× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

ছাত্ররাজনীতি

সংকটের উৎসে নজর পড়ুক, সংস্কারে জোর দিন

মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী

প্রকাশ : ০৪ এপ্রিল ২০২৪ ১১:২২ এএম

সংকটের উৎসে নজর পড়ুক, সংস্কারে জোর দিন

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সব সময়ই দেশের উচ্চশিক্ষাঙ্গনে মানসম্মত শিক্ষা ও গবেষণার তাগিদ দেন। মেধাবী শিক্ষার্থী ও শিক্ষক-গবেষকদের জন্য প্রতি বছর বিরাট অঙ্কের বৃত্তিও প্রদান করেন। তার এ উদ্যোগ প্রশংসনীয় তবে নানা ধরনের বৃত্তি ও গবেষণার প্রাপ্ত সুযোগসুবিধা কতটা বাস্তবে হচ্ছে এ নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের দেশের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা অনেক আগেই যেন যুগোপযোগী শিক্ষা ও গবেষণার পথ হারিয়ে ফেলেছে। প্রায় সব কটি বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা কলেজই এখন নামে মাত্র উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে চলছে, কার্যত কোনো গবেষণা সেখানে হয় না, প্রয়োজনও পড়ে না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যথার্থই উপলব্ধি করেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র গঠন করতে একটি বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষানীতি ছাড়া মোটেও সফল হওয়া যাবে না। সে কারণে তিনি শিক্ষানীতি প্রণয়নের যাবতীয় উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন এবং শিক্ষানীতি প্রণীতও হয়েছিল। কিন্তু সেই শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে হাত দেওয়ার আগেই ১৯৭৫-এর মর্মান্তিক বিয়োগান্ত ঘটনা জাতীয় জীবনে ঘটে যায়। এরপর যারা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছিলেন তাদের কেউই জাতিরাষ্ট্র গঠনে শিক্ষার গুরুত্ব যথার্থভাবে উপলব্ধি করেননি। ফলে দেশে শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষানীতিহীনভাবে গড়ে ওঠার মাধ্যমে যে রূপ ধারণ করেছে তাকে কোনো অর্থেই যুগোপযোগী বলা যাবে না।


বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই দক্ষ, মেধাবী এবং যোগ্য শিক্ষিত মানুষরূপে খুব একটা গড়ে উঠতে পারছে না। বেশিরভাগই শিক্ষাসনদ লাভ করে কিন্তু মানবসম্পদরূপে তেমন কিছু সৃষ্টি করতে পারছে তেমনটি দাবি করতে পারে না। আমাদের উচ্চশিক্ষিত সনদধারীদের বড় অংশই বেকার কিংবা ব্যবসাবাণিজ্য, রাজনীতি অথবা নানা ধরনের কর্মকাণ্ডে যুক্ত; যার জন্য উচ্চশিক্ষার কোনো প্রয়োজন পড়ে না, সনদেরও কোনো উপযোগিতা সৃষ্টি হয় না। কারণ, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের যে উচ্চশিক্ষা তা কেবল নামেই উচ্চ; বাস্তবে দুনিয়ার অনেক দেশের শিক্ষা থেকে বেশ নিচে অবস্থান করছে। দেশে হাজার হাজার কলেজ ও দেড় শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এগুলোয় লাখ লাখ শিক্ষার্থী ভর্তি হচ্ছে। শিক্ষাজীবন শেষে তারা কোথায় কর্মক্ষেত্র পাবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। সে কারণেই তাদের একটি বড় অংশ টাকাপয়সা অর্জনের জন্য যে পথে পা দেয় তা মোটেও উচ্চশিক্ষার সঙ্গে যায় না। অথচ এরা যদি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে মানসম্মত যুগোপযোগী শিক্ষা ও গবেষণার সঙ্গে উন্নত দুনিয়ার শিক্ষার্থীদের মতো যুক্ত থাকতে পারত, তাহলে বেশিরভাগই দক্ষ জনশক্তিরূপে দেশে বা বিদেশে অনায়াসেই কর্মসংস্থান লাভ করতে পারত। আমরা যথার্থ যুগোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে সক্ষম হলে আমাদের জাতীয় জীবনে শিক্ষা-সংস্কৃতি, গবেষণা, দক্ষ মানবসম্পদ, যুক্তিবাদী উদার ধ্যানধারণায় আস্থাশীল মানুষের সংখ্যা অনেক গুণে বেড়ে যেত। আমাদের রাষ্ট্র রাজনীতি ও অর্থনীতি অনেক গুণে বিশ্বমানে উন্নীত হতো। তা হয়নি।

আমাদের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় আসলে এখন পড়াশোনা কতটা হচ্ছে তা খুব তথ্যনির্ভরভাবে দেখার চেষ্টা করা হলে আমার ধারণা, সচেতন মহল মোটেও খুশি হবে না। গবেষণা সম্পর্কে তেমন কিছু বলার নেই। অথচ গণমাধ্যম, জাতীয় রাজনীতিসহ সর্বত্রই বলা হচ্ছেÑশিক্ষাঙ্গনে সুস্থ ধারার ছাত্ররাজনীতি একান্ত প্রয়োজন, তা হলেই কেবল জাতীয় রাজনীতিতে নেতৃত্ব গড়ে উঠতে পারে। এ কথা যুগ যুগ ধরে শুনে আসছি। ছাত্ররাজনীতি থেকেই তো বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা ও কর্মী হিসেবে অনেকে পরিচিত হচ্ছেন, দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। কিন্তু জাতিকে সঠিক পথ প্রদর্শনের মতো নেতৃত্ব গত কয়েক যুগে কি পাওয়া গেছে? কেউ কি এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন? আমরা আসলে দুনিয়ায় উচ্চশিক্ষা কীভাবে চলছে, আমাদের উচ্চশিক্ষার সঙ্গে সেসবের মিল-অমিল কোথায় তা কি বোঝার চেষ্টা করছি? আসলে আমরা এখনও শিক্ষা নিয়ে খুব স্পষ্ট ধারণা রাখার পর্যায়ে কতটা যেতে পেরেছি তা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন রয়েছে। উচ্চশিক্ষার ব্যাপারে তো আমাদের ধারণা একেবারেই গোলমেলে। আমরা ছাত্রজীবন, ছাত্ররাজনীতি, জাতীয় রাজনীতি ইত্যাদি নিয়ে নানা বিভ্রান্তিতে রয়েছি। আমরা মীমাংসিত অনেক বিষয়ে খুব বেশি না জেনেই তর্ক করছি। ছাত্ররাজনীতি নিয়ে যেসব বিতর্ক যুগের পর যুগ চলে আসছে তা অনেকটাই গোটা রাজনীতির বিষয়ে অস্পষ্টতা থেকে জন্ম নিয়েছে।

পাকিস্তান রাষ্ট্রের বাস্তবতা ও চরিত্র বাংলাদেশ রাষ্ট্র থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল। সে কারণে তখন ছাত্ররা শিক্ষা, সংস্কৃতি এবং শেষ পর্যায়ে রাজনৈতিক দলের সহায়ক শক্তি হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। এটি ঐতিহাসিক বাস্তবতা। বাংলাদেশ রাষ্ট্রে সে বাস্তবতার অনেক পরিবর্তন ঘটার কথা। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সংবিধান অনুযায়ী ১৮ বছরের যেকোনো নাগরিক তার পছন্দের দল করার অধিকার অর্জন করে। ১ এপ্রিল হাইকোর্ট বুয়েটের ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধসংক্রান্ত আদেশটিকে অবৈধ বলে রায় দেওয়ার ভিত্তি হচ্ছে সংবিধানেও ওই বিধান। সুতরাং ১৮ বছরের ঊর্ধ্বের যেকোনো নারী-পুরুষের রাজনীতি করতে কোনো বাধা নেই। তবে সেটি ছাত্ররাজনীতির নামে চলতে হবে এমন কোনো বিধিবিধান বা আইন নেই। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোয়ও ছাত্ররাজনীতি বলে কোনো আলাদা ধারণা নেই। কিন্তু তারাও ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই জাতীয় কোনো রাজনৈতিক দলে যোগদান করতে পারে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অনেক বেশি সময় দিতে হয় পড়াশোনা, গবেষণায়। এমনকি আমাদের প্রতিবেশী ভারতেও একসময় ছাত্র সংগঠনের দাপট ছিল। এখন সেসবের নামধাম খুব বেশি শোনা যায় না।

ছাত্র-শিক্ষকরা রাজনীতি করা না করার বিষয়টি একান্তই ব্যক্তিপর্যায়ে সীমাবদ্ধ রাখেন। ভারতে শিক্ষার্থীরা জাতীয় রাজনীতিতে যখন বড় ধরনের কোনো সংকট ঘনীভূত হওয়ার আশঙ্কা দেখে তখনই কেবল প্রতিবাদে ঝাঁপিয়ে পড়ে। একসময় আবার শিক্ষাঙ্গনে যথানিয়মে তারা ফিরেও যায়। ছাত্র সংগঠনের পরিচয়ে যা কিছু ঘটে তা কেবলই শিক্ষা-সংস্কৃতি, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানা বিষয়ে সেমিনার, সিম্পোজিয়াম এবং মুক্ত আলোচনার আয়োজন থাকে। এর বাইরে তেমন কোনো সময় ব্যয় করার সুযোগ শিক্ষার্থীদের উন্নত দুনিয়ায়ও নেই এমনকি ভারতেও নেই। আমাদের অবস্থা এ ক্ষেত্রে খুবই নাজুক। সত্তরের দশকে উগ্র হঠকারী ছাত্ররাজনীতি বেশ বিস্তার করেছিল। সামরিক শাসনকালেও নতুন ছাত্র সংগঠনের জন্ম দেওয়া হয় সুযোগসুবিধা ও উপঢৌকন প্রদানের মাধ্যমে। হঠকারী অনেক ছাত্র রাজনৈতিক দলের সঙ্গে মিশে যায়। এর ফাঁকে স্বাধীনতাবিরোধী ছাত্র সংগঠন গুছিয়ে উঠতে থাকে। প্রগতিশীলদের বিরুদ্ধেই তাদের তখন আক্রমণের শ্যেনদৃষ্টি ছিল। আশির দশকে ক্ষমতার ওলটপালট ঘটে। সে সময় প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত হয়। ছাত্রশিবির গোটা শিক্ষাব্যবস্থায় নিজেদের দখলদারি প্রতিষ্ঠা করে। বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের সঙ্গে প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনের প্রত্যক্ষ বিরোধে অনেক রক্তপাত হয়, প্রাণহানি ঘটে।

নব্বইয়ের দশকে ছাত্র আন্দোলনে প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনের ভূমিকা ছিল শীর্ষে। ১৯৯১-এর নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর ছাত্রনেতাদের কেউ কেউ রাতারাতি এমপি, মন্ত্রী ও সম্পদের মালিকানাপুষ্ট হওয়ার দৃশ্য স্পষ্ট হতে থাকে। ছাত্ররাজনীতি নগদনারায়ণের অপূর্ব সুযোগ রাজনীতিতে দেখতে পায়।

২০০৯ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে শেখ হাসিনার সরকার গঠিত হওয়ার পর ছাত্রলীগ, যুদ্ধাপরাধের বিচার এবং শাহবাগের আন্দোলন অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত ছিল। তার পরও কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজে বেপরোয়া ছাত্রনেতাদের কারণে সরকারকে সমালোচনার মধ্যে পড়তে হয়। শেখ হাসিনা একসময় ছাত্রলীগের অভিভাবকত্ব ত্যাগ করেন। পরে ছাত্রলীগকে নানা ধরনের সামাজিক কাজকর্মে যুক্ত থাকার নির্দেশ প্রদান করেন। অনেকে তা করলেও তত দিনে অনেক পেশিশক্তি, ক্ষমতালোভী বা ভিন্ন আদর্শের ছাত্ররা ছাত্রলীগের পদপদবি বাগিয়ে নেয়। বুয়েটে ২০১৯ সালে আবরার হত্যার সঙ্গে যারা যুক্ত ছিলেন তারা মূলত ক্ষমতার দাপটে নিজেদেরও নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি। অথচ মেধাবী ছাত্রদের তো এমনটি হওয়ার কথা ছিল না। শেখ হাসিনা সময়মতো সঠিক সিদ্ধান্তটি দেওয়ায় ওই হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচার হয়েছে। কিন্তু জাহাঙ্গীরনগর, চট্টগ্রাম, রাজশাহীসহ অনেক বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে ছাত্রলীগের নাম ভাঙিয়ে যা করা হয় তা দলের ভাবমূর্তি ভূলুণ্ঠিত করা ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না।

অনেকে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করার কথা বলেন। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়া ও ছাত্ররাজনীতির বেহাল অবস্থা দেখেই এমন দাবি করেন আবার অনেকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে করেন। ছাত্ররাজনীতির নামে যে অপরাজনীতি সংগঠনগুলো শিক্ষাঙ্গনে করে সেগুলো বিবেচনায় নিয়ে অপরাজনীতি, দখলদারি, ব্যক্তিগত শক্তি প্রদর্শন, সুবিধা আদায়ের মতো বিষয়গুলো অকার্যকর করতে হবে, আইনের যথাযথ প্রয়োগ ঘটাতে হবে। ছাত্রলীগকে সহশিক্ষাক্রমে যুক্ত থাকার মাধ্যমে রাজনীতির পাঠশালায় পরিণত করার কার্যক্রম কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দকে উদ্ভাবন করতেই হবে। ছাত্ররাজনীতির আমূল সংস্কারে উদ্যোগ নেওয়া হলে দল হিসেবে আওয়ামী লীগের অনেক অর্জনই মানুষের কাছে বিসর্জন হিসেবে ধরা দিতে পারে। আওয়ামী লীগ প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ ব্যাপারে যে যথেষ্ট সজাগ এর সাক্ষ্য মেলে। কিন্তু ছাত্র রাজনীতিকে বিপথে পরিচালিত করতে স্বার্থন্বেষী মহল সক্রিয় তাদের স্বার্থে, মূল সমস্যা হলো সেখানেই। এর নিরসন জরুরি। 

  • ইতিহাসবিদ ও শিক্ষাবিদ। সমাজ ও রাজনীতি বিশ্লেষক
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা