ঐতিহ্য
তানজিদ শুভ্র
প্রকাশ : ৩১ মার্চ ২০২৪ ১২:১৯ পিএম
ময়মনসিংহ অঞ্চলটি
নানা কারণেই বিখ্যাত। আখের রস, হাতে তৈরি লালচিনি এ অঞ্চলের বিশেষায়িত খাদ্যপণ্য। লাল
চিনি ফুলবাড়িয়া উপজেলায় উৎপাদিত হয়। জনশ্রুতি আছে, ‘করলে তৈরি লাল চিনির ক্ষীর, খাওয়ার
জন্য পড়ে যায় ভিড়’। সময়ের পরিক্রমায় ফুলবাড়িয়াবাসীর দেশের বিভিন্ন প্রান্তে অবস্থানের
সুবাদে এ লাল চিনির পরিচিতি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। লাল চিনির কারণে এ অঞ্চলটির আলাদা
পরিচিতি রয়েছে।
লাল চিনির প্রস্তুতপ্রণালিও
একদম মৌলিক। আখের রস থেকে নিজস্ব প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রক্রিয়াজাত করে হাতে তৈরি হয়
এ চিনি। কোনো পণ্য জিআই স্বীকৃতি পেতে যেসব মানদণ্ড লাগে, সেসব বিষয়ে লাল চিনি উপযুক্ত।
কৃষক যুগ যুগ ধরে স্থানীয় আবহাওয়া ও মাটির সঙ্গে খাপ খাইয়ে তাদের উদ্ভাবিত প্রযুক্তির
সাহায্যে আখ উৎপাদন এবং উৎপাদিত আখ থেকে লাল চিনি তৈরি করে আসছে। লাল চিনি দেখতে মিহি
দানার গুঁড়ার মতো, স্বাদে সুমিষ্ট। এ চিনি তৈরি হয় ফাল্গুন, চৈত্র, বৈশাখে। প্রথমে
আখ কেটে শ্যালো ইঞ্জিন চালিত মাড়াইকলের সাহায্যে রস বের করা হয়। তার পাশেই তৈরি করা
হয় জ্বালঘর। সচরাচর সাতটি চুলায় লোহার কড়াই বসানো হয়। তারপর প্রথম কড়াইয়ে পরিমাণমতো
কাঁচা রস দিয়ে জ্বাল দেওয়া শুরু হয়। এরপর প্রথম কড়াই থেকে রস বাকি ছয় কড়াইয়ে নিয়ে জ্বাল
করা হয়। পূর্ণ জ্বাল হওয়ার পর কড়াইসহ চুলা থেকে নামিয়ে কাঠের ডাং (মুগুর) দিয়ে বিরামহীন
ঘুটতে থাকে যতক্ষণ শুকনো ধুলার আকার ধারণ করে। এভাবেই দানাদার বাদামি রঙের লাল চিনি
তৈরি এবং রোদে শুকিয়ে সংরক্ষণ করা হয়।
লাল চিনি দিয়ে
তৈরি মুড়ির মোয়া অত্যন্ত সুস্বাদু হয়। এ ছাড়া মুড়ি, চিঁড়া কিংবা অন্যান্য খাবারের সঙ্গেও
লাল চিনির ব্যাপক ব্যবহার দেখা যায়। এমনকি লাল চিনি দিয়ে দুধভাত খাওয়ার স্বাদ অতুলনীয়।
শ্রমিক সংকট, মজুরি বৃদ্ধি ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কারণে পূর্বপুরুষের এ পেশা ছেড়ে
অন্য পেশায় ঝুঁকছে কৃষক। পাশাপাশি লক্ষ করা যাচ্ছে, কিছু অসাধু লোক লাল চিনি প্রস্তুতে
ভেজাল মিশিয়ে বাজারজাত করছে। এর ফলে যেমন চিনির গুণগত মান নষ্ট হচ্ছে তেমন সুনামও কমছে
দিন দিন। জিআই স্বীকৃতি পেলে সুনির্দিষ্ট অঞ্চলের পণ্যের প্রসার ঘটানো, গুণ বৃদ্ধি
ও নকল রোধে ব্যবস্থা নেওয়া সহজ হয়। তা ছাড়া এ সনদ পাওয়া পণ্যের মূল্য ২০ শতাংশ বেড়ে
যায়। বাংলাদেশে জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পাওয়া বা চাওয়ার বিষয়টি নতুন নয়। ইতোমধ্যে ২০টির
অধিক পণ্য জিআই স্বীকৃতি পেয়েছে। প্রথম ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে ২০১৬ সালের ১৭
নভেম্বর জামদানি স্বীকৃতি পায়।
উপজেলা কৃষি অফিসের
তথ্যমতে, চলতি বছর ফুলবাড়িয়ায় ৯৫০ হেক্টর জমিতে আখ চাষ হয়েছে। এর মধ্যে ৬৫০ হেক্টরে
৫২ টন আখ উৎপাদিত হয়েছে। প্রতি হেক্টর আখ থেকে প্রায় ৮ টন লাল চিনি হয়। বর্তমানে প্রতি
মণ চিনির মূল্য সাড়ে ৭ হাজার থেকে ৮ হাজার টাকা। এ হিসাবে এবার ১০৪ কোটি টাকার চিনি
বিক্রি করতে পারবে ফুলবাড়িয়ার কৃষক। লাল চিনির বৈশ্বিক স্বীকৃতির অগ্রগতি দেখভালের
পাশাপাশি ভেজাল চিনি উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের বিরুদ্ধে কৃষক পর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধিতে
কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।