সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়
প্রকাশ : ০৮ এপ্রিল ২০২৪ ১১:৩৯ এএম
পল্লীকবি জসীম
উদ্দীন বলেছিলেন, ‘বিপদ কাটাতে মোরা হাত জোড় করি,/ বিপদ কাটিলে পুনঃ নিজ মূর্তি ধরি।/
অসময়ে চিকিৎসককে বন্ধু বটে কই,/ সুসময়ে দেখা হলে মুখ ফিরে লই।’ কবির এই উক্তির মধ্য
দিয়ে চিকিৎসকদের প্রতি সম্মানের যে গভীর অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে তা আজ অনেকাংশে
ক্ষীয়মাণ হতে শুরু করেছে। সম্প্রতি দেশে ভুল চিকিৎসায় ও অস্ত্রোপচারজনিত কারণে কয়েকজন
রোগীর মর্মস্পর্শী প্রাণহানির মধ্য দিয়ে আমাদের স্বাস্থ্যসেবা খাতের বিবর্ণ চিত্র ফের
উন্মোচিত হয়েছে। এই বাস্তবতায়ই ৭ এপ্রিল বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও পালিত
হয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস। ওই দিন প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর শীর্ষ প্রতিবেদনে দেশের
স্বাস্থ্য খাতের সামগ্রিক যে চিত্র উঠে এসেছে তা প্রীতিকর নয়। ‘টাকার অভাবে তিন কোটি
মানুষ পায় না চিকিৎসা’ শিরোনামে প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনের গর্ভে নিহিত তথ্য অনেক প্রশ্নই
দাঁড় করায়।
আমাদের সাংবিধানিক
অঙ্গীকার রয়েছে সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা। কিন্তু টাকার অভাবে মোট জনগোষ্ঠীর
উল্লেখযোগ্য একটি অংশ চিকিৎসা নিতে পারে না, এই তথ্য অনাকাঙ্ক্ষিত-অনভিপ্রেত এবং সাংবিধানিক
অঙ্গীকার ও সরকারের প্রতিশ্রুতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
এ কথাও অসত্য নয়, নানাবিধ সংকটের মধ্য দিয়েও গত পাঁচ দশকে স্বাস্থ্য খাত ধাপে ধাপে
এগিয়েছে। আমরা জানি, ধারাবাহিক আওয়ামী লীগ সরকার স্বাস্থ্য খাতের উন্নতির জন্য নিরলস
প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। কিন্তু সরকারের অঙ্গীকার-প্রতিশ্রুতি কিংবা প্রচেষ্টার সুফল
যাদের মাধ্যমে দৃশ্যমান হবে এবং জনবিড়ম্বনা লাঘবের পথ মসৃণ করবে তাদের অনেকেরই দায়িত্ব-কর্তব্যনিষ্ঠা
নিয়ে প্রশ্ন আছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের প্রাক্কালে দেওয়া বাণীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ
হাসিনা বলেছেন, ‘২০৩০ সালের মধ্যে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সরকারি
উদ্যোগের পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা এবং প্রতিষ্ঠানকেও এগিয়ে আসতে হবে।’ প্রধানমন্ত্রীর
এই আহ্বান নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বেসরকারি খাতে স্বাস্থ্যসেবাকে কেন্দ্র
করে অনেক ক্ষেত্রেই চলছে রমরমা বাণিজ্য। বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক
সেন্টারের অনিয়ম-দুর্নীতির পাশাপাশি অব্যবস্থাপনার নজিরও কম নেই। নিকট অতীতেও অবৈধ
হাসপাতাল-ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বিরুদ্ধে কোন প্রেক্ষাপটে ফের অভিযান পরিচালিত
হয়েছে, তাও সচেতন মানুষমাত্রই জানা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য
সংস্থার গাইডলাইন অনুযায়ী, দেশের মোট বাজেটের ১৫ শতাংশ এবং জিডিপির ৫ শতাংশ স্বাস্থ্য
খাতে বরাদ্দের নীতিমালা রয়েছে। কিন্তু প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর ওই প্রতিবেদনেই আমরা
দেখছি, ২০১০ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে তা সাড়ে ৬ শতাংশের ওপরে যায়নি। প্রতিবেদনের আরও তথ্য,
চিকিৎসা ব্যয়ের ৬৯ শতাংশ যায় নিজের পকেট থেকে এবং প্রায় ৬৪ লাখ মানুষকে চিকিৎসা ব্যয়
মেটাতে গিয়ে দরিদ্রের কাতারভুক্ত হতে হচ্ছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ৬০ শতাংশ মানুষ
সরকারি চিকিৎসাসেবার আওতার বাইরে রয়েছে এবং দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে স্বাস্থ্যসেবায় সর্বনিম্ন
ব্যয় বাংলাদেশে, যা জিডিপির ১.৩ শতাংশ। আমরা মনে করি, স্বাস্থ্য খাতে জিইয়ে থাকা অনিয়ম-দুর্নীতির
উৎসে শ্যেন দৃষ্টি দেওয়ার পাশাপাশি জিইয়ে থাকা অসঙ্গতি-অপূর্ণতা দূর করতে না পারলে
সরকারের অঙ্গীকার-প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন কঠিন এবং ২০৩০ সালের মধ্যে সর্বজনীন স্বাস্থ্য
সুরক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্য হোঁচট খেতে পারে। এবারের বিশ্ব
স্বাস্থ্য দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল, ‘আমার স্বাস্থ্য, আমার অধিকার’। প্রশ্ন দাঁড়ায় এই
অধিকার নিয়েই। আমরা দেখেছি, অনেক বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টারে চলছে
‘জীবন নিয়ে জুয়া’র মতো কর্মকাণ্ড। এর ফলে শুধু অধিকারের ক্ষেত্রেই প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি
হচ্ছে না, স্বাস্থ্যঝুঁকিও ক্রমেই বাড়ছে। আমেরিকান
রাজনীতিবিদ ও চক্ষুবিশেষজ্ঞ স্টিভ ম্যাগি বলেছেন, ‘আমি উন্নত হওয়ার জন্য চিকিৎসকের কাছে গিয়েছিলাম, পরিবর্তে
তারা আমাকে আরও অসুস্থ করেছে।’ দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের সমাজবাস্তবতায় অনেকাংশেই তা
প্রতিভাত হয়ে উঠেছে। আমরা জানি, দেশের চিকিৎসাসেবায় একধরনের অনাস্থার সৃষ্টি হয়েছে
এবং এই প্রেক্ষাপটে উন্নত দেশের কথা বাদই দিলাম; প্রতিবেশী ভারতে সিংহভাগ রোগী চিকিৎসা
নিতে যাচ্ছে। এর ক্ষতি যে বহুমাত্রিক তা-ও আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
গত বছর ২৩ জুলাই
‘ডাক্তারদের পটাতে চেক বাড়ি গাড়ি সবই’, ‘উপহারের টাকা উশুল রোগীর গলা কেটে’, ‘কমিশন বাণিজ্যে বিপুল রোগ নির্ণয়ের খরচ’ এই শিরোনাম যুক্ত
প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ ধারাবাহিক প্রতিবেদনগুলোতে যে চিত্র উঠে এসেছিল তা যে দায় ও
মানবিকতার মূলে কুঠারাঘাত, এ আর বলার অপেক্ষা রাখে না। দার্শনিক প্লেটো বলেছেন, ‘ডাক্তারদের
ভুল এই যে তারা শরীরকে সারাতে চান মনকে বাদ দিয়ে, অথচ মন এবং শরীর একই এবং আলাদাভাবে
তাদের চিকিৎসা করা উচিত নয়।’ আমরা মনীষীদের এই মহান উক্তিগুলো স্মরণ করি সঙ্গত কারণেই।
দেশে দারিদ্র্যের হার অনেক কমে এসেছে এ কথা অসত্য নয়, সরকারের তরফে গৃহীত সামাজিক নানা
নিরাপত্তামূলক কর্মসূচির পরিসরও ক্রমেই বিস্তৃত হচ্ছে এ-ও সত্য; কিন্তু দেশের উল্লেখযোগ্য
শ্রেণির মানুষ এখনও বাস করছে বৈষম্যের গাঢ় ছায়াতলে এই বাস্তবতাও এড়ানোর অবকাশ নেই।
আমরা স্বাস্থ্য
মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তরকে স্বাস্থ্য খাতে জিইয়ে থাকা ব্যাধিগুলোর উপশমে ‘টোটকা দাওয়াই’র
পরিবর্তে জনস্বার্থে দৃষ্টান্তযোগ্য ব্যবস্থা নেওয়ার ফের দাবি জানাই। একদিকে নকল-ভেজাল
ওষুধে বাজার সয়লাব অন্যদিকে ওষুধের দাম ক্রমাগত হচ্ছে গগণমুখী; এই বাস্তবতাও সর্বজনীন
স্বাস্থ্য সুরক্ষার ক্ষেত্রে কতটা অন্তরায় এরও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ নতুন করে নিষ্প্রয়োজন।
স্বাস্থ্যসেবা সহজলভ্য ও মানসম্পন্ন করার পাশাপাশি চিকিৎসাসেবার নামে রমরমা বাণিজ্যের পথ রুদ্ধ করতে
সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। অনভিপ্রেত হলেও সত্য, স্বাস্থ্য খাতে অব্যবস্থাপনার
কারণে এটি উচ্চ মুনাফাভিত্তিক একটি ব্যবসা খাতে পরিণত হয়েছে। নাগরিকের মৌলিক অধিকার
নিয়ে এমন ‘পাশা খেলা’ কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। সরকারি-বেসরকারি চিকিৎসাসেবা খাতের
স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠায় তথা এ খাতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণে একটি স্বাধীন
কমিশন গঠনের প্রয়োজনীয়তার কথা আমরা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। এই কমিশন এ খাতের চিহ্নিত
সমস্যাগুলোর সমাধানে উপায় অনুসন্ধান করবে এবং এ অনুসারে কাজ করার সুযোগের পথও করতে
হবে অবারিত। চিকিৎসাসেবা খাতে অভাব দূর করতেই হবে জনগোষ্ঠীর বৃহৎ স্বার্থে।
গত ফেব্রুয়ারিতে
ঢাকায় অনুষ্ঠিত চতুর্থ আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক সম্মেলন ২০২৪-এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনকালে
রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন আহ্বান জানিয়েছেন, দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য চিকিৎসা
পরিষেবা নিশ্চিত করতে চিকিৎসক-সেবিকাসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে আন্তরিকভাবে দায়িত্ব পালনের।
তিনি এ-ও বলেছেন, গরিবদের চিকিৎসাসেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। নিঃসন্দেহে
রাষ্ট্রপতির এই বক্তব্য সাধুবাদযোগ্য। আমরা মনে করি, সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত
করা এবং স্বাস্থ্য খাতের অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধের পাশাপাশি স্বচ্ছতা-জবাবদিহি নিশ্চিত
করার জন্য সরকারের কঠোর কার্যকর পদেক্ষপ নেওয়া সময়ের গুরুত্বপূর্ণ দাবি।