ফিরে দেখা
ডা. লিপি বিশ্বাস
প্রকাশ : ০৪ এপ্রিল ২০২৪ ১১:১৪ এএম
ডা. লিপি বিশ্বাস
স্মৃতিকাতরতা
সংবেদনশীল মানুষকে জাগায়-ভাবায়-অন্তহীন স্মৃতির অন্তর্জগতেও নিয়ে যায়। আজকের লেখাটি সেই আঙ্গিক-প্রেক্ষাপট কিংবা স্মৃতি
রোমন্থন এবং পর্যবেক্ষণ থেকেই। মুক্তিযোদ্ধারা জাতির শ্রেষ্ঠ এবং বীরসন্তান, আমাদের
নমস্য। তাদের জীবনালেখ্য আমাদের সামনে ফিরে ফিরে উন্মোচিত হয় এবং হবেও। একাত্তর পর্বের
মহান মুক্তিযুদ্ধ যেমন আমাদের জাতীয় জীবনের অক্ষয় অধ্যায়, তেমন বীর মুক্তিযোদ্ধারাও
আমাদের গর্বের ধন।
১৯৭১ সালের মাঝামাঝি। চারদিকে বাজছে যুদ্ধের দামামা।
দখলদার বাহিনী প্রায় পুরো বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে, নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালির
ওপর চলছে নির্বিচার গণহত্যা, পাশবিক নির্যাতন। স্বল্প জনবল, অপর্যাপ্ত সমরাস্ত্র নিয়ে
মুক্তিবাহিনী ঠিক পেরে উঠছে না আধুনিক রণকৌশলে সজ্জিত পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে। সে
সময় শেরপুরে জন্ম নেওয়া ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পঞ্চম বর্ষের এক তরুণ দেশমাতৃকার
মুক্তির জন্য সম্মুখসমরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। অদম্য মেধাবী এবং অকুতোভয় এ তরুণের
নাম নূরনবী মোহাম্মদ নাজমুল আহসান। প্রায় এক মাস ভারতে গেরিলা প্রশিক্ষণ শেষে তিনি
ফিরে এলেন রণাঙ্গনে। অসম সাহসী এ মুক্তিযোদ্ধার নেতৃত্বে থাকা বাহিনীর নামই হয়ে গেল
‘নাজমুল কোম্পানি’। যে সময়ের কথা বলছি তখন পাকিস্তানি বাহিনীর একটা স্ট্র্যাটেজি ছিল
সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোয় নজরদারি জোরদার রাখা, যাতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের
গতিবিধি বাধাগ্রস্ত করা যায়। বিভিন্ন জায়গায় তাদের হেডকোয়ার্টার বসানো হলো, সঙ্গে সংযোগ
রক্ষাকারী ছোট ছোট ক্যাম্প।
কৌশলগত কারণে
শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার কাটাখালী সেতু এবং তিনআনি ফেরি ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর
জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ রক্ষাকারী পয়েন্ট। এ পথেই শেরপুর-ময়মনসিংহ-হালুয়াঘাটসহ
পাশের সব জায়গায় খাদ্য ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আনা-নেওয়া চলত। বেশ কিছুদিন মুক্তিযোদ্ধাদেরও
লক্ষ্যবস্তু ছিল এ দুটি পয়েন্ট। আগে ছোটখাটো দুয়েকটি অভিযান চালালেও সফলতা আসেনি সেভাবে।
এবার দায়িত্ব পড়ল অকুতোভয় নাজমুল এবং তার সহযোদ্ধাদের ওপর। জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে
নাজমুল এগিয়ে গেলেন সঙ্গীদের সঙ্গে অভিযান সফল করার উদ্দেশ্যে। দুটি দলে ভাগ হয়ে পরিকল্পনামতো
পৌঁছে গেলেন কাটাখালী সেতু এবং তিনআনি ফেরির কাছাকাছি। প্রবল বর্ষণের মধ্যে মোটামুটি
কোনো প্রতিরোধ ছাড়াই তারা তাদের অভিযান সফলভাবে সম্পন্ন করতে পারলেন। উড়িয়ে দিলেন কাটাখালী
সেতু ও তিনআনি ফেরি।
একটি সফল অভিযান
শেষ করে দিনের আলোয় অবস্থান পরিবর্তন নিরাপদ হবে না ভেবে তারা আশ্রয় নিলেন পাশের রাঙামাটি
গ্রামের জনৈক কৃষকের বাড়িতে। প্রচণ্ড ক্লান্তিতে মুক্তিযোদ্ধা দলটির প্রায় সবাই গভীর
ঘুমে তলিয়ে গেলেন। এর মধ্যেই ঘটল বিপর্যয়। দেশের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতাকারী এক রাজাকার
স্থানীয় হানাদার ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের বিষয়টি জানিয়ে দেয়। প্রবল হিংস্রতায়
পাকিস্তানি বাহিনী সমরাস্ত্রে সজ্জিত হয়ে তিন দিক থেকে মুক্তিবাহিনীকে ঘিরে ফেলে। নাজমুল
দেখলেন সহযোদ্ধাদের জীবন রক্ষার্থে এ মুহূর্তে পশ্চাৎপদ হওয়া ছাড়া গতি নেই। কিন্তু
সে ক্ষেত্রেও সব রাস্তা অবরুদ্ধ। শুধু গ্রামের পেছনে যে রাঙামাটি বিলটি আছে ওই পথটুকুই
খোলা।ভরা বর্ষায় সেই বিলও তখন টইটম্বুর। নাজমুল নিজে অস্ত্রহাতে কভার করতে করতে সঙ্গীদের
বিল সাঁতরে ওপারে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। অবিশ্রাম গুলিবর্ষণ চলতে থাকল বিপক্ষ দল
থেকে। একসময় শত্রুর গুলিতে ঝাঁজরা হয়ে গেল অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধা নাজমুলের বুক। তিনি
লুটিয়ে পড়লেন প্রিয় মাতৃভূমির বুকে, যাকে স্বাধীন করার স্বপ্ন দেখে হাতে তুলে নিয়েছিলেন
অস্ত্র। তার রক্তাক্ত দেহ নিতে এসে শহীদ হন তারই পরিবারের আরও দুজন। সেদিন অদম্য সাহসী
সেই যোদ্ধাদের রক্তে লাল হয়েছিল রাঙামাটি বিলের পানি। এখানেই শেষ নয়। মুক্তিযোদ্ধাদের
আশ্রয় দেওয়ার অপরাধে রাঙামাটি গ্রামের নিরীহ মানুষের ওপর তাণ্ডব চালায় দখলদার বাহিনী।
পুড়িয়ে দেয় গ্রামের ঘরবাড়ি, মেয়েদের ওপর চালায় পাশবিক নির্যাতন, গ্রামবাসীকে ধরে এনে
লাইনে দাঁড় করিয়ে নিষ্ঠুরভাবে ব্রাশফায়ার করে। সেখানেও শহীদ হন আরও জনাদশেক মানুষ।
শেরপুরের মানুষের
জন্য একটি অসম্ভব বেদনাময় দিন রচিত হয় মহাকালের বুকে। নাজমুলের মতো এ রকম অসংখ্য তরুণ
জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন অকাতরে দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য। দেশ স্বাধীন হয়েছে তাদের রক্তে
রঞ্জিত আত্মত্যাগের বিনিময়ে। স্বাধীনতার পর আত্মবলিদানের স্বীকৃতিস্বরূপ শহীদ নাজমুল
আহসানকে ভূষিত করা হয় ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’-এ। কাটাখালী সেতুটি সংস্কার করে সেখানে
তার সংক্ষিপ্ত জীবনীসহ একটি প্রতিকৃতি স্থাপন করা হয়। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের
একটি হলের নামকরণ হয় শহীদ নাজমুলের নামে। নালিতাবাড়ী উপজেলায় স্থাপিত হয় শহীদ নাজমুল
স্মৃতি কলেজ। তবে এসব নামকরণের বাইরেও তাদের প্রকৃত অবস্থান লাখো বাঙালির হৃদয়ে। একটি
পতাকা, একটি জাতীয় সংগীত, একটি স্বাধীন ভূখণ্ড, একটি মানচিত্র এসেছে এমন লাখ লাখ নাজমুলের
বুকের রক্তে। আজ স্বাধীন দেশে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করি, তখন যেন একবার হৃদয় থেকে কৃতজ্ঞচিত্তে
স্মরণ করি এসব অকুতোভয় বীরসেনানীকে। যার যার জায়গা থেকে অন্তত নিজের কাজটুকু যেন করে
যাই নিষ্ঠার সঙ্গে। তারা যেমন দেশের মুক্তির স্বপ্ন দেখেছিলেন, আমরা যেন সেই মুক্ত
দেশের সমৃদ্ধির স্বপ্নটুকু হৃদয়ে লালন করি প্রবলভাবে। তবেই সার্থক হবে শহীদ নাজমুল
আহসানসহ সব মুক্তিসেনানীর আত্মত্যাগ।
তাদের ভূমিকা ও আত্মত্যাগের বর্ণনা বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে কবি-সাহিত্যিকদের রচনায় নানাভাবে উঠে এসেছে। দেশের জন্য আত্মদানকারী সব বীরই আমাদের প্রণম্য। দেশপ্রেমিক বীরদের স্মরণেই সেই কবে রচিত হয়Ñ‘...যাঁরা স্বর্গগত তাঁরা এখনও জানে / স্বর্গের চেয়ে প্রিয় জন্মভূমি, / এসো স্বদেশ ব্রতের মহা দীক্ষা লভি / সেই মৃত্যুঞ্জয়ীদের চরণ চুমি।/ যাঁরা জীর্ণ জাতির বুকে জাগালো আশা / মৌন মলিন মুখে যোগালো ভাষা, / আজি রক্ত কমলে গাঁথা মাল্যখানি / বিজয় লক্ষ্মী দেবে তাঁদেরই গলে।/ মুক্তির মন্দির সোপানতলে / কত প্রাণ হল বলিদান, /লেখা আছে অশ্রুজলে।’