আর্থিক খাত
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ
প্রকাশ : ০১ এপ্রিল ২০২৪ ১১:২৫ এএম
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ
১৭ মার্চ দুর্দশাগ্রস্ত
পদ্মা ব্যাংক একীভূত হলো এক্সিম ব্যাংক। একীভূত হওয়ার খবর পুঁজিবাজারের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে
জানতে পেরেছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। সম্প্রতি কিছু দুর্বল ব্যাংক সবল ব্যাংকের সঙ্গে
একীভূত করার উদ্যোগের কথা বলা হচ্ছে। সব মিলিয়ে পদ্মাসহ ডজনখানেক ব্যাংক একীভূত হতে
পারে। এর মধ্যে বেসরকারি খাতের সাতটি, সরকারি তিনটি এবং বিদেশি মালিকানার একটি ব্যাংকের
নাম শোনা গেছে। এর মাধ্যমে ব্যাংকের সংখ্যা ৫০-এর মধ্যে নামিয়ে আনার পরিকল্পনা নিয়ে
এগোচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর কারণ দেশে ব্যাংকের সংখ্যা অনেক। আর্থিক খাতে অনিয়ম-দুর্নীতির
অভিযোগ নতুন নয়। ব্যাংক মূলত আমানতকারীর সুরক্ষা নিশ্চিতকারী প্রতিষ্ঠান। সম্প্রতি
সংবাদমাধ্যমে নানা খবরে জানা গেছে, আর্থিক খাতে অনিয়ম-দুর্নীতির ফলে আমানতকারীরা ব্যাংকের
ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলছেন। ব্যাংকের ওপর নিয়ন্ত্রণ ও পর্যবেক্ষণের সুবিধার্থেই বাংলাদেশ
ব্যাংক এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গত দেড় দশকে নতুন বেশ কিছু ব্যাংক দেওয়া হয় ক্ষমতাবানদের
এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসব ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয় রাজনৈতিক বিবেচনায়। একীভূতকরণের ক্ষেত্রে
সবল ও দুর্বল ব্যাংক—দুই
পক্ষকেই সমন্বিত হওয়ার বিষয়ে একমত হতে হবে। আপাতদৃষ্টে কাজটি সহজ নয়। কারণ একীভূত বলা
হলেও ব্যাংকগুলোর সম্পদ ও দায় কীভাবে একীভূত করা হবে, তা একটা জটিল প্রক্রিয়া।
একীভূত করে দেশে
চালু ব্যাংকের সংখ্যা কমিয়ে আনার সিদ্ধান্ত আমাদের অর্থনীতির জন্য ভালো অবশ্যই। সিদ্ধান্তটি
রাজনৈতিক বলে অনেকের কাছেই সমালোচিত হচ্ছে বটে কিন্তু রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত অর্থনীতির
কাঠামোবদ্ধ রূপ দিয়ে যাচাইবাছাই করাও সমভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর
আর্থিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে বাস্তবায়নের পথে যাওয়া জরুরি। এ কথাও মনে রাখা জরুরি,
ভালো কোনো ব্যাংকের ওপর চাপ প্রয়োগ না করে স্বেচ্ছায় একীভূত হওয়ার মতো পরিবেশ তৈরি
করতে হবে। শুধু দুর্বল ব্যাংকগুলোকে সবল ব্যাংকের সাথে একীভূত করলেই বিদ্যমান সংকটের
নিরসন সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা তৈরি করে পেশাদারির ভিত্তিতে একীভূত
কার্যক্রম শুরু করতে হবে। যদি তা না করা যায় তাহলে দুর্বল ব্যাংকের দায়ভার সবল ব্যাংকের
ওপর অনেকটা চাপিয়ে দেওয়া হবে। যেসব ব্যাংক দুর্বল, তার তালিকা করে খারাপ সম্পদগুলো
পৃথক করা জরুরি। সংকটের উৎসে নজর দিতে হবে। একীভূত করার মাধ্যমে আর্থিক খাতে সমন্বয়মূলক
পরিবেশ গড়ে তোলার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে হবে বেশি। যখন একীভূত হওয়ার সুষ্ঠু-স্বচ্ছ
পরিবেশ তৈরি হবে তখন ব্যাংকগুলোকে স্বেচ্ছায় একীভূত হওয়ার আহ্বান জানানো যেতে পারে।
শুধু রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে জোর করে ভালো ব্যাংকের সঙ্গে খারাপ ব্যাংক একীভূত
করলে ইতিবাচক ফল না-ও মিলতে পারে।
ব্যাংকিং খাতের
বর্তমান সমস্যাসংকুল অবস্থার পেছনে সুশাসনের অভাব অনেকাংশে দায়ী। আর্থিক খাতে বিদ্যমান
সংকটের মধ্যে মূল্যস্ফীতি, টাকার মূল্যমান কমে যাওয়া, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকট,
ব্যাংকিং খাতে সুশাসনের অভাব, হুন্ডি, মুদ্রা পাচার, শেয়ারবাজার দুর্নীতি, ঋণখেলাপ,
ঋণ অবলোপন বড় সমস্যা। অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে বৈষম্য জিইয়ে থাকলে সামষ্টিক উন্নতি হলেও
সাধারণ মানুষ এর সুফলভোগী হতে পারে না। বিদ্যমান বাস্তবতায় অর্থনীতিতে বিদ্যমান সংকট
সমাধানের দিকে শ্যেনদৃষ্টি রাখা জরুরি। আর্থিক খাতের সংকটগুলো যদি কয়েকটি ভাগে বিচার
করতে যাই, তাহলে প্রথমেই আসে সুশাসনের অভাবের প্রসঙ্গ। আর্থিক খাতে সুশাসনের অভাব নিয়ে
আলোচনা-সমালোচনা ইতোমধ্যে কম হয়নি। এ সুশাসনের অভাবের পেছনে রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক
প্রভাব বিরূপ প্রভাব ফেলে। এসব নেতিবাচকতার পাশাপাশি সরকার বা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কিছু
ভুল সিদ্ধান্তও আর্থিক খাতের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে।
ব্যাংকিং খাতে
অনিয়ম-দুর্নীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের নমনীয় অবস্থানও অনেকটা দায়ী। বাংলাদেশে
কোনো ব্যাংকের পতন বিরল ঘটনা। দুর্বল ব্যাংককে একীভূত করার প্রসঙ্গ এলে অন্তত আমাদের
তা-ই মনে হয়। তবে পশ্চিমা আর্থিক দুনিয়ায় কোনো ব্যাংকের পতন এবং অন্য কোনো শক্তিশালী
ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হওয়া নতুন কিছু নয়। এ ক্ষেত্রে তদারকি প্রতিষ্ঠানের কঠোর অবস্থান
ও তদারকি আমানতকারীর ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন
করে। দেশের ব্যাংকিং খাতে ঋণখেলাপি ও নানা অনিয়মের কারণে কিছু ব্যাংক নাজুক হয়ে পড়েছে।
নাম-তালিকা উল্লেখ না করার পরও ব্যাংকসংশ্লিষ্ট অনেক ব্যক্তি কিছু ব্যাংককে চতুর্থ
শ্রেণির ব্যাংক বলে অভিহিত করে আসছেন। এমনকি অনেক ব্যাংক যেন নামমাত্র তাদের কার্যক্রম
পরিচালনা করে আসছে। কিছু ব্যাংক বাছবিচার ছাড়াই বিপুল অঙ্কের ঋণ দিয়ে ঝুঁকির মধ্যে
রয়েছে। গ্রাহকের আমানতের টাকা নির্বিচারে ঋণ দেওয়ায় অনেক ব্যাংকের তারল্য সংকট চরমে।
কিছু কিছু ব্যাংক অন্য ব্যাংকের সঙ্গে সমন্বয় করে তারল্য সহায়তা নিচ্ছে। ফলে ব্যাংক
একীভূত করার সিদ্ধান্তটি সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
কিছুটা দেরিতে
হলেও দুর্বল ব্যাংক একীভূত করার ঘোষণা আসায় ব্যাংক খাতের সংস্কার আবার নতুন করে আলোচনায়
এসেছে। এমন আলোচনা কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিজেই উত্থাপন করেছে। দেশের ব্যাংকিং খাতের নিয়ন্ত্রক
সংস্থাটি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী কর্মকর্তাদের নিজেদের মতো করে একীভূত হওয়া বা করার
আলোচনা শুরুর আহ্বান জানিয়েছে এবং ইতোমধ্যে দুটি ব্যাংকের মধ্যে এ কার্যক্রমও শুরু
হয়েছে। অথচ ব্যাংক খাত শক্তিশালী করার বিষয়ে রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি বহু আগে থেকেই দেওয়া
হচ্ছে। সমস্যা হলো, অর্থনীতি তার স্বাভাবিক সংজ্ঞাসূত্র অনুসারে পরিচালিত হয়। এখানে
রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি কিংবা বক্তব্য প্রধান নয়। আগেই বলেছি, দেশে আর্থিক খাতের সংস্কার
নিয়ে ইতোমধ্যে কম আলোচনা হয়নি। অর্থনীতিবিদরা আর্থিক খাতের সংস্কারে নানা পরামর্শ দিলেও
তা যেন এতদিন বাংলাদেশ ব্যাংক আমলে নেয়নি। আর্থিক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য যা কিছু
করণীয় তা যদি যথাসময়ে নেওয়া হতো, তাহলে ব্যাংকিং খাত এভাবে মুখ থুবড়ে পড়ত না। ঋণ নেওয়ার
পর ঋণ ফেরত না দেওয়ার একটা অপসংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। খেলাপি ও অবলোপন ঋণ আদায়ের ব্যাপারে
কেন্দ্রীয় ব্যাংক নমনীয় হয়ে অনেক ছাড় দিয়েছে। দফায় দফায় সময় বাড়িয়েছে। এসব সিদ্ধান্ত
নেওয়া হয়েছে আর্থিক পরিস্থিতি বিবেচনায়। কিন্তু এগুলোর কোনো ইতিবাচক ফল মেলেনি। বিশেষ
করে আমাদের দেশের ব্যাংকঋণগুলো বড় ও সীমিতসংখ্যক ক্ষমতাবান ব্যবসায়ীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
তাই দফায় দফায় এভাবে সময় বাড়িয়ে ঋণ আদায়ে গাফিলতির দিকটিই বড় হয়ে ধরা পড়ে। এমনকি ঋণ
আদায়ের ক্ষেত্রে ইতিবাচক ফল তো মেলেই না উল্টো তারল্যসংকট প্রকট আকার ধারণ করে।
বাংলাদেশের ব্যাংকব্যবস্থায়
দ্বৈত নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক বিভাগ ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিয়ন্ত্রণকারী
হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে। এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একক দায়িত্ব ও জবাবদিহিরও
ঘাটতি দেখা যায়। ব্যাংক নিয়ন্ত্রণে আর্থিক বিভাগ থাকার কোনো যৌক্তিকতাই নেই, সব ব্যাংককে
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আওতাভুক্ত থাকতে হবে। আমরা দেখছি, আর্থিক খাতে বিভিন্ন সময় অনিয়মকারীদের
বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপিত হয়। অভিযোগ উত্থাপিত হওয়ার পর সমালোচনাও হয়। কিন্তু তাদের
আইনের আওতায় এনে প্রতিবিধান নিশ্চিত করা হয় না অনেক ক্ষেত্রেই। স্বচ্ছতা, জবাবদিহি
ও প্রতিবিধান নিশ্চিত করতে না পারায় ব্যাংক খাতে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।
পুঁজির পরিমাণ, তফসিলিকরণ, সিঙ্গেল এক্সপোজার লিমিট, ঋণের শ্রেণিকরণ, সাব-স্ট্যান্ডার্ড,
মন্দ ঋণ, খেলাপি ঋণসহ নানা সমস্যার সমাধান বা চ্যালেঞ্জ ব্যাংক খাত সামাল দিতে পারছে
না সুশাসনের অভাবে। দুর্নীতি ও ব্যাংক খাতে সুশাসনের অভাবের পরিপ্রেক্ষিতে নিয়ন্ত্রণকারী
সংস্থাগুলোর অদক্ষতা-দুর্বলতা সঙ্গত কারণেই উঠে আসে। দেশে আর্থিক খাতে তদারকির জন্য
বাংলাদেশ ব্যাংক, সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশন, বিটিআরসির মতো নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলো
শক্ত অবস্থান নিয়ে এবং স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে বলে মনে হয় না।
উল্লেখ্য, নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার কর্মকর্তারা রাজনীতি ও আমলাতান্ত্রিক প্রভাবমুক্ত নন। বিদ্যমান নীতিমালা অনুযায়ী, চলতি বছরের আর্থিক তথ্যের ভিত্তিতে আগামী বছরের মার্চ থেকে দুর্বল ব্যাংকের ব্যবসা সীমিত করে দেওয়া হবে। এর পরই একীভূত বা অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু হবে। দুর্বল ব্যাংক চিহ্নিত করা হবে মূলধন ঘাটতি, উচ্চ খেলাপি ঋণ, তারল্য ও সুশাসনে কতটা ঘাটতি রয়েছে তার ভিত্তিতে। ব্যাংকগুলোর ২০২৪ সালের আর্থিক প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ২০২৫ সালের মার্চ থেকে এ নীতিমালা কার্যকর হবে। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারেও আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার কথা ছিল। সে অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংক কাজ করছে। খেলাপি ঋণ কমানো ও ব্যাংক খাতে সুশাসন ফেরানোর বিষয়ে সামনে নতুন নীতিমালা বাস্তবায়নের কার্যক্রম শুরু হলে এর ইতিবাচক ফলভোগী হব আমরাই।