প্রাকৃতিক দুর্যোগ
ড. মোহাম্মদ জহিরুল হক
প্রকাশ : ০৮ এপ্রিল ২০২৪ ১১:৩৪ এএম
ড. মোহাম্মদ জহিরুল হক
প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জলবায়ু
পরিবর্তনের বৈরী প্রভাবে ম্লান সিলেট ও হাওরাঞ্চলের ঈদ আনন্দ। গত ৩১ মার্চ রবিবার
রাত ১০টা থেকে সাড়ে ১০টা পর্যন্ত কালবৈশাখীর সঙ্গে বর্ষিত শিলাবৃষ্টির আকার ও
মাত্রার ধকল এখনও সিলেট নগর এবং আশপাশের জনপদ কাটিয়ে ওঠতে পারেনি। কালবৈশাখের সঙ্গে
শিলাবৃষ্টি স্বাভাবিক ঘটনা হলেও এবার চৈত্র মাসে বর্ষিত শিলার আকার ও বর্ষণের
মাত্রা স্মরণকালের রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। ঈদের কেনাকাটায় আসা ও তারারি নামাজ শেষে ঘরে
ফেরা লোকজন শিলার আঘাতে আহত হয়েছেন। অনেককে হাসপাতালেও ভর্তি হতে হয়েছেন। রাস্তায়
চলাচলরত এবং মার্কেট ও বাসাবাড়ির সামনে পার্কিং করে রাখা গাড়ির কাচ ভেঙেছে, গাড়ির
চাল ফুটো হয়ে গেছে। এ রকম ক্ষতিগ্রস্ত গাড়ির সংখ্যা অন্তত কয়েক হাজার। নতুন কাচ
লাগালেও শিলার আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত গাড়ির ছাদ মেরামত করাতে পারেননি অনেকে। সিলেট
শহরের অনেক গাড়ি দেখলে মনে হয় যেন গায়ে বসন্তের ক্ষত নিয়ে চলছে যানগুলো। গাড়ি
মেরামতের কারখানাগুলো দিন-রাতে কাজ করেও এসব ক্ষতিগ্রস্ত গাড়ি সারিয়ে তুলতে পারছে
না। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ডও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষেতের সবজি ও ফসল নষ্ট
হয়েছে। যাদের টিনের ঘর ছিল তাদের দুর্ভোগের সীমা নেই। সিলেটে গেল সপ্তাহ টিনের
সংকট ছিল।
চট্টগ্রাম কারখানা ও আশপাশের জেলাগুলো
থেকে টিন এনে চাহিদা সামাল দিতে হয়েছে। সামর্থ্য না থাকায় অনেকে শিলার আঘাতে গর্ত
হয়ে যাওয়া টিনে পলিথিন মুড়িয়ে কোনোক্রমে দিনাতিপাত করছেন। আমাদের ব্যবসায়ীদের
অনেকেরই নৈতিকতা নিয়ে আর না-ই বললাম। টিনের দাম বেড়ে যাওয়ায় কেবল নিম্নবিত্ত নয়;
উচ্চবিত্তের লোকজনও বিড়ম্বনায় পড়েছেন। ক্ষতিগ্রস্তরা ঈদের বাজেট দিয়ে ঘরবাড়ি
মেরামতের খরচ সামাল দিচ্ছেন। ফলে সিলেটে ঈদের বাজারে পড়েছে নেতিবাচক প্রভাব। এ ছাড়া
চৈত্র মাসে প্রতি রাতে রুটিন করে রাত ১০টা থেকে ১১টার দিকে কালবৈশাখীর তাণ্ডবে
ব্যবসায়ীদের কপালে হাত। শিলাবৃষ্টির আতঙ্কে রাতে গাড়ি নিয়ে বের হতে অনেকে রীতিমতো
ভীত। একদিকে শিলাবৃষ্টির ক্ষতি পোষাতে ঈদ বাজেটে টান, অপরদিকে প্রতি রাতে
কালবৈশাখের হানায় সিলেটে এখনও ঈদের বাজারে ব্যবসায়ীদের স্বস্তি ফিরে আসেনি। অথচ
রাজনৈতিক অস্থিরতার শঙ্কা কাটিয়ে একদিকে ঈদের প্রাক্কালে মাসিক বেতন, অপরদিকে ঈদ ও
বোশাখি উৎসব বোনাস দুটি কাছাকাছি সময় ও সঙ্গে ঈদের লম্বা ছুটি সব মিলিয়ে এবারের
ঈদে ভিন্ন আমেজ থাকার কথা থাকলেও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের
হানা হাওরবেষ্টিত সিলেট অঞ্চলের ঈদ আনন্দে কিছুটা চিড় ধরেছে।
উত্তর-পূর্বদিক থেকে প্রবাহিত হয় বলে
অবস্থানগত কারণেই কালবৈশাখীর অভিজ্ঞতা সিলেট অঞ্চলের জন্য নতুন কিছু নয়। তবে চৈত্র
মাসের মাঝামাঝি তথা এপ্রিলের শুরুতে এ ঝড়ের মাত্রা ও ধরন ব্যতিক্রম। সেটিই হচ্ছে
আতঙ্কের। এ ছাড়া আবহাওয়া দপ্তর ও পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে মেঘালয়ে ভারী ও সিলেটে অতিবৃষ্টির
সম্ভাবনায় এতদঞ্চলে আগাম বন্যার আশঙ্কায় কৃষকের মাথায় হাত। ২০১৭ সালের আগাম বন্যার
ভয়াবহ রূপ ও ব্যাপক ফসলহানি এখনও সিলেট বিভাগ তথা সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জের হাওর
এলাকার জনগণের মধ্যে আতঙ্ক ছড়ায়। এ ছাড়া ২০২২ সালের বন্যার ভয়াল স্মৃতি ম্লান হয়নি
আজও।
বাংলাদেশে উৎপাদিত ধানের ৬০ ভাগের
বেশি আসে বোরো মৌসুমে। আর উৎপাদিত বোরো ধানের প্রায় এক-চতুর্থাংশ জোগান দেয়
হাওরাঞ্চল। হাওর এলাকায় বোরোর বাম্পার ফলন ও তা নির্বিঘ্নে ঘরে তোলার ওপর কেবল
এতদঞ্চলের কৃষকদের সারা বছর ভালো থাকা নয়; বরং পুরো দেশের খাদ্যনিরাপত্তা
নির্ভরশীল। ২০১৭ সালে ১০ লাখ মেট্রিক টনের বেশি পাকা ধান পানিতে তলিয়ে পচে যাওয়ার
ভবাবহ স্মৃতি আজও সিলেটের হাওরের জনপদকে তাড়া করে। সেসময় হাওর রক্ষা বাঁধ নির্মাণ
ও মেরামতে পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের
গাফিলতিকে দায়ী করা হয়েছিল। দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে সরকারের ‘কঠোর হুশিয়ারি’
শুনেছেন দেশবাসী। ঠিকাদাররা গা ঢাকাও দিয়েছিলেন। যদি আবহাওয়ার পূর্বাভাস অনুযায়ী এ
মাসের শেষ দিকে আগাম বন্যা হয়েই যায় তাহলে সৃষ্ট পরিস্থিতি বলে দেবে আমরা ২০১৭ ও
২০২২ সাল থেকে কী শিক্ষা নিয়েছি।
মেঘালয় ও সিলেটে ভারী ও অতিবৃষ্টির জন্য আগাম বন্যার আশঙ্কা হাওরের
কৃষকরা দুর্ভোগের আতঙ্কে দিনাতিপাত করছেন। ৭৩৪টির মধ্যে অধিকাংশ বাঁধই টেকসই হয়নি
বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ড বাঁধ মেরামতে তৎপর বলে হাওরের কৃষকদের
আশ্বস্ত করছে। তারা এও বলছে, বাংলাদেশে অতিবৃষ্টি হলেও যদি মেঘালয়ে কম বৃষ্টিপাত
হয় তাহলে আগাম বন্যা বা ফসলহানি, কোনোটির সম্ভাবনা নেই। এখন সবাই মহান আল্লাহর
কাছে দোয়া করছেন অন্তত সামনের এক মাস যেন মেঘালয়ে ভারী ও অতিবৃষ্টি না হয়। এ ধরনের
প্রাকৃতিক দুর্যোগের আশঙ্কা ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিরূপ আবহাওয়ার আতঙ্কের মাঝে
হাওর জনপদে ঈদ উৎসব অনেকটাই ম্লান। প্রতিদিন তারাবি নামাজের পর, জুমাতুল বিদা ও
শবেকদরের দোয়ায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে মুক্তি পেতে আল্লাহর দরবারে মোনাজাত করা
হচ্ছে। সবার একটাই চিন্তা ফসল ঘরে তুলতে পারব তো?
বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশ তথা সিলেট এলাকায় বৃষ্টির ধরনেও পরিবর্তন এসেছে। এখন বৃষ্টি মানেই গভীর ও ভারী। আবার মেঘালয় থেকে বৃষ্টির পানি বাংলাদেশ তথা সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের হাওরে নেমে আসতে মোটামুটি ৮ ঘণ্টা সময় লাগে। এমতাবস্থায় পানির ধারণক্ষমতা বাড়ালেই আমরা অতিবৃষ্টি, ভারী বৃষ্টি ও আগাম বন্যায় ফসলহানি ঠেকিয়ে দিতে পারতাম। এটাই পরিবেশবাদী ও বন্যা বিশেষজ্ঞরা বারবার বলে আসছেন। নদ-নদীর নাব্য ফিরিয়ে আনা, খাল ও ডোবা উদ্ধার এবং খনন ও হাওরের আড়াআড়ি সড়কসহ পরিবেশ এবং প্রতিবেশগত সমীক্ষা ব্যতিরেকে নির্মিত সব অবকাঠামো অপসারণই হবে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় মূখ্য করণীয়। তাতে বাঁচবে হাওরাঞ্চলের মানুষ। নিশ্চিত হবে দেশের খাদ্যনিরাপত্তা।