× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

রাষ্ট্র ও সমাজ

শুধু লক্ষণকে কাবু করলেই রোগমুক্তি ঘটবে না

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

প্রকাশ : ০২ এপ্রিল ২০২৪ ১০:০১ এএম

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

নিজেদের দেশের দিকে তাকালে দেখা যায় কতভাবেই প্রাণহানির তো শেষ নেই। এক দিনেই সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে ৮, ১৫, ২০ জন এমন মর্মস্পর্শী খবর তো নিত্যনৈমত্তিক খোরাক সংবাদমাধ্যমের। জীবিকার খোঁজে ইতালি গেছেন শাহ আলম। মায়ের অসুখের খবর পেয়ে তড়িঘড়ি রওনা হয়েছেন মাকে দেখবেন বলে। বিমানবন্দরে পৌঁছে খবর পেলেন মা আর নেই। আশা করলেন মৃত মাকে শেষ দেখা দেখবেন। কোনোমতে ঢাকায় এসে পৌঁছালেনও ঠিকই, কিন্তু নিজেই প্রাণ হারালেন ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক। গাড়িচাপা পড়ে। তার সঙ্গে ছিলেন সেলিম মিয়া, শাহ আলমের ছোট বোনের স্বামী, মারা গেলেন তিনিও, একসঙ্গে।

ধর্ষণ কমবে এটা আশা করব কোন সাহসে? কমেনি, বেড়েছে। কিশোরগঞ্জে যাবে বলে সন্ধ্যায় ঢাকা রেলস্টেশন থেকে ট্রেনে উঠেছে এক কিশোরী। সেটা ছিল ভুল ট্রেন। রাতের বেলা একা পেয়ে মেয়েটিকে ধর্ষণ করে দুর্বৃত্তরা। অন্য কেউ নয়, কাজটি করেছেন ট্রেনের অ্যাটেনডেন্ট, যার দায়িত্ব ছিল মেয়েটিকে নিরাপত্তা দেওয়া। লোকটি তো ওই কাজের জন্যই বেতনভাতা পান। কিন্তু কাজ করেছেন ঠিক উল্টোটা। এটি অবশ্য বিচ্ছিন্ন কোনো ব্যাপার নয়, বরং সাধারণ ও স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। সুযোগ পেলেই ক্ষমতার সদ্ব্যবহার করো, এটাই যেন হচ্ছে আদর্শ। জবাবদিহির দায় কোথাও নেই। সর্বোচ্চ যে পর্যায়Ñরাষ্ট্রীয় পর্যায়Ñসেখানেই নেই; ওই স্থানটিই তো নাগরিকের জন্য আদর্শবাদের মূল শিক্ষক ও রক্ষক। সেখানেও আশা হোঁচট খাচ্ছে, তাই অন্যত্র আশা করি কি করে!


রেলের ছোট মাপের ওই কর্মচারীটিও হয়তো ভেবেছেন ধরা পড়বেন না। পড়লেও পার পেয়ে যাবেন, অনেকেই যেমনটা পেয়ে থাকে। সবচেয়ে বড় ঘটনা হলো, ভবিষ্যতে কী হবে মানুষ এখন তা নিয়ে ‘দুশ্চিন্তা’ করে না; হাতের কাছে যা পাও নিয়ে নাও, বাকির খাতায় শূন্য থাকÑএ আদিম ন্যায়নীতি এখন বিশ্বজুড়েই বিদ্যমান। এ কাজ ডোনাল্ড ট্রাম্প করেন, বিল ক্লিনটনও করতে ছাড়েননি, যদিও দুজনের মধ্যে বিস্তর ফারাক বলে জানি। তবে তারা দুজনই যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ছিলেন এ তো অসত্য নয়। একটা সময় ছিল যখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীদের জন্য অযোগ্য হওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ হতো যৌন হয়রানির অভিযোগ। এখন সেসব গেছে। যৌন অসদাচরণের ওই ধরনের অভিযোগ তো এখন তুচ্ছ ব্যাপার। মোটেই বীরত্বনাশক নয়, বরং গোপনে বীরত্বব্যঞ্জক। এ আদর্শবাদের মোহ থেকে বাংলাদেশের একজন সামান্য ট্রেন অ্যাটেনডেন্টও মুক্ত হতে পারছেন না; জাল এতই সুবিস্তৃত এবং আকর্ষণ এতটাই দুর্বার।

বাংলাদেশ যে ‘স্মার্ট’ হয়ে উঠছে তার প্রমাণ বিরল নয়; অপরাধের ক্ষেত্রে তো খুবই সহজলভ্য। যেমন এ ঘটনাটি। দৃষ্টান্ত আরও আছে, অনেক আছে। খুলনার এক উপজেলা অঞ্চলে দুর্বৃত্তরা রাতদুপুরে একটি ঘরে প্রবেশ করে মই বেয়ে ওপরে উঠে এবং পরে ঘরে ঢোকে দরজা ভেঙে। ভেতরে যে একজন গৃহবধূ একলা আছেন তা তারা জানত। ঘরে ঢুকে তারা ঘুমন্ত মহিলার চোখের পাতা ও দুই ঠোঁটে সুপার গ্লু লেপটে দেয়; তিনি যাতে লোকগুলোকে চিনতে না পারেন এবং চিৎকার যে করবেন তা-ও যাতে সম্ভব না হয়। সংঘবদ্ধভাবে তারা মহিলাকে নির্যাতিত করেছে; তার গায়ের গয়নাপাতি খুলে নিয়েছে এবং টাকাপয়সা যা ছিল তা-ও নিতে ভোলেনি। পোশাক কর্মীকে দলবদ্ধ ধর্ষণ? সেটা তো এখন আর কোনো খবরই নয়। তবু খবরের কাগজে ওসব খবর না পড়ে উপায় থাকে না।

অপরাধী গ্রেপ্তার হয়েছে বলেও শোনা যায়। তারপর? লেফ্ট রাইটের পরে, অ্যাজ ইউ ওয়ার। যেমন ছিল তেমন থাকো। কিন্তু তেমন থাকারও কি নিশ্চয়তা আছে? নোয়াখালীর সুবর্ণচরের মানুষ সন্ত্রাসীদের কাছে অসহায়, এমন অভিযোগ স্থানীয়রাই করেছে, একবার নয়; বহুবার। আগের এক নির্বাচনের রাতে গণধর্ষণের বহুল-আলোচিত মামলায় উপজেলা আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত সম্পাদকসহ ১২ অভিযুক্তের ফাঁসির আদেশ হয়। আদালত এ আদেশ দেওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই রাতের বেলা সিঁধ কেটে ঘরে ঢুকে মা ও তার স্কুলপড়ুয়া মেয়েকে ধর্ষণ করে একদল সন্ত্রাসী। অভিযোগ উঠেছে, ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক উপজেলা পরিষদের সদস্যের বিরুদ্ধে; সেই ব্যক্তি গ্রেপ্তার হয়েছেন, পুলিশ বলছে অন্যদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে। তা গ্রেপ্তার তো হলো কিন্তু তার পরে? ঘটনাটি দূর অতীতের নয়।

শিক্ষাঙ্গন হওয়ার কথা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব শিক্ষার্থীর জন্য সবচেয়ে নিরাপদ স্থান। শিক্ষকের হাতে শিক্ষার্থী প্রহৃত হয়েছে এমন ঘটনার খবর আমরা পেতাম। কিন্তু সেখানে মেয়েরা ধর্ষিত হবে এ ছিল অকল্পনীয়। উন্নয়নের প্লাবনকালে সে ঘটনা ঘটছে এবং তার সংখ্যা ‘প্রগতিশীল’ হারে বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ছাত্রীসংখ্যা ছাত্রসংখ্যার কাছাকাছি চলে এসেছে, এমন সুখবর সংবাদপত্রে পড়েছি। কিন্তু নিরাপত্তা? একটি সংবাদপত্র প্রথম পৃষ্ঠায় শিরোনাম দিয়ে খবর ছেপেছেÑ‘চবি-জাবি-ঢাবি উত্তপ্ত’। চট্টগ্রাম, জাহাঙ্গীরনগর ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে পার্থক্য থাকবার কথা, আছেও; কিন্তু অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয় কেন্দ্র করে ‘তপ্ত’ হওয়ার ব্যাপারে দেখা যাচ্ছে তারা একই স্তরে এসে দাঁড়িয়েছে। না, তারা রাজনৈতিক ব্যাপারে তপ্ত হয়নি, রাষ্ট্রীয় কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়নি, যেমনটি ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি শাসনের ঔপনিবেশিক দিনগুলোয় শুধু তপ্ত নয়, সময় সময় উত্তপ্ত পর্যন্ত হয়ে উঠত। সেই অধ্যায় তো অতীত।

বাংলাদেশ আমলের প্রথম দিকেও সেটা বিরল ছিল না। তিনটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এখন কোনো রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে নয়, প্রতিবাদ করছে নিজেদের সহপাঠী এমনকি শিক্ষকের যৌন অসদাচরণের বিরুদ্ধে। ভাবা যায়? কিন্তু অভাবনীয় ওই উন্নতির শিখরভূমির দিকেই তো দেখছি আমাদের অগ্রযাত্রা। কেবল বিশ্ববিদ্যালয় নয়, স্কুলও অভাবনীয় উন্নতির স্পর্শ লাভ থেকে বঞ্চিত হয়নি। চট্টগ্রাম থেকে খবর এসেছে কর্মরত মায়েদের শিশু সন্তানদের যত্ন নেওয়ার জন্য যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কাজ করে তারই এক শিক্ষক পীড়ন করেছেন একটি শিশুকে। একবার নয়, উপর্যুপরি। ঢাকার মেয়েদের জন্য সবচেয়ে খ্যাতিমান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভিকারুননিসা স্কুল, তার এখন একাধিক শাখা; একটি শাখার অভিভাবকরা আন্দোলনে নামতে বাধ্য হন একজন শিক্ষকের ‘লাম্পট্যে’র বিরুদ্ধে। ঘটনা কতটা দুঃসহ হলে অভিভাবকদের এভাবে মাঠে নামতে হয় তা কল্পনা করা সহজ নয়। প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সব স্তরের শিক্ষকরা যখন ক্ষমতার নিকৃষ্টতম অপব্যবহারের অভিযোগে অভিযুক্ত হন, তখন বুঝতে কি খুব একটা অসুবিধা আছে যে, বিদ্যমান ব্যবস্থায় ক্ষমতাবানদের হাতে ক্ষমতা থাকাটা ক্ষমতাবিহীনদের জন্য কতটা অনিরাপদ এবং ভোগবাদিতা কেমন নির্ভীক হয়ে পড়েছে?

আর এ প্রশ্নটা তো থেকেই যায় : অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত সমাজের কোথায় পাওয়া যাবে, যখন দেখা যায় বিশ্ববিদ্যালয়েও তেমন দৃষ্টান্ত নেই? পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন দুশ্চিন্তাগ্রস্ত শিক্ষক কদিন আগে আমাদের দপ্তরে এসেছিলেন। তার দুশ্চিন্তা অন্য বিষয়ে। সেটা হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের ভেতর নকলের প্রবণতা। পত্রিকায় প্রকাশিত গবেষণামূলক প্রবন্ধে, এমনকি পিএইচডি অভিসন্দর্ভেও চৌর্যবৃত্তির নিদর্শন দেখতে পেয়ে তিনি অত্যন্ত বিচলিত বোধ করছেন। আমরা তার ব্যথায় ব্যথিত হলাম, কিন্তু প্রতিকারের কোনো সহজ উপায়ের কথা বলতে পারলাম না। নকল করা বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরপরই ব্যাপক হারে দেখা দিয়েছিল। সেটা তখন ছিল স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের ব্যাপার। তারপর প্রতারণা এমন সুবিস্তৃত ও সুদক্ষ হয়েছে যে দু-চার জনকে শাস্তি দিয়ে প্রতিকার হবে না; পুরো ব্যবস্থাটাই বদলানো চাই।

ব্যবস্থাটা যে পুঁজিবাদী তা-ও বলেছি তাকে, যেমনটি অতীতেও বলেছি বহুবার। তিনি জ্ঞানী ব্যক্তি, আমাদের বক্তব্য যে বেঠিক তা বললেন না, কিন্তু জিজ্ঞাসা করলেন তাহলে কি আমাদের করণীয় কিছু নেই? আমরা বললাম, অবশ্যই আছে। আমরা অবশ্যই প্রতিবাদ করব, যেমন আপনি করছেন; কিন্তু এও জানা থাকবেÑআমাদের লক্ষণকে কাবু করলেই যে রোগটা সেরে যাবে তা কিন্তু নয়। লক্ষণের উৎসের প্রতিবিধান নিশ্চিত করা চািই। এসব কথায় তার বিষণ্নতা কাটল না, আমাদেরটাও যে কাটল তা-ও নয়।

  • ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা