জাতীয় স্বার্থ
ড. ফরিদুল আলম
প্রকাশ : ০৬ এপ্রিল ২০২৪ ১২:০৭ পিএম
ড. ফরিদুল আলম
দর্শন কিংবা স্পষ্ট দিকনির্দেশনাহীন রাজনীতির বিরূপ প্রভাব ৫৩ বছরে বাংলাদেশে আমরা
কম দেখিনি। এরই কিছু চিত্র ফের দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। দলের
শীর্ষনেতারা একে একে কারামুক্ত হওয়ায় বিএনপি নতুন করে সরকারবিরোধী আন্দোলন চাঙা
করার কৌশল খুঁজছে। সব মিলিয়ে এ মুহূর্তে তিনটি বিষয় কেন্দ্র করে তাদের রাজনীতি
ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা করছে বলে মনে হচ্ছে। বিষয়গুলো হচ্ছে প্রথমত, সাম্প্রতিক
সময়ে তাদের ভারতবিরোধী অবস্থান আরও সুদৃঢ় করা। কারণ তারা যে বিষয়টি বর্তমানে
উপলব্ধি করছে তা হলো, ভারতের সঙ্গে তাদের এ মুহূর্তে আর সখ্যের কোনো সুযোগ নেই।
বরং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা কিছু মিত্র তাদের সঙ্গে রয়েছে, যারা এ সুযোগ
কাজে লাগাতে চায়। সেই সঙ্গে জনগণের একটা অংশের মধ্যেও যে ধরনের ভারতবিরোধী মনোভাব
রয়েছে, তার সুযোগ নেওয়া। এ ক্ষেত্রে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভারত বাংলাদেশের
গণতান্ত্রিক ধারার পক্ষে যে অবস্থান নিয়েছিল, তাকে ভারতের জাতীয় স্বার্থের নিরিখে
আমাদের অভ্যন্তরীণ স্বার্থের প্রতিকূলে উপস্থাপন করাকে তারা শ্রেয় উপায় বলে মনে
করছে। আর তাদের এ পরিকল্পনার সঙ্গে নির্দ্বিধায় জামায়াতে ইসলামীকে সঙ্গে পাবে ধরে
নিয়ে পুরোনো বন্ধুত্ব আরেকটু চাঙা করে সরকারবিরোধী আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করা
যায় কি না সে ভাবনা তাদের সর্বাগ্রে রয়েছে। দ্বিতীয়ত, এর মধ্য দিয়ে সাংগঠনিক
কর্মকাণ্ডেও এক ধরনের গতিশীলতা ফিরে আসবে বলে তারা ধরে নিয়েছে এবং তৃতীয়ত, এ
ধারাবাহিকতায় তারা রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিজেদের অনুকূলে নিয়ে দলের সপ্তম কাউন্সিল
অনুষ্ঠানের পরিকল্পনাও মাথায় রেখেছে।
এ রকম প্রস্তুতির পর্যায়ে এসে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি
বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাম্প্রতিক অস্থিরতায় বিএনপির রাজনীতির জন্য নতুন কোনো
উপাদান যুক্ত করল কি না তা-ও বর্তমান সময়ের অন্যতম চর্চিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারপন্থি
ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের বিষয়টি নিয়ে প্রথমে সরব
হয়েছিল এবং ২৭ মার্চ রাতে ছাত্রলীগের জনৈক নেতার উদ্যোগে সেখানে গোপন বৈঠক কেন্দ্র
করে সরব হয়ে ওঠেন। সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে কিছু ছাত্র, যদিও এ সংখ্যাটি পরে
অনেক বেড়েছে এবং ছাত্ররাজনীতির সপক্ষের চেয়ে অবস্থাদৃষ্টে এর বিপক্ষের পাল্লাই
ভারী মনে হচ্ছে। পরিস্থিতি হয়তো এত বেশি উত্তপ্ত না-ও হতে পারত, যদি এ আগুনে ঘি না
ঢালতেন সরকারের কয়েকজন দায়িত্বশীল মন্ত্রী ও নেতা। ছাত্রলীগের দাবির সঙ্গে
একাত্মতা পোষণ করে তারাও বলতে লাগলেন, বুয়েট নিষিদ্ধ হিযবুত তাহরীরসহ মৌলবাদী
রাজনীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে এবং ক্যাম্পাসে রাজনীতি নিষিদ্ধের এ সুযোগ কাজে
লাগাচ্ছে তারা। একপর্যায়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমাবেশসহ বিষয়টি নিয়ে হাইকোর্টের
দ্বারস্থ হতে হয়। হাইকোর্ট বুয়েটে রাজনীতি নিষিদ্ধের মতো বিষয়টিকে সংবিধানের
চেতনাবিরোধী আখ্যা দিয়ে ইতঃপূর্বে (২০১৯ সালে) বুয়েট কর্তৃপক্ষ ঘোষিত রাজনীতি
নিষিদ্ধের সিদ্ধান্তটি অবৈধ বলে ঘোষণা করেন। সঙ্গে সঙ্গেই ক্যাম্পাসে রাজনীতির
পরিবেশ আবারও ফিরে এসেছে দাবি করে ছাত্রলীগ বুয়েট ক্যাম্পাসে জাতির পিতার
প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক প্রদানের নামে তাদের শোডাউন করে। উপাচার্য জানালেন,
হাইকোর্টের নির্দেশ শিরোধার্য। অর্থাৎ তার কথা থেকে যে বিষয়টি সবার কাছে বোধগম্য
হতে থাকল তা হচ্ছে, এ নিয়ে আর কিছুই করার নেই, যার অর্থ দাঁড়ালÑপ্রায় পাঁচ বছর
বিরতির পর সেখানে আবারও রাজনীতি শুরু করতে আর কোনো বাধা নেই।
বিষয়গুলোকে এমনভাবে সরলীকরণ করা হচ্ছে, এর মধ্য দিয়ে বুয়েট
ক্যাম্পাসই কেবল নয়, সারা দেশে ছাত্ররাজনীতি অন্যরকম নেতিবাচকতার দিকে ধাবিত হতে
পারে। এটি বোধ হয় সংশ্লিষ্ট মহল আঁচ করতে পারছেন না কিংবা করার প্রয়োজন মনে করছেন না।
কবে, কেন এবং কোন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বুয়েট কর্তৃপক্ষ ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ
করতে বাধ্য হয়েছিল তা বোধ হয় আমরা বেমালুম ভুলে গেছি। স্মরণে আছে, যে সময় থেকে
অর্থাৎ আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের পর যখন বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের আন্দোলন শুরু
হয়, এর কাছাকাছি সময়ে বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে টর্চার সেলে
ছাত্রনির্যাতনের বেশ কিছু সংবাদ প্রকাশিত হয়। এর বাইরে একটি নির্দিষ্ট ছাত্র সংগঠন
দেড় দশক ধরে ছাত্ররাজনীতির নামে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় যে ধরনের তাণ্ডব
চালিয়ে আসছে এবং একপর্যায়ে এ সংগঠনের নারী সদস্যদেরও এ ধরনের কর্মকাণ্ডে সরব হতে
দেখে ছাত্রছাত্রীসহ সাধারণ মানুষের মনে ছাত্ররাজনীতি নিয়ে ইতিবাচক ধারণা পোষণ করার
আর কোনো অবকাশ নেই। অবশ্য স্বাধীনতার পর থেকেই বিশেষ করে জাতির পিতার হত্যাকাণ্ডের
পর থেকেই সামরিক শাসকচক্রের হাত ধরে দেশে ছাত্ররাজনীতির নামে যে ধরনের অপতৎপরতা
শুরু হয়, সময়ের ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামী লীগের হাতে দেশ পরিচালিত হলেও এ
রাজনীতির খপ্পর থেকে আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো মুক্ত হতে পারেনি।
বুয়েটের চলমান ঘটনা নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে সাম্প্রতিক
তৎপরতায় নিঃসন্দেহে সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করছে বিএনপি। তাদের ছাত্র সংগঠন ছাত্রদল ৩
এপ্রিল ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সংবাদ সম্মেলন করে সাধারণ ছাত্রদের
রাজনীতিবিরোধী অবস্থানের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেছে। অবশ্য তাদের এ তৎপরতা যে হালে
পানি পাবে বা পাচ্ছে, এমনটাও ভাবার কারণ নেই। বুয়েটের আন্দোলনরত ছাত্ররা ছাত্রদলের
এ ধরনের সংহতি প্রকাশকে প্রত্যাখ্যান করে একে রাজনৈতিকভাবে মদদপুষ্ট বলে বর্ণনা
করেছেন। তবে এর অর্থ এই নয় যে, বিষয়টি আওয়ামী লীগ বা সরকারের পক্ষে চলে গেল। এখানে
এ মুহূর্তে অনেকেই সরকারের বর্তমান অবস্থানের বিপক্ষে কথা না বললেও বিষয়টি ভালোভাবে
দেখছেন না। এর কারণ একটাই, তা হলো আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় ছাত্ররাজনীতির
নামে যে নৈরাজ্য চলছে, এর ধারাবাহিকতায় বুয়েট ক্যাম্পাসে আবারও যদি রাজনীতির চর্চা
শুরু হয়, সেটা যে কেবল ছাত্রলীগকে একপক্ষীয় সুবিধা দেবে কেবল তাই নয়, এর বাইরে
সুস্থধারার রাজনীতিচর্চার কোনো নিশ্চয়তা নেই।
একটি বিষয়ে কারও দ্বিমত প্রকাশের সুযোগ নেই, তা হলো বুয়েটের
শিক্ষা আন্তর্জাতিক মানের এবং এখান থেকে পাস করে অনেকেই দেশে-বিদেশে খ্যাতি অর্জন
করছেন। সেই জায়গা থেকে দেখলে সচেতন মানুষমাত্রই আমাদের প্রচলিত ধারার রাজনীতির
নামে বুয়েটের সর্বনাশ প্রত্যাশা করবেন না। আর সরকার বা সরকারের সমর্থকরা যে বিষয়টি
বলার চেষ্টা করছেন, বুয়েটে রাজনীতি নিষিদ্ধের নামে সেখানে সন্ত্রাসী এবং মৌলবাদী
গোষ্ঠীগুলোর তৎপরতা বাড়ছে। এটা যদি সত্য হয়ে থাকে তাহলে এর দায় বুয়েট কর্তৃপক্ষ ও
সরকারেরও। আদালতের আদেশ যেমন সংবিধান সমুন্নত রাখা, একইভাবে সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদের
আশ্রয় নেওয়াও মৌলিক অধিকারের মধ্যেই পড়ে। যেখানে বলা হয়েছে, ‘জনশৃঙ্খলা ও নৈতিকতার
স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ সাপেক্ষে সমিতি বা সংগঠন
করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে।’ এ ক্ষেত্রে বুয়েটের উপাচার্য যে
বক্তব্যটি দিয়েছেনÑআদালতের আদেশ শিরোধার্য, সে বিষয়ে কারও ভিন্নমতের সুযোগ নেই।
তবে সংবিধানের উল্লিখিত ৩৮ অনুচ্ছেদের আলোকে যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধের বিষয় নিয়ে
তাদের নিশ্চয়ই বক্তব্য থাকতে পারত।
বুয়েট হোক বা আমাদের জাতীয় রাজনীতি, সব ক্ষেত্রেই রাজনীতি
পরিচালিত হচ্ছে ব্যক্তিবিশেষের সুবিধা-অসুবিধার নিরিখে। এ কথা অস্বীকার করার উপায়
নেই, চলমান ছাত্ররাজনীতির নামে যা চলছে, এ অবস্থায় কেবল বুয়েট নয়, বাংলাদেশের অন্য
বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকেও যদি একই দাবি আসতে থাকে তাহলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
হিযবুত তাহরীরের মতো নিষিদ্ধ সংগঠনগুলোর কর্মকাণ্ড আমাদের জন্য যেমন হুমকির,
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় রাজনৈতিক সহিংসতাও কম হুমকির নয়। এ রাজনীতিতে জড়িত থাকা তথাকথিত
শিক্ষার্থীরা নিজেদের শিক্ষাজীবন যেমন অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলছেন,
একইভাবে লাখো শিক্ষার্থীর জীবনেও নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি করছেন। আজ হয়তো বুয়েটে
ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের পক্ষে ছাত্রদের এ ধরনের আন্দোলনের প্রয়োজন হতো না, যদি
রাজনীতি ইতিবাচক পথে ধাবিত হতো এবং মূলধারার দলগুলো তাদের হীনস্বার্থে ছাত্রদের
ব্যবহার না করত। কাজেই নজর সর্বাগ্রে দিতে হবে উৎসে।
সরকারের সমালোচনায় মাঠে এবং মাঠের বাইরে সবচেয়ে সরব থাকার কথা বিরোধী দলগুলোর। আমরা দেখছি ভারতবিরোধিতার নামে দেশে নতুন করে মৌলবাদী রাজনীতি টেনে আনার চেষ্টা হচ্ছে। ভারতের পণ্য বর্জন বা পোশাক পোড়ানোর নামে সাধারণ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতি নিয়ে খেলার চেষ্টা হচ্ছে। এ অবস্থায় সরকারকে বুয়েটের বিষয়টি কেবল ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থে নয়, বরং জাতীয় স্বার্থের নিরিখে বিবেচনা করতে হবে।