সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়
প্রকাশ : ০৪ এপ্রিল ২০২৪ ১১:২৪ এএম
দেশের অর্থনীতিতে নানামুখী চ্যালেঞ্জ ও কয়েক স্তরে ঝুঁকি সম্পর্কে
অর্থনীতিবিদরা ইতোমধ্যে বেশ কিছু সতর্কবার্তা দিয়েছেন। তাদের এই সতর্কবার্তা যে অমূলক
নয় বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাসও এরই সাক্ষ্যবহ। ‘বাংলাদেশ উন্নয়ন হালনাগাদ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে চার ধরনের চ্যালেঞ্জ রয়েছে বলে তারা বলেছেন। এর পাশাপাশি তারা
তিনটি ঝুঁকির ক্ষেত্রও চিহ্নিত করেছেন। ৩ এপ্রিল প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর শীর্ষ প্রতিবেদনে
বিশ্বব্যাংকের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, জীবনযাপনে ব্যয় বেড়ে যাওয়ার কারণে ক্রয়ক্ষমতা
হ্রাস পাওয়া মানুষের নিত্যপণ্য কেনার সক্ষমতা আরও কমবে। আমরা জানি, দীর্ঘদিন ধরে মূল্যস্ফীতির
অভিঘাতে স্বল্প আয়ের মানুষ তো বটেই এখন এর আরও অনেক ওপরের স্তরের মানুষের স্বাভাবিক
জীবনযাত্রাও কঠিন হয়ে পড়েছে। এ-ও অজানা নয়, বিশ্বব্যাপী সুনির্দিষ্ট কয়েকটি কারণের
প্রেক্ষাপটে বহুমুখী সংকট বিরাজ করছে এবং এর বাইরে আমরাও নই। কিন্তু একই সঙ্গে এ-ও
সত্য, বিভিন্ন দেশ চলমান সংকট কাটিয়ে ওঠার সুনির্দিষ্ট কিছু পথ অবলম্বন করেছে এবং এর
ইতিবাচক প্রভাব সেসব দেশে দৃশ্যমানও হয়েছে। আমাদের দেশেও এই প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে
বটে কিন্তু এর প্রক্রিয়া কিংবা নীতিগত পথ অনুসরণ নিয়ে প্রশ্ন আছে, এই বাস্তবতা অনস্বীকার্য,
অভ্যন্তরীণ বাজারে উচ্চ মূল্যস্ফীতির বিরূপ প্রভাব যতটা প্রতিভাত হচ্ছে তা অনেকাংশেই
বৈশ্বিক সংকটের কারণে নয়; আমাদের বাজার ব্যবস্থাপনার গলদসহ অতি মুনাফাখোর ব্যবসায়ীদের
নিজেদের আখের গোছানোর হীনচেষ্টা বহুলাংশে দায়ী।
২ এপ্রিল ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে বিশ্বব্যাংক ‘বাংলাদেশ উন্নয়ন হালনাগাদ’
শীর্ষক যে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে তাতে তারা বলেছে, ‘কোভিড-১৯ মহামারি থেকে প্রত্যাবর্তনে
বাংলাদেশের অর্থনীতি শক্তিমত্তার পরিচয় দিয়েছে। কিন্তু উচ্চ মূল্যস্ফীতি, লেনদেন ভারসাম্যে
ধারাবাহিক ঘাটতি, আর্থিক খাতের দুর্বলতা ইত্যাদি মহামারি-পরবর্তী পুনরুদ্ধার ব্যাহত
হচ্ছে।’ একই দিন প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর ভিন্ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের
গত সাত মাসে সুদহার বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে দেশের ব্যাংক খাতে আমানত ও ঋণে বিপরীতমুখী
চিত্র দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনের সূত্র ধরে এ-ও বলা হয়েছে, বেশি সুদ
পেয়ে ব্যাংকে টাকা জমা রাখা বাড়িয়েছেন আমানতকারীরা। আবার অধিক সুদে ঋণ নিতে হচ্ছে বিধায়
উদ্যোক্তারা ঋণ গ্রহণ কমিয়েছেন।
এ সম্পাদকীয় স্তম্ভেই আমরা বলেছিলাম, মুদ্রাবাজার নিয়ন্ত্রণে কঠোর
অবস্থান নেওয়ার পাশাপাশি মূল্যস্ফীতির অভিঘাত ঠেকাতে মুদ্রানীতির বাস্তবায়নে জোর দিতে
হবে। অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ কিছ সূচকে আমাদের অবস্থান অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেকটা
ভালো হলেও সাধারণ মানুষ এর সুফল থেকে বঞ্চিত। সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল পক্ষগুলোর অসাধু
ব্যক্তিদের অনিয়ম-দুর্নীতি-অস্বচ্ছতার মাশুল গুনতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। প্রাতিষ্ঠানিক
এবং আত্মকর্মসংস্থানমূলক ক্ষেত্রে কর্মহীনদের সম্পৃক্ততা কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে না পৌঁছার
নেতিবাচক ফলও সঙ্গত কারণেই দৃশ্যমান। আগামী অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার কিছুটা
বেড়ে ৫ দশমিক ৭ শতাংশে উন্নীত হওয়ার আভাসও মিলেছে বিশ্বব্যাংকের তরফে। কিন্তু আমরা
আগেও বলেছি, প্রবৃদ্ধি এবং ব্যবস্থাপনার সুফল যাতে সবাই সমানভাবে ভোগ করতে পারে এর
জন্য সরকারের নীতি বাস্তবায়নকারীদের যথাযথ কার্যক্রম প্রয়োজন।
আর্থিক খাতে বিদ্যমান বিশৃঙ্খলার নিরসনে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে
কাঙ্ক্ষিত সাফল্য দৃশ্যমান করা যায়নি। অর্থনীতিবিদদের ভাষ্য, ক্রমাগত মূল্যস্ফীতির
বাড়ার প্রধান কারণ মুদ্রার বিনিময় হারে অস্থিতিশীলতা। এ কারণেই পণ্যের দাম সাময়িক বেড়ে
গেলেও এরপর স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রেও সফল হওয়া যায়নি। আমরা জানি, আমাদের
অর্থনীতি এবং প্রবৃদ্ধির বড় শক্তি প্রবাসী আয়। বৈধ পথে প্রবাসী আয় যাতে দেশে আসে এজন্য
সরকার নানামুখী পরিকল্পনা নেওয়ার পাশাপাশি প্রণোদনাও দিচ্ছে। কিন্তু এরপরও অবৈধ চ্যানেলে
প্রবাসী আয় আসার পথ রুদ্ধ করা যায়নি। ধারাবাহিক উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে একদিকে ভোক্তার
ক্রয়ক্ষমতা কমছে অন্যদেক ব্যাংকে তারল্য সংকট কাটছে না। পাশাপাশি বাড়ছে খেলাপি ঋণ।
খেলাপি ঋণের ক্রমবর্ধমান চাপে কয়েকটি ব্যাংকের অবস্থা নাজুক পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে। এই
প্রেক্ষাপটে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে সবল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়
এবং এই প্রক্রিয়া ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। আমরা এ-ও বলেছিলাম, আগে ব্যাংকের সমস্যাগুলো
চিহ্নিত করা জরুরি এবং শক্তিশালী নীতিমালার ভিত্তিতে এই প্রক্রিয়া চলা উচিত। দুর্বল
ব্যাংকের চাপে সবল ব্যাংক যাতে নুইয়ে না পড়ে আমরা এ বিষয়েও সতর্ক করেছিলাম। তা ছাড়া
রাজস্ব আয় বাড়ানোর পাশাপাশি কর ফাঁকির পথ রুদ্ধ করাও সমভাবেই গুরুত্বপূর্ণ। প্রবৃদ্ধি
বাড়ানোর কিংবা কমার হেতুগুলো নীতিনির্ধারকদের অজানা নয়। কিন্তু আমরা দেখছি, এসব ক্ষেত্রে
সুমন্বিত ব্যবস্থা কিংবা পদক্ষেপের যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। বিদ্যমান অসঙ্গতিগুলো জিইয়ে
রেখে একই সঙ্গে আর্থিক খাতের জন্য যেসব কারণ বিষফোঁড়া হয়ে আছে এর নিরসনে সরকারের নির্মোহ
ও কঠোর অবস্থানের কোনো বিকল্প নেই। বৈশ্বিক সংকটের বাইরেও আমাদের একান্ত কিছু উপসর্গ
রয়েছে, যেগুলো উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও প্রবৃদ্ধি হ্রাসের কারণ হিসেবে জিইয়ে আছে। আর্থিক
খাত বিশেষ করে ব্যাংক খাতে দুর্বলতা নিঃসন্দেহে আশঙ্কাজনক। প্রবৃদ্ধি বাড়াতে ফের মুদ্রানীতি
সংস্কার এবং একক বিনিময় হার নির্ধারণের পরামর্শ দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। খেলাপি ঋণের আশঙ্কাজনক
পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের তাগিদও দিয়েছে সংস্থাটি।
মূল্যস্ফীতির পেছনে প্রাতিষ্ঠানিক ও নজরদারি-তদারকির ক্ষেত্রে আমাদের
দুর্বলতাগুলো অচিহ্নিত নয়। আমরা জানি, অভ্যন্তরীণ বাজারে অনেক ধরনের ‘খেলোয়াড়’ রয়েছেন
যারা পণ্যমূল্য নির্ধারণ করে থাকেন। সরকার বেশ কিছু পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে দিলেও
ওই খেলোয়াড়দের ইশারায় এক্ষেত্রে অস্থিতিশীলতা জিইয়ে আছে- এ অভিযোগও আছে। পণ্য আমদানির
ক্ষেত্রে আমরা দেখছি, কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের মনোপলি। এর ফলে পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে মুখ্যত
ভূমিকা পালনে করেন তারাই। আমরা এ-ও দেখছি, যেসব পণ্য আমাদের আমদানি করতে হয় না এবং
চাহিদার নিরিখে উৎপাদন ও সরবরাহে ঘাটতি নেই সেসব পণ্যের দামও যৌক্তিক কারণ ছাড়াই বাড়ছে।
কৃষিপণ্যের দাম বাড়লেও প্রকৃতার্থে কৃষকরা এর সুফলভোগী নন। মধ্যস্বত্বভোগী ও সিন্ডিকেটের
অস্তিত্বের বিষয়টি সরকারের দায়িত্বশীলরাও বহুবার স্বীকার করেছেন বটে কিন্তু এদের কারসাজি
বন্ধ করা সম্ভব হয়নি।
বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধিকে শিল্প খাতে ইতিবাচক মানদণ্ড হিসেবে
বিবেচনা করা হলেও এক্ষেত্রেও যথাযথ কর্মপরিকল্পনা এবং বাস্তবায়নপ্রক্রিয়া প্রশ্নমুক্ত
করা যায়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটির ফলে আমাদের সামনে ইতিবাচক ভবিষ্যতের
হাতছানি অদৃশ্য থাকবে তা কোনোভাবেই প্রত্যাশিত নয়। আমরা মনে করি, উচ্চ মূল্যস্ফীতি,
অর্থনৈতিক স্থবিরতা, প্রবৃদ্ধিসহ সংকট ও ঝুঁকির যে পূর্বাভাস বিশ্বব্যাংক দিয়েছে তা
তুড়ি মেরে উড়িয় না দিয়ে গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নেওয়া জরুরি।