মযহারুল ইসলাম বাবলা
প্রকাশ : ০৯ নভেম্বর ২০২২ ২৩:১৯ পিএম
ছবি : মযহারুল ইসলাম বাবলা
বাংলা গানের প্রখ্যাত গীতিকবি গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা এবং মান্না দের গাওয়া জনপ্রিয় গানটির সুবাদে কলকাতার কলেজ স্ট্রিটের কফি হাউসের নাম-পরিচয় এবং কফি হাউস সম্পর্কে সম্যক ধারণা পেয়েছিল দুই বাংলার মানুষ। বাস্তবে আশির দশক পর্যন্ত কফি হাউস ছিল বাঙালি উঠতি তরুণ লেখক, গবেষক, কবি, সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক কর্মী থেকে সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে নিবেদিতদের প্রাণকেন্দ্র। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার সম্ভবত তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে গানটি রচনা করেছিলেন। অন্যদিকে গানটিতে কণ্ঠ দেওয়া বাংলা গানের কিংবদন্তি শিল্পী মান্না দে অকপটে স্বীকার করেছিলেন, তিনি কখনো কফি হাউসে যাননি। অথচ তার কণ্ঠেই গানটি খ্যাতি লাভ করে।
মান্না দে তরুণ বয়সেই বাংলা গানের শিল্পী না হয়ে সর্বভারতীয় প্রচার-প্রতিষ্ঠায় তার কাকা কৃষ্ণচন্দ্র দের সঙ্গে মুম্বাই পাড়ি দিয়েছিলেন। মুম্বাইর হিন্দি ছবিতে গান গেয়েছেন, সুর করেছেন। কিন্তু মুম্বাইর হিন্দিভাষী প্রতিষ্ঠিত গায়কদের অতিক্রম করা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি বলেই অবশেষে ফিরে এসেছিলেন বাংলা গানে। অবিকল মাইকেল মধুসূদনের অনুসরণে। মান্না দে'র ক্ষেত্রেও মাতৃভাষার গান পরিত্যাগে হিন্দি গানের সর্বভারতীয় শিল্পী হওয়ার ক্ষেত্রে একই ঘটনা ঘটেছে। মান্না দে পরিণত বয়সে তাই তার আক্ষেপের কথাগুলো গোপন না করে বলেছেন, ‘একমাত্র বাঙালি বলেই আমার হিন্দি উচ্চারণ মোহাম্মদ রফি, মুকেশদের মতো হতে পারেনি।’ শ্লেষে আরও বলেছেন, ‘হিন্দি গানের ভুবনে আই ওয়াজ অ্যান আউট সাইডার।’
আশির দশকে কফি হাউসে গিয়েছিলাম, ওই গানের টানেই। কফি হাউসের বেয়ারাদের সবার অভিন্ন পোশাক, মাথায় পাগড়ি। ঔপনিবেশিক আমলের খানসামাদের আদলে। পরিপাটি কফি হাউস, হল্লা নেই তবে গুঞ্জন আছে। টেবিলে টেবিলে বসা আগতরা মাটন কাটলেট, মাখন মাখানো পাউরুটি ইত্যাদির সঙ্গে কফি পান করছে। পরস্পরের সঙ্গে গুরুগম্ভীর আলোচনায় মগ্ন। দোতলা পুরোটা এবং তিন তলার প্রায় অর্ধেক এবং দুই পাশে লম্বা বেলকনি নিয়ে কফি হাউস। উচ্চৈঃস্বরে কথা কেউ বলছে না বটে তবে পরস্পরের সঙ্গে গম্ভীর আলাপ-বিতর্কের চাপা গুঞ্জন শোনা যেত। ব্যস্ত বেয়ারাদের নিঃশব্দ ছোটাছুটি, খাবার পরিবেশন সমস্তটাই ছিল আকর্ষণীয়। অতীতের কফি হাউসের ধারাবাহিকতা আশির দশকের তরুণদের বহন করতে দেখেছি।
আমার দেখা সেই কফি হাউস যে এতটা বদলে যেতে পারে তা কল্পনাও করিনি। করোনা মহামারির অল্প আগে কলকাতায় ভ্রমণসঙ্গীদের চাপে কফি হাউসে গিয়ে যে অভিজ্ঞতা হয়, তা এক কথায় ভয়াবহ। বদলে গেছে কফি হাউস, কাঠামোয় নয়। বদলে গেছে পরিবেশ। এবারে দেখা কফি হাউসের পরিবেশ আমাকে বিস্মিত করেছে। নিচতলার গেটে ঢুকতেই দেখি নকশালবাড়ি আন্দোলনকারীদের স্মরণে পোস্টার দেয়ালে সাঁটা। চারু মজুমদার, কানু সান্যাল, জঙ্গল সাঁওতাল প্রমুখ নকশালবাড়ি আন্দোলনের নেতাদের স্মরণে পোস্টার এবং পোস্টারের বক্তব্যগুলো পড়ে এক ধরনের তৃপ্তি পেয়েছি। কফি হাউসের সিঁড়িতে ওঠার ডান পাশে সিগারেটের একমাত্র ছোট্ট দোকানটি ঘিরে তরুণ-তরুণীর জটলা। কফি হাউসে ঢোকার আগে নিচে তরুণ-তরুণীদের জ¦লন্ত সিগারেট নিয়ে ওপরে ওঠা দেখে কিছুটা আঁচ করেছিলাম; তবে আমার জন্য যে আরও ভয়ানক চমক ওপরে অপেক্ষা করছে তা বুঝতে পারিনি। গেটের ডান পাশে কিছু মাঝবয়সি নারী-পুরুষ বসে আর বাঁ পাশের বিশাল অংশে বসে তরুণ-তরুণীরা অবিরাম সিগারেট ফুঁকছে। সেই ধোঁয়ায় কফি হাউস ধোঁয়াচ্ছন্ন। কফি হাউস অবাধ ধূমপানের স্থানে পরিণত। অথচ কলকাতাসহ সারা ভারতে পাবলিক প্লেসে ধূমপান নিষিদ্ধ। আইনটির কঠোর প্রয়োগের কারণে ভারতে যত্রতত্র ধূমপান বহু আগেই বন্ধ হয়েছে। কিন্তু কফি হাউসের চিত্রটি ঠিক বিপরীত। কাউন্টারের দেয়ালে ‘ধূমপান নিষিদ্ধ’ কাগজ সাঁটানো দেখেছি কিন্তু কেউই তোয়াক্কা করছে না।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, সংস্কৃত কলেজ, প্রেসিডেন্সি কলেজ, মেডিকেল কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যবর্তী কফি হাউস। পশ্চিম বাংলার সব প্রকাশনা সংস্থা ও বই বিপণিগুলো কলেজ স্ট্রিটজুড়ে অবস্থিত। কলকাতার মুক্তবুদ্ধি চর্চা, জ্ঞানের চর্চা, সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চা, প্রগতিশীল ও সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের জন্য কফি হাউস ঐতিহ্যের স্মারক। তার বর্তমান দশা সর্বোপরি তারুণ্যের অবক্ষয় ও অপচয়ের চিত্রটিতে ফুটে উঠেছে কলকাতার বর্তমান সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিপর্যয়ের ছবি। বহু আগে থেকে রাজধানী কলকাতা এবং পশ্চিম বাংলা ছিল অবিভক্ত বাংলার সব ক্ষেত্রেই অগ্রসর অংশ। বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি ভারতবর্ষের অন্যান্য জাতির ওপর পর্যন্ত প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছিল। আমাদের পূর্ব বাংলাও পশ্চিম বাংলার সাংস্কৃতিক বলয়ে প্রভাবিত ছিল। সেই কলকাতার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ক্রমেই অপসংস্কৃতরি আগ্রাসনে-অনুকরণে অবক্ষয়ের দ্বারপ্রান্তে। যার নমুনা কফি হাউসে দেখা সাংস্কৃতিক অবক্ষয়ের ভেতর ফুটে উঠেছে।
গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের গানে কফি হাউসের যে বর্ণনা তিনি দিয়েছিলেন তার ধারাবাহিকতা আশির দশক পর্যন্ত অটুট থাকলেও ক্রমেই আর অক্ষুণ্ন থাকেনি। আজ পশ্চিম বাংলার সংস্কৃতি, মতাদর্শিক রাজনীতি, গণমুক্তির লড়াই পুঁজিবাদী তৎপরতায় পথ হারিয়েছে। কলকাতার অতীত বাংলা গান, চলচ্চিত্র, সাহিত্য, নাটক, মতাদর্শিক রাজনীতি মধ্যবিত্ত শ্রেণির তরুণ-তরুণীদের আর আকর্ষণ করে না। বিপরীতে বোম্বেটে জীবনাচারকে তারা সানন্দে গ্রহণ করে বাঙালিয়ানা বিসর্জন দিয়েছে। পশ্চিম বাংলার মধ্যবিত্তরা নিজেদের জাতিসত্তা পর্যন্ত ত্যাগ করতে সামান্য দ্বিধা করেনি, ওই শ্রেণি-উত্তরণ বা ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠার মোহে। সর্বভারতীয় জাতিরূপে নিজেদের জাতিসত্তা বিলুপ্ত করে হিন্দি-ইংরেজি মিশেলে বলিউড চলচ্চিত্রের উপাদানে বোম্বেটে জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে।
পশ্চিম বাংলার মধ্যবিত্তের উচ্চাকাক্সক্ষাটি হচ্ছে সর্বভারতীয় প্রতিষ্ঠা। সেই প্রতিষ্ঠালাভ বাঙালি মধ্যবিত্তের সনাতনী বলয়ে আটকে থাকলে সম্ভব হবে না। তাই জাতিগত ভাষা-সংস্কৃতি ত্যাগ করে সর্বভারতীয় হিন্দি-ইংরেজি রপ্ত করা চাই। ভারতীয় শাসক শ্রেণির নির্দেশিত-নির্ধারিত পথেই বাঙালি মধ্যবিত্ত তরুণ-তরুণী নিজেদের গড়ে তুলছে ওই পথালম্বনে। জাতীয়তা ত্যাগে সর্বভারতীয় হিন্দি ভাষা-সংস্কৃতি গ্রহণের হিড়িক পড়েছে। আর পড়বে না কেন! রাজ্য সরকারের চাকরির তুলনায় কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরিতে দ্বিগুণ বেতন, ভাতা, বোনাস। এমনকি সপ্তাহে এক দিনের স্থলে দুই দিন ছুটি। সে তো আকৃষ্ট করবেই। কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরি পাওয়ার সব যোগ্যতার প্রধান যোগ্যতাটি হচ্ছে হিন্দি ও ইংরেজিতে পারদর্শী হওয়া। সেটা ছাড়া কোনো যোগ্যতাই বিবেচ্য বলে গণ্য হয় না।
ভারতীয় পুঁজিপতিরা ঔপনিবেশিক আমলে এক রাষ্ট্রাধীনের সুবিধা পেয়েছিল। কিন্তু বহু ভাষাভাষী ভারতে বাণিজ্যের অবাধ সুবিধায় এক ভাষা অর্থাৎ হিন্দি ভাষা প্রসারে যারপরনাই চেষ্টা চালিয়েছিল। সাতচল্লিশের পর স্বাধীন ভারতের শাসকরা পুঁজিপতিদের সেই বাসনা পুরোপুরি পূরণ করেছিল হিন্দি ভাষাকে সরকারি ভাষার স্বীকৃতি দিয়ে ভারতীয় জনগণের ওপর চাপিয়ে। এতে যে বহু ভাষাভাষীর ভারতে অসন্তোষের ঘটনা ঘটেনি বা ঘটছে না তা কিন্তু নয়। জাতিগত ক্ষোভ-বিক্ষোভ, সংগ্রামকে কঠোর হাতে দমন করছে বিচ্ছিন্নতাবাদী অভিধায়। প্রত্যেক জাতির জাতিসত্তার ভিত্তিমূলেই ভাষা-সংস্কৃতি।
পুঁজিবাদ ব্যক্তিগত মালিকানা ও উন্নতিতে সমর্থন জোগায়। সমষ্টিগত উন্নতি-সামাজিক মালিকানা পুঁজিবাদের প্রধান শত্রু এবং প্রতিপক্ষ। পুঁজিবাদী তৎপরতা ভারতে যেমন আমাদের দেশেও তেমনি ক্রমাগত বিস্তৃতি লাভ করেছে। ব্যক্তিগত ভোগবিলাসিতাও দুই দেশেই প্রবলভাবে ব্যাপৃত। জাতিগত চেতনা- শ্রেণিসংগ্রাম সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত করা সম্ভব হয়নি বলেই বিচ্ছিন্নভাবে সেটার প্রকাশ ঘটছে অহিংস ও সহিংস দুই পথেই। স্রোতের বিপরীতে দাঁড়াবার মানুষ নিঃশেষ হয়ে যায়নি। তাই আশাজাগানিয়া ভাষিক জাতীয়তাবাদ এবং শ্রেণিসংগ্রাম স্বল্পপরিসরে হলেও চলছে এবং চলবে। সেটাই সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতীয় জনগণের জন্য আশাবাদ বলে বিবেচনার দাবি রাখে।
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত