× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

পহেলা বৈশাখ : আমাদের কৃষি ও সংস্কৃতি

আবু নোমান ফারুক আহম্মেদ

প্রকাশ : ১৪ এপ্রিল ২০২৪ ০৯:৫০ এএম

পহেলা বৈশাখ : আমাদের কৃষি ও সংস্কৃতি

আমরা প্রায়ই বলে থাকি কৃষিই কৃষ্টি। কৃষ্টি শব্দের অর্থ কর্ষণ, লাঙল চালনা, কৃষিকর্ম বা সংস্কৃতি। এ থেকে বোঝা যায়, এ অঞ্চলের সংস্কৃতি মূলত কৃষিনির্ভর। পহেলা বৈশাখ, যার আদ্যোপান্ত পুরোটাই আমাদের এ কৃষি, প্রকৃতি ও অর্থনীতির অংশ। প্রকৃতির সঙ্গে সখ্য রেখেই কৃষক তার ফসল খাদ্যে রূপান্তরিত করে। মুঘল আমলে একে অনুসরণ করেই শস্য উৎপাদন এবং খাজনা আদায়ের মধ্যে একটা সমন্বয় সাধনের জন্য সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। আর তাই বাংলা নববর্ষ হলো নতুন এক ফসল চক্রের শুরু।

অনেক আগে থেকেই এ অঞ্চলের মানুষ ফসলের খাতিরে বছরকে মাস ও ঋতুতে বিভক্ত করে এসেছে। পূর্ণিমার চাঁদ রাশিচক্রের যে নক্ষত্রে (যেমন বৈশাখা, জ্যৈষ্ঠা, আষাঢ়া, শ্রাবণা প্রভৃতি) দাঁড়িয়ে পূর্ণরূপে দেখা দিত, সে নক্ষত্রের নামানুসারে সে মাসের নাম হয়ে যায় বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ প্রভৃতি। ঠিক কবে থেকে সাল ও ঋতুর এরূপ ধারণা আমাদের হয়েছে, তা সুচারুরূপে নির্ণীত নয়। তবে জানা যায়, রাজা শশাঙ্কের আমলে বাঙলা সনের ব্যবহার ছিল এবং সে সময় অগ্রহায়ণকে বছরের প্রথম মাস ধরা হতো। কারণ ‘হায়ন’ অর্থ বছর, ‘অগ্র’ অর্থ প্রথম। হেমন্তের গোলা ভরা ধান আর নবান্নের উৎসবে মুখরিত মানুষ সে সময় অগ্রহায়ণে বাংলা নববর্ষের উৎসব করত।

চাঁদ, সূর্য ও নক্ষত্রের গতিবিধি, ঝড়বৃষ্টি, শীত ও উষ্ণতার হ্রাস-বৃদ্ধি মানুষ জন্মলগ্ন থেকেই লক্ষ করে এসেছে। আর তারা বহুদিনের এ পর্যবেক্ষণ প্রয়োগ করেছে কৃষিকাজে। ফসল ফলার প্রকৃতিগত পদ্ধতি মানুষ জেনেছে তা এক নির্দিষ্ট সময়ের প্রক্রিয়া। আমাদের দেশের বর্ণময় বিচিত্র প্রকৃতির সঙ্গে এ বাংলা সন প্রবর্তনের সবচেয়ে বেশি সম্পর্ক বিদ্যমান। প্রকৃতি অনুযায়ী এ দেশের ফসল ফলে। আর অর্থনীতি কৃষিভিত্তিক হওয়ায় ফসল রোপণ ও সংগ্রহের মৌসুম অনুযায়ী বাংলা সনের প্রবর্তন হয়। এজন্য বাংলা সনের আর এক নাম ‘ফসলি সাল’। এ ফসলি সাল খ্রিস্টীয় সাল দিয়ে মাপা বেশ অসুবিধার ছিল কারণ ফসল রোপণ ও সংগ্রহ করতে হতো প্রকৃতির নিয়মে। প্রকৃতি ও ফসলের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে মুঘল সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। সম্রাট আকবরের নির্দেশে সে সময়ের দিল্লি রাজদরবারের বিখ্যাত পণ্ডিত আমির ফতেহ উল্লাহ সিরাসি বাংলা সন উদ্ভাবন করেন।

সম্রাট আকবর প্রবর্তিত এ বাংলা সন তখনকার বৃহৎ বঙ্গ অর্থাৎ সুবে বাংলায় গৃহীত হয় এ দেশের আর্থসমাজ ব্যবস্থার চালিকাশক্তি রূপে। গ্রাম ও কৃষি অর্থনীতি নির্ভর দেশের রাজস্ব আদায় হতো তখন ফসল থেকে। সুতরাং কর আদায়ের এমন একটা সময় নির্বাচন প্রয়োজন ছিল যখন সবচেয়ে বেশি রাজস্ব আদায় করা সম্ভব হয়। অনেকের মতে রাজস্ব আদায়ের জন্য বৈশাখ ছিল অগ্রহায়ণের চেয়ে নানা দিক থেকে সুবিধাজনক। কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাসে বাংলার নিম্নাঞ্চলের অনেক এলাকা জলমগ্ন অথবা কর্দমাক্ত থাকার কারণে জমিদারের নায়েব-গোমস্তাদের চলাচলের অসুবিধা হয় এবং সে সময় দিন ছোট থাকার কারণে দিনের মধ্যেই দূর অঞ্চলের কর আদায় করে তারা সেরেস্তায় ফিরে আসতে পারে না। সে কারণে চৈত্র-বৈশাখের বড় দিন এবং শুষ্ক পথঘাট কর আদায়ের জন্য বিশেষ সুবিধাজনক ছিল।

অতীতে সংস্কৃতির সঙ্গে অর্থনীতির দৃঢ় যোগাযোগ ছিল। কারণ এ অঞ্চলের জাতীয় অর্থনীতি তথা কৃষিজাত দ্রব্য উৎপাদন ও বাণিজ্যের লেনদেন পহেলা বৈশাখের সঙ্গেই জড়িত। কৃষি এবং ফসলের মঙ্গল কেন্দ্র করে এখানে বেশ কিছু আচার বা উৎসব চালু ছিল। কৃষিজীবী সমাজের পারিবারিক পর্যায়ে এ ধরনেরই একটি মাঙ্গলিক উৎসবের নাম ‘আমানী’। চৈত্রসংক্রান্তির দিবাগত রাতে একটি নতুন পাত্রে পানি ঢেলে সেটিতে আতপ চাল এবং একটি কচি পাতাওয়ালা চারা আমগাছের চিকন ডাল ভিজিয়ে রাখা হতো। সকালে বাড়ির সবাইকে সেই ভেজানো চাল খেতে দেওয়া হতো। লোকবিশ্বাস ছিল, এতে সারা বছর বাড়ির সবার মঙ্গল হবে, কৃষির ফলন বাড়বে এবং এর কোনো অনিষ্ট হবে না। একই উৎপাদনব্যবস্থায় সংস্কৃতিকে বিচ্ছিন্ন করা কঠিন। তাই এ উৎসব হয়ে উঠেছিল সর্বজনীন।

ধান-পাটের মৌসুমে ফসল বিক্রির টাকায় কৃষক পরিবারের সদস্যদের কাপড়চোপড় এবং বছরের প্রয়োজনীয় জিনিস কিনত। তাই বাকিতে বেচাকেনা এবং নতুন ফসলি সালের প্রথম দিনে তা শোধ করা ছিল স্বাভাবিক রীতি। বছরের প্রথম দিন ব্যবসায়ীরা তাদের ক্রেতা-বন্ধুদের নিমন্ত্রণ করে মিষ্টিমুখ করানোর মাধ্যমে সৌহার্দ্যপূর্ণ লেনদেনের জন্য নতুন হিসাবের ‘হালখাতা’ খোলেন। আর তাই এ দিনটি হয়ে ওঠে পারস্পরিক ভাববিনিময়ের একটা উৎস। আজ পহেলা বৈশাখে লাল-সাদার রঙের খেলায় বাঙালি নিজেদের রাঙিয়ে তোলে। এ রঙের সম্মিলন মূলত হালখাতার বৈশিষ্ট্যকেই প্রতিনিধিত্ব করে। কারণ লাল কাপড়ের মলাটে বাঁধাই করা সাদা কাগজের হিসাবের খাতাই ছিল হালখাতা।

পহেলা বৈশাখের সময় কৃষি, কৃষক, অর্থনীতি এবং ব্যবসা কেন্দ্র করে উৎসবের এখানেই শেষ নয়। নতুন বছরের নতুন ধান ঘরে তোলার পর শস্যসম্পদে সমৃদ্ধ কৃষক নানানরকম পণ্যসামগ্রী আদানপ্রদানের উদ্দেশ্যে নদীতীরে, বৃক্ষছায়ায় অথবা পাহাড়ের পাদদেশে মিলিত হতো। এভাবেই একসময় গ্রামীণ অর্থনীতিতে যুক্ত হয় মেলা। পুরো বছরের উপকরণ, দৈনন্দিন জীবনের রসদ, যাবতীয় জিনিসপত্র এখান থেকেই সংগৃহীত হতো।

ঐতিহ্যগতভাবেই বৈশাখের প্রথম দিনে সবাই নিজ নিজ জমিতে চাষ দিত। সব জমিতে এক দিনে চাষ দেওয়া সম্ভব নয় বিধায় বৈশাখের প্রথম দিনে প্রতিটি জমিতেই এক পাক কিংবা দুই পাক করে লাঙল দিয়ে রাখত। এ রীতির নাম ছিল ‘হালবৈশাখ’। বর্তমানেও অনেক জায়গায় এ রীতি প্রচলিত রয়েছে। হালবৈশাখের অংশ হিসেবে বৈশাখের প্রথম দিনে গৃহপালিত গরুকে গোসল করিয়ে কপালে সিঁদুরের ফোঁটা দেওয়া হয়। এ ছাড়া কৃষিতে ব্যবহার হয় এমন উপকরণ (লাঙল, জোয়াল, মই) পরিষ্কার করে পানি দিয়ে ধুয়ে সবকটির গায়ে তিনটি সিঁদুরের ফোঁটা দেয়া হতো। হালবৈশাখ সম্পন্ন করার পর চাল, ডাল দিয়ে খিচুড়ি রান্না করে খাওয়া হয়। এ ছাড়া হালবৈশাখের দিন আরেকটি কাজ করা হয়। শোলা দিয়ে গোল ফুলের আকৃতি তৈরি করা হয়। এ ফুলটি বিভিন্ন রঙের কাপড় দিয়ে সাজানো হয়। এরপর ওই ফুলটি ক্ষেতের মাঝখানে পুঁতে দেওয়া হয়। এরপর ফসলের শুভকামনায় জমির মালিক ফুলটি ক্ষেতের মাঝখানে পুঁতে দিত।

বৈশাখপূর্ব বাঙালির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ আচার চৈত্রসংক্রান্তি। সংক্রান্তি মানে এক ক্রান্তি তথা এক কিনারা থেকে আরেক কিনারায় যাওয়া। চৈত্রে চৈতালি ফসল উঠে গিয়ে পুরো মাঠ শুকনা খরখরে হয়ে যেতে পারে। এ সময় প্রকৃতিতে কী কী খাদ্য মানুষের এবং অন্য প্রাণীর জন্য থাকে তা জানা দরকার। তাই চৈত্রসংক্রান্তিতে প্রকৃতির খোঁজখবর নেওয়া হয়। চৈত্রসংক্রান্তির খাদ্য তালিকায় কোনো মাছ-মাংস থাকবে না, থাকবে ১৪ প্রকারের কুড়িয়ে পাওয়া শাক। ১৪ রকম শাকের মধ্যে থাকে হেলেঞ্চা, ঢেঁকি, সেঞ্চি, কচু, থানকুনি, তেলাকুচা, নটে, গিমা, খারকোন, বতুয়া, দণ্ডকলস, নুনিয়া, শুশ্নি, হাগড়া, পাট, সাজনা ইত্যাদি। এসব শাক কুড়াতে মেয়েরা ১-২ কিমি পথ পাড়ি দেয়। যদি এ দূরত্বের মধ্যে অন্তত ১৪ রকমের শাক পাওয়া যায় তাহলে ধরে নেওয়া হয় প্রকৃতি ও পরিবেশ ভালো আছে।

পরিবেশ-প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের আন্তঃসম্পর্কের বিষয়টি প্রাগৈতিহাসিক। আগে মানুষ বিশ্বাস করত প্রকৃতির মধ্যে অতিভৌতিক, জীবনধাত্রী ও জীবন ধারণ করার মতো সব শর্ত বিদ্যমান রয়েছে। এজন্য প্রাগৈতিহাসিক সময়ের মানুষ প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধা দেখাত, প্রার্থনা করত। প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধামিশ্রিত চেতনা ছিল বলেই মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সহমর্মিতার সম্পর্ক দৃঢ় ছিল। কৃষির উৎপাদন পদ্ধতি এবং মানুষের জীবিকার উৎস কেন্দ্র করে যেসব আচার অনুষ্ঠান সমাজে গড়ে উঠেছিল সেসব নানা কারণে ক্রমে হারিয়ে যাচ্ছে। যদি আমরা আবার স্থায়িত্বশীল কৃষিব্যবস্থার প্রবর্তন করতে পারি, তাহলে কৃষির মাধ্যমে মানুষ ও প্রকৃতি-পরিবেশের মধ্যকার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে। যে কৃষি ও প্রকৃতি মানুষের প্রাণ বাঁচায়, সেই কৃষি ও প্রকৃতি যদি বাঁচে তবে তার সঙ্গে জীবনের উৎসবসমূহ বাঁচবে অনন্তকাল। বাঙালির চিরন্তন উৎসবগুলো বেঁচে থাকুক আপন মহিমায়-এ প্রত্যাশায় সবাইকে নববর্ষের শুভেচ্ছা।

লেখক : অধ্যাপক, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা