× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

সম্পাদকীয়

বনভূমি দখলকারীদের তালিকা লোপাট করল কারা

সম্পাদকীয়

প্রকাশ : ০২ এপ্রিল ২০২৪ ১০:০৭ এএম

বনভূমি দখলকারীদের তালিকা লোপাট করল কারা

রবীন্দ্রনাথ তার ‘বন’ কবিতায় লিখেছেন, ‘শ্যামল সুন্দর সৌম্য, হে অরণ্যভূমি,/মানবের পুরাতন বাসগৃহ তুমি।/নিশ্চল নির্জীব নহ সৌধের মতন/তুমি দাও ছায়াখানি, দাও ফুল ফল,/দাও বস্ত্র, দাও শয্যা, দাও স্বাধীনতা;/ নিশিদিন মর্মরিয়া কহ কত কথা/অজানা ভাষার মন্ত্র; বিচিত্র সংগীতে/গাও জাগরণগাথা; গভীর নিশীথে/পাতি দাও নিস্তব্ধতা অঞ্চলের মতো/জননীবক্ষের; বিচিত্র হিল্লোলে কত/খেলা কর শিশুসনে; বৃদ্ধের সহিত/কহ সনাতন বাণী বচন-অতীত।’ কবির এই পঙক্তিগুলোর গর্ভে যা নিহিত রয়েছে তা শুধু মানব জীবনেই প্রতিভাত নয়, বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিঘাতে ঝুঁকির মুখে থাকা আমাদের প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার পাশাপাশি ভূমণ্ডলের সার্বিক সুরক্ষা অস্তিত্বের প্রয়োজনেও গুরুত্বপূর্ণ। অথচ কতিপয় মানুষ নামধারী বনখেকোর লোভের থাবায়, উদর ভরে না আরও চাই- গ্রাসের আগ্রাসনে বন-বৃক্ষ সবই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে প্রতিকারহীনতার অপসংস্কৃতির ছায়ায়; যা মানুষের সর্বনাশ ডেকে আনছে। যে বা যারা মানুষের জীবনযাপনের পথে কঠিন প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে কিংবা করছে তারা পারও পেয়ে যায়। এরই জ্বলন্ত প্রমাণ ১ এপ্রিল প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ প্রকাশিত প্রতিবেদনটি।

‘বনভূমি দখলকারীদের সেই তালিকা হারাল কোথায়’ শিরোনামে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বনভূমি দখলকারীদের একটি তালিকা প্রস্তুত করেছিল সরকার। এটি ছিল প্রায় ৫ হাজার পৃষ্ঠার। সেই বিশাল নথিতে সবিস্তারে উল্লেখ ছিল দখলকারীদের নামধাম সবকিছুই। বিগত সরকারের শেষ সময়ে তা প্রকাশের জন্য চূড়ান্তও করা হয়েছিল। এ-ও কথা ছিল, ওয়েবসাইটে তালিকাটি প্রকাশ করা হবে। কিন্তু আজ অবধি সেই ‘হবে’র জটাজাল কোনো অদৃশ্য কারণে ছিন্ন হয়নি তা আমরা জানি না। এখানেই শেষ নয়। তালিকা প্রকাশ না হলেও বন বিভাগ থেকে এক সপ্তাহের মধ্যে সব স্থাপনা সরিয়ে নেওয়ার জন্য দখলকারীদের কাছে চিঠি পাঠানোর পাশাপাশি আরও জানানো হয়েছিল, নির্দেশনা না মানলে বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসকদের সমন্বয়ে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হবে। কিন্তু সেই নির্দেশনাও কাগজপত্রেই থেকে গেল, কার্যকর কিছুই দৃশ্যমান হলো না। ওই প্রতিবেদনেই বলা হয়েছে, প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজার ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের গ্রাসে দেশের ২ লাখ ৫৭ হাজার একর বনভূমি দখল হয়ে গেছে! এর মধ্যে প্রায় ১ লাখ ৩৮ হাজার একর সংরক্ষিত বন, যা রয়েছে ৮৮ হাজার ২২৫ জন ব্যক্তি ও সংস্থার দখলে। সবচেয়ে বেশি বনভূমি দখল হয়েছে কক্সবাজার জেলায়।

কী বার্তা দিল এই তথ্য? বনভূমি বেদখল হয়ে যাওয়ার অর্থ শুধু এই নয়, রাষ্ট্রের সম্পত্তি ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানগুলোর দখলে চলে যাচ্ছে। যেভাবে দেশের বনভূমি উজাড় হয়ে যাচ্ছে, তাতে পরিবেশের ওপর চরম বিরূপ প্রভাব পড়ছে এবং এই অপূরণীয় ক্ষতি সর্বনাশের আশঙ্কাই ক্রমাগত বাড়াচ্ছে। আমরা জানি, জাতিসংঘের বেঁধে দেওয়া লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী প্রতিটি রাষ্ট্রে মোট আয়তনের ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকতে হবে। কিন্তু আমাদের দেশে বনভূমি উজাড় হতে হতে এখন নির্ধারিত ওই শতাংশ হারের অনেক নিচে নেমে এসেছে। বেসরকারিভাবে ধারণা করা হয়, দেশে এখন প্রকৃত বনভূমির পরিমাণ ১৫ শতাংশেরও কম। বনভূমি জবরদখল ও উজারের প্রক্রিয়া কিভাবে চলছে নিরন্তর বছরের পর বছর? ফরেস্ট ওয়াচ নামের এক আন্তর্জাতিক সংস্থার দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, ২০০১ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রায় ৩ লাখ ৭৮ হাজার একর বনভূমি উজাড় হয়েছে। আরও উদ্বেগের বিষয় হলো, বনভূমি উজাড় করার প্রবণতা কয়েক বছর ধরে ভীষণভাবে বেড়েছে।

ভূমিদস্যুদের সঙ্গে বন বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশের অভিযোগ পুরোনো। আরও অভিযোগ আছে, একশ্রেণির দালালের মাধ্যমে বনভূমি দখল করা হয় এবং দালালরা অসাধু বন কর্মকর্তাদের সঙ্গে আর্থিক লেনদেনের সুযোগ করে দিয়ে দখলে সহায়তা করে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণ এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের অভিঘাত মোকাবিলায় বনভূমির অপরিহার্যতা নতুন করে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ নিষ্প্রয়োজন। জীববৈচিত্র্য সুরক্ষার ক্ষেত্রেও বনভূমির অপরিহার্যতা এককথায় ব্যাখ্যাহীন। সার্বিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে জীবন ও প্রকৃতির গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ বনভূমি লোপাটকারীদের স্পর্ধা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না এবং একই সঙ্গে এই দাবিও জরুরি হয়ে ওঠে, তারা আইনের হাতের অস্পৃর্শিত থাকে কী করে? আমরা বিস্মিত না হয়ে পারি না বনভূমি দখলকারীদের তালিকা হারিয়ে যাওয়ার খবরে। আমরা স্পষ্টতই মনে করি, তালিকা হারিয়ে যায়নি বরং স্বার্থান্বেষীদের ইঙ্গিতে-ইশারায় কিংবা লাভের হিসাবে তা লোপাট হয়ে গেছে। সর্বাগ্রে এই তালিকা উদ্ধারের দাবি আমরা জানাই এবং তা ‘নাই’ হয়ে যাওয়ার উৎস-কারণ অনুসন্ধানে এর সঙ্গে যাদের যোগসাজশ রয়েছে তাদের দৃষ্টান্তযোগ্য প্রতিবিধানের দাবিও জানাই।

আমাদের স্মরণে আছে, বিগত জাতীয় সংসদে এ-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে তালিকা অনুযায়ী দখল করা বনভূমি উদ্ধারের পাশাপাশি দখলকারীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার প্রসঙ্গ গুরুত্ব সহকারে আলোচনায় এসেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা-ও আর এগোয়নি। ২০২১ সালে গ্লাসগোতে জলবায়ু সম্মেলনে বিভিন্ন দেশের সরকারের প্রতিনিধিরা অঙ্গীকার করেছিলেন, ২০৩০ সালের মধ্যে বনভূমি উজাড় কিংবা দখল বন্ধে তারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। প্রতিশ্রুত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশও ছিল। তৎকালীন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রী সম্মেলন থেকে ফিরে সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, ‘জলবায়ু সম্মেলনে এই প্রথম কোনো বড় অর্জন হলো বনভূমি উজাড় বা দখল বন্ধে প্রতিশ্রুতি জ্ঞাপনের মধ্য দিয়ে।’ দুই বছর পর আমরা প্রশ্ন রাখতে চাই, ওই প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়নে আমাদের সরকার কতটা কী করতে পেরেছে? আমরা দেখছি, সরকারি বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্যও সংরক্ষিত বনাঞ্চল ধ্বংস হচ্ছে এবং স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয়, এমনটি ওই অঙ্গীকার থেকে সরকারের পিছিয়ে আসার একটি নজির।

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি বাংলাদেশ- এমন মোহনীয় বর্ণনার সঙ্গে শুধু দেশের মানুষই নয়, অন্য আরও অনেক দেশের মানুষও পরিচিত। কিন্তু সেই পরিচিতি ক্ষয়ে যাচ্ছে বনখেকো-ভূমিদস্যুদের দখলদস্যুতায় এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরকারের অপরিণামদর্শী কর্মকাণ্ডেও। আমরা মনে করি, সময় এখনও একেবারে ফুরিয়ে যায়নি। বনভূমি তদারকির ব্যবস্থা জোরদার করতেই হবে। দখল বনভূমি উদ্ধারের পাশাপাশি দখলদারদের দৃষ্টান্তযোগ্য বিচারও দ্রুত নিশ্চিত করতে হবে। সরকারের দায়িত্বশীলদেরও অবশ্যই অধিকতর সজাগ-সতর্ক থাকতে হবে, যাতে সরকারের কোনো ভুল পরিকল্পনায় বনভূমির আর ক্ষতি না হয়। এ ব্যাপারে যেমন জরুরি রাজনৈতিক অঙ্গীকার। তেমনি জরুরি সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সব পক্ষের যথাযথভাবে দায়িত্ব পালনে ঐকান্তিকতা কিংবা নিষ্ঠা।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা