ভারতীয় পণ্য বর্জন
এম হুমায়ুন কবির
প্রকাশ : ৩১ মার্চ ২০২৪ ১২:৩২ পিএম
আপডেট : ৩১ মার্চ ২০২৪ ১৫:০৫ পিএম
এম হুমায়ুন কবির
সম্প্রতি বিএনপির
পক্ষ থেকে ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক দেওয়া হয়েছে। কয়েকদিন আগে ঢাকায় নয়াপল্টনে দলের
কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে নিজের গায়ে থাকা ভারতীয় চাদর জনসমক্ষে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে
ভারতীয় পণ্য বর্জনের আনুষ্ঠানিক সূচনা করেন বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর
রিজভী। কর্মসূচির সমর্থনে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবদিন ফারুক বলেছেন,
‘গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভারতের অবস্থান জন-আকাঙ্ক্ষার
বিপক্ষে ছিল বলে ভারতীয় পণ্য বর্জন কর্মসূচি হচ্ছে।’ রাজনৈতিক দলটির এ অবস্থান সাধারণ্যে
তো বটেই সংবাদমাধ্যমেও ব্যাপক আলোচিত। বিষয়টি সমাজমাধ্যমেও নানা প্রতিক্রিয়ার জন্ম
দিচ্ছে। শুধু ডাকই নয়, ভারতীয় পণ্য বর্জনের পক্ষে নানারকম প্রচারও দেখতে পাওয়া যাচ্ছে।
যদিও ভারতীয় পণ্য বর্জনের অবস্থান বিএনপির। কিন্তু একটি মহল এ ক্ষেত্রে আলাদা প্রচার
চালাচ্ছে এমন অভিযোগও ইতোমধ্যে নানা মহল থেকে পাওয়া গেছে।
বিএনপির শীর্ষস্থানীয়
কয়েকজন নেতাও এ নিয়ে সংবাদমাধ্যমে বিবৃতি দিয়েছেন। ভারতীয় পণ্য বর্জনের এ সরল অবস্থানেরও
কিছু দিক রয়েছে যা আলোচনা করা জরুরি। ভারতীয় পণ্য বর্জনের অবস্থানের ক্ষেত্রে ভাবাবেগের
দিকটিও পুরোপুরি এড়িয়ে যাওয়ার অবকাশ নেই। রাজনৈতিক মতাদর্শ ও সাধারণ মানুষের ভাবাবেগের
মধ্যকার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ফল হিসেবে বিষয়টি সম্প্রতি আলোচনায় এসেছে, এ কথা বললে
মোটেও অত্যুক্তি হবে না। ভাবাবেগের বিষয়টি একটু খোলাসা করা জরুরি। কিছুদিন আগে ক্রিকেট
বিশ্বকাপ ঘিরে ভারতের প্রতিক্রিয়ার কারণে আমাদের সাধারণ মানুষের মনে কিছু নেতিবাচক
ধারণা জন্মায়। দুদেশেরই কিছু মানুষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে। একে
অন্য সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য করে। অথচ এ ধরনের কাজ মূলত পারস্পরিক সম্পর্কে বিদ্বেষ
ছড়ানো ছাড়া কোনো ভূমিকা রাখে না।
কদিন আগে ভারতের
তুলনায় বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় বেশি এমন একটি পরিসংখ্যান সমাজমাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার
পর দুই দেশেরই কিছু মানুষ অহেতুক তর্কে জড়িয়ে পড়ে। এমনকি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে
ভারতের ভূমিকা নিয়েও মানুষ বাক-বিতন্ডায় জড়িয়েছে। এর সব কিছুই বিভিন্ন সময় প্রশ্নবিদ্ধ
হয়েছে। এসব প্রতিক্রিয়ার দরুন সাধারণ মানুষের মনে প্রতিবেশী দেশের মানুষের মনে এক ধরনের
হতাশা কিংবা ক্ষোভ জন্মেছে। যা বিভিন্ন সময়ে নানান নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া প্রকাশের ফল।
আর এসব প্রতিক্রিয়ার ফলাফল থেকেই ভাবাবেগতাড়িত হয়ে মূলত ভারতীয় পণ্য বয়কটের সিদ্ধান্তের
কথা বলা। অর্থাৎ ভারতীয় পণ্য বর্জনের ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের অবস্থানের যে বিষয়টি
চোখে পড়ে তা ভাবাবেগতাড়িত।
ভারতীয় পণ্য বর্জনের
অবস্থানের রাজনৈতিক মাত্রা রয়েছে অবশ্যই। বিএনপি এ বিষয়ে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে।
কিন্তু রাজনৈতিকভাবে এ অবস্থান কীভাবে বিবর্তিত হবে তা এখনই বলা ঠিক হবে না। অভিযোগ
আছে, কোনো একটি মহল বিষয়টিকে তাদের রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার
করতে চায়। এমনকি প্রচারের ক্ষেত্রেও তারা ভারতীয় পণ্য বর্জনের বিষয়টি উত্থাপন করতে
পারে। কিন্তু ভারতীয় পণ্য বর্জনের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়েই তারা ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড
পরিচালনা করবে কি না তা এখনই আমাদের পক্ষে জানা সম্ভব নয়। তাই রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণে
এ অবস্থান বিচার না করাই শ্রেয়। বরং জনমনে প্রতিবেশী দেশের মানুষের প্রতিক্রিয়ার বিষয়ে
যে এক ধরনের নেতিবাচকতা কিংবা ক্ষোভ রয়েছে তাকেই বেশি জোর দেওয়া উচিত বলে মনে করি।
ভারতীয় পণ্য বর্জনের
বাস্তবিকতার দিকে তাকালে সমস্যাটি আর সরল বলে প্রতীয়মান হবে না। বলা হয়, ভারতীয় পণ্য
বর্জন করার কথা। কিন্তু আসলে কোন ধরনের পণ্য বর্জন করা হবে? সচরাচর যেসব ভারতীয় পণ্য
আমাদের বেশি মনোযোগ আকর্ষণ করছে সেগুলোই বর্জন করার কথা বলা হচ্ছে। আরও একটু গভীরভাবে
ভাবা উচিত। এমন কিছু পণ্য রয়েছে যেগুলোর কাঁচামাল আমরা ভারত থেকে আমদানি করি। এসব কাঁচামাল
দিয়ে তৈরি পণ্য রপ্তানি করে আমরা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করি। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন দাঁড়ায়Ñভারতীয়
পণ্য বলতে কি শুধু ভোগ্যপণ্যের কথা বলা হচ্ছে? নাকি আমরা সব ধরনের ভারতীয় পণ্য বর্জনের
কথাই বলছি? সব ধরনের ভারতীয় পণ্যই যদি বর্জন করা হয় তাহলে আরেকটি প্রশ্ন সঙ্গত কারণেই
দাঁড়ায়। যেহেতু কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভারতীয় পণ্যের মাধ্যমে আমাদের জাতীয় স্বার্থসিদ্ধি
হয় সেগুলোর কী হবে? আর যদি আমরা ভারতের এসব পণ্য বর্জন করি তাহলে পরিপূরক পণ্যবাজারের
কথা কি ভাবা হয়েছে? পরিকল্পনাগতভাবে এ বর্জনের জন্য কি আমরা প্রস্তুত? এমন অসংখ্য সূক্ষ্ম
কিন্তু নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর এখনও আমরা পাইনি। এ বিষয়টিকে
মনস্তাত্ত্বিক ও ভাবাবেগতাড়িত একটি সিদ্ধান্ত হিসেবে আমরা দেখতে পারি। এমনকি রাজনৈতিক
দৃষ্টিকোণেও তা যৌক্তিক মেনে নেওয়া যায় যদি রাজনৈতিকভাবে এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া
হয়।
সবকিছু ছাপিয়ে
আমাদের সামনে জটিল প্রসঙ্গটিই দাঁড়ায়। ভারত থেকে আমরা যে পরিমাণ আমদানি করি তার কত
শতাংশ ভোগ্যপণ্য এবং বাকি কতটুকু অংশ মূলত উৎপাদনের কাঁচামাল এসব তথ্য-পরিসংখ্যান আমাদের
রয়েছে কি না? অন্তত এমন একটি প্রসঙ্গ নিয়ে ভাবতে গেলে বোঝা যায়, ভারতীয় পণ্য বর্জনের
সিদ্ধান্তটি ভাবাবেগতাড়িত। ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক বহু পুরোনো। ভারতের সঙ্গে নিরাপত্তাসহ
নানা বিষয়ে আমাদের দ্বিপক্ষীয় কূটনীতি পরিচালিত হয়। কিন্তু দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের
ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক ভিত্তিটিই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এ অর্থনৈতিক লেনদেন কিংবা আমদানি-রপ্তানির
নিরিখেই দুই দেশের সিংহভাগ কূটনৈতিক সম্পর্ক পরিচালিত হচ্ছে। রাজনৈতিকভাবে ভারতীয় পণ্য
বর্জনের অবস্থানের ক্ষেত্রে এ বিষয়টিও বিচার-বিশ্লেষণে রাখা জরুরি। এ ক্ষেত্রে একটি
উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর দেশের অর্থনীতির স্বার্থেই
বাজার উন্মুক্ত ঘোষণা করে। এ উদ্যোগের ফলে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয় ভারত। কারণ আমদানির
জন্য পণ্য শুল্ক কমিয়ে দেওয়া হয় এবং বিভিন্ন পণ্যের আমদানি বাড়তে শুরু করে। ভারত আমাদের
নিকটপ্রতিবেশী হওয়ায় এ সুবিধা বেশি ভোগ করতে পেরেছে। ভারত থেকে পণ্যসামগ্রী সহজেই আমদানি
করা যায়। এজন্য ব্যবসায়ীরাও ভারতীয় পণ্য আমদানি করে দেশের ভেতর ব্যবসায় কার্যক্রম পরিচালনা
করেছেন। নিজেদের অর্থনীতির স্বার্থে নেওয়া সিদ্ধান্তে লাভবান হয়েছিলেন অন্য একটি দেশের
ব্যবসায়ীরা। তারা তাদের বাজার সম্প্রসারিত করতে পেরেছিলেন। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের এসব
জটিল সমীকরণের বিষয় মাথায় রেখেই অর্থনীতির স্পর্শকাতর বিষয়গুলোকে রাজনৈতিক এজেন্ডা
বানানো উচিত বলে মনে করি।
আপাতত যুক্তির
স্বার্থে ধরে নিলাম, ভারতীয় পণ্য বর্জন করা হবে। এমনটি অসম্ভব কিছু না। জাতীয় স্বার্থে
অনেক সময় এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে। কিন্তু ভারতীয় পণ্য বর্জন করলে তার বিকল্প
কী তা ভাবা বাঞ্ছনীয়। বিশ্ব অর্থনীতিতে এক মুহূর্ত থেমে থাকার সুযোগ নেই। অর্থনীতি
সামান্য স্থবির হয়ে পড়লে আমাদের অনেকাংশে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়তে হবে। শুধু
বিকল্প ভাবলেই হবে না। যে বিকল্পের কথা ভাবা হচ্ছে তা কি সাশ্রয়ী? ওই বিকল্প বাজারে
পণ্য ব্যবস্থাপনা ও সরবরাহের ক্ষেত্রে আমাদের কী কী সুবিধা রয়েছে সেসবও ভাবতে হবে।
আমাদের নিকটতম রাষ্ট্র হওয়ায় ভারতীয় পণ্য আমদানিতে যে সুযোগ পেয়ে থাকি তা কি বিকল্প
বাজার থেকে পাওয়া যাবে? যদি সে সুযোগ পাওয়া যায়ও, এর মধ্যে পণ্য সরবরাহের বাড়তি সময়টুকু
নিয়েও আমাদের ভাবতে হবে। এই যে সময়ের আর্থিক মূল্য তা নিরূপণ কীভাবে করা হবে সে বিষয়ে
দৃশ্যমান প্রস্তাব থাকাও জরুরি। এসব বিষয় ভাবনায় থাকে বলেই পৃথিবীর অনেক দেশকে স্যাংশন
দেওয়ার পরও পুরোপুরি কার্যকর করা যায় না। স্যাংশন যে দেশটিকে দেওয়া হচ্ছে তারা এক ধরনের
বিকল্প কোনো না কোনোভাবে তৈরি করে ফেলে।
এজন্যই আমরা বলি, মাল্টিপোলার বিশ্বে একচ্ছত্র কোনো সিদ্ধান্ত বেশিদিন টিকে থাকে না। মাল্টিপোলার বিশ্বে অর্থনৈতিক পারস্পরিক সম্পর্কের জায়গা এমন যে, কোনো রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কার্যকারিতা মূল্যায়নের প্রয়োজনীয়তা ব্যাপক হয়ে ওঠে। সম্প্রতি ভারতীয় পণ্য বর্জনের অবস্থানে সাধারণ মানুষের ভাবাবেগ রয়েছে এবং আংশিকভাবে রাজনৈতিক দিকও রয়েছে। যদিও বিষয়টিকে কম গুরুত্ব দেওয়া উচিত এমনটি দাবি করছি না। কিন্তু এর বহুমাত্রিক সমীকরণও কষতে হবে। এমন অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে যে বিশাল পরিসরের ভাবনা ও মূল্যায়ন আবশ্যক সেদিকে কতটা জোর দেওয়া হচ্ছে তা নিয়ে আমাদের ভাবা উচিত।