীক্ষানিরীক্ষার যন্ত্রপাতি কেনায় আর্থিক সহায়তা করে থাকেন নিঃস্বার্থভাবে। ইতোমধ্যে প্রচুর আধুনিক পরীক্ষার যন্ত্রপাতি হাসপাতাল সংগ্রহ করেছে। নিজেদের আয়ে এবং দেশবিদেশের হৃদয়বানদের আর্থিক সহায়তায় আধুনিক ও সমৃদ্ধ হাসপাতালরূপে তার অবস্থান প্রায় নিশ্চিত করেছে।