× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

সড়ক ব্যবস্থাপনা

দুঃসহ যানজট, কার্যকর পদক্ষেপ জরুরি

ড. আদিল মুহাম্মদ খান

প্রকাশ : ৩০ মার্চ ২০২৪ ১২:৪৬ পিএম

ড. আদিল মুহাম্মদ খান

ড. আদিল মুহাম্মদ খান

প্রতিবারের মতো এবারও রমজান মাসে বিশেষ করে ঢাকার সড়কে দুর্ভোগের বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে। রমজানে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মসময় এক ঘণ্টা এগিয়ে নিয়ে আসে। শুধু তাই নয়, ইফতারের আগমুহূর্তে ও তারাবির সময় সড়কে বাড়তি চাপ থাকে। এ কারণে যানজট দেখা দেয়। বছরের অন্যান্য সময়ও সড়কে যে যানজট থাকে না তা কিন্তু নয়। তবে রমজানে এ ভিড় স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি থাকে। ঈদ যত এগিয়ে আসে ততই সড়কে যানজট বাড়তে থাকে। মূলত রমজানে মানুষের তাড়া থাকে বেশি। বছরের অন্যান্য সময় মানুষের কর্মঘণ্টা থাকে বেশি। আর কর্মঘণ্টা বেশি থাকায় তারা বিভিন্ন সময়ে ঘরে ফেরে। কিন্তু রমজানে ইফতার ও তারাবির আলাদা তাড়া থাকে। বিকাল ৪টা থেকে ৫টার মধ্যে বাড়িফেরতা অনেককেই যানজটে দুর্ভোগ পোহাতে।

যানজটের জন্য ঢাকা শহরের অখ্যাতি নতুন নয়। ঢাকার মতো মেগাসিটিতে বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে যানজটের শঙ্কা বাড়লে সঙ্গত কারণেই কিছু প্রস্তুতি-পরিকল্পনার কথা বিবেচনা করা জরুরি। ঢাকায় যে পরিমাণ রাস্তা রয়েছে তার পরিপূর্ণ ব্যবহার এখনও নিশ্চিত করা যায়নি। এমনকি শহরের বিভিন্ন অঞ্চলে যাতায়াতের সুগম সড়কের অভাবও রয়েছে। ট্রাফিক ও লেন অব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও আমরা অনেকাংশে পিছিয়ে পড়েছি। বিশেষত রমজানে ফুটপাত এমনকি মূল সড়কের বড় একটি অংশ থাকে হকারের দখলে। পাশাপাশি ক্রেতার ভিড়ও অনেক ক্ষেত্রে যানজটের প্রত্যক্ষ কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ঢাকার মতো শহরে সড়ক ব্যবস্থাপনার অভাব থাকায় রমজানে যানজট ‘অনিবার্য পরিণতি’ হয়ে ওঠে।


রমজানের আগে ডিএমপি প্রতিবারের মতো বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি এখনও। অনেক নগর পরিকল্পনাবিদের অভিমত, যানজট কমার কোনো লক্ষণ বা দৃশ্যমান উদ্যোগ এখনও নেওয়া হয়নি। গত বছরের তুলনায় এবার নতুন কোনো উদ্যোগ নেই। যদি উদ্যোগ নেওয়া হতো তাহলে গত বছরের তুলনায় ভিন্ন ফল হয়তো পাওয়া যেত। তবে গত বছরের তুলনায় এ বছর দুটি সড়ক অবকাঠামো নতুনত্ব এনে দিয়েছে। মেট্রোরেল এবং এক্সপ্রেসওয়ে সড়কের ওপর বাড়তি চাপ কিছুটা হলেও কমাবে এমন একটি প্রত্যাশা ছিল। সাম্প্রতিক সময়ে এক্সপ্রেসওয়ের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ র‍্যাম্প চালু করা হয়েছে। এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহারের দিকেও অনেকের আগ্রহ বাড়ছে। যেমন বাড়ছে মেট্রোরেলের যাত্রীসংখ্যা। তবে এ কথাও সত্য, এক্সপ্রেসওয়ের কারণে কারওয়ানবাজার ও মালিবাগের মতো এলাকায় যানজট বেড়েছে। কিন্তু সার্বিকভাবে ঢাকার সড়ক যোগাযোগে এক্সপ্রেসওয়ে ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে।

প্রশ্ন হচ্ছে, সার্বিকভাবে এ অবকাঠামো কি ঢাকার যোগাযোগব্যবস্থায় বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে পেরেছে? এক্সপ্রেসওয়ে কিংবা মেট্রোরেল ঢাকার যে রুটে যাত্রীদের সেবা দেয় তা পুরো ঢাকার রুটের হিসাবে নগণ্য। ঢাকার মতো মেগাসিটির সড়কের মূল বৈশিষ্ট্য স্বল্পদূরত্ব। সচরাচর যাত্রীরা দু-তিন-চার কিলোমিটারের পথ পাড়ি দেয়। স্বল্পদূরত্বের যাত্রীদের জন্য বড় এ প্রকল্পগুলো আহামরি সুফল নিয়ে আসতে পারেনি। কারণ এক্সপ্রেসওয়ে কিংবা মেট্রোরেলের মাধ্যমে তারা স্বল্পদূরত্ব পাড়ি দেওয়ার কথা ভাবে না। যারা সচরাচর স্বল্পসময়ে বেশি দূরত্ব পাড়ি দিতে চায় তাদের জন্য এ দুটি প্রকল্প নিঃসন্দেহে দুর্ভোগ কমাতে অনেকাংশে প্রভাব রেখেছে। কিন্তু এ দুটি প্রকল্প পুরো ঢাকার ট্রিপ বা রুট কাভার করে না। ফলে নগরে ট্রাফিকের গতি বাড়ানোর বিষয়টি এখনও নিশ্চিত হয়নি।

ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা সুগম করার মাধ্যমে এ গতি বাড়ানো কঠিন না হলেও এখনও দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ঢাকা শহরে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সড়কে সুশাসন প্রতিষ্ঠা জরুরি। পার্কিং ও ফুটপাতের সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে সড়কের অনেকাংশেই গতি বাড়ানো সম্ভব। কারণ ফুটপাত ও সড়কের কিছু অংশে গাড়ি পার্কিং করায় সড়ক সংকুচিত হয়ে পড়ে। শুধু তাই নয়, গণপরিবহনে যত্রতত্র যাত্রী ওঠানো-নামানো, যাত্রীদের অসচেতনতা, বাসস্ট্যান্ডের অভাব থাকায় সড়কে অনিয়ম-উচ্ছৃঙ্খলতা এখনও জিইয়ে রয়েছে। ইতোমধ্যে ঢাকায় বেশ কয়েকটি মানসম্পন্ন গণপরিবহন চালু করা হলেও সমগ্র ঢাকায় এমন সুবিধা নিশ্চিত করা যায়নি। ফলে যানজটসংশ্লিষ্ট আমাদের সংকটগুলো থেকে রেহাই মেলেনি।

প্রতি বছরই বিশেষ করে ঢাকায় ব্যক্তিমালিকানাধীন গাড়ি বাড়ছে। শুধু তাই নয়, মোটরবাইকের সংখ্যাও ক্রমেই বাড়ছে। যানবাহনের সংখ্যা বাড়লেও সড়কে ট্রাফিকের চাপ কমেনি। সার্বিকভাবে ঢাকার অবকাঠামোর ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। অনেক স্থানে নতুন ভবন হয়েছে, কোথাও প্রকল্পের সংস্কার করতে হয়েছে, সড়ক সংকুচিত করতে হয়েছে; আবার কোথাও প্রসারণের কাজটি করতে হয়েছে। মহানগরে কোলাহল দিন দিন বাড়ছে। এ পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মেট্রোরেল বাদে সড়কে তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন নেই। সম্প্রতি ঢাকার সড়কে যানজটের ক্ষেত্রে একটি বড় পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। মূল সড়ক দিয়ে অনেকেই নিয়মিত যাতায়াত করে। তবে সেকেন্ডারি সড়কগুলোয়ও এখন যানজট বাড়ছে। অলিগলিতে বহুতল ভবন ও বাণিজ্যিক কেন্দ্র নির্মাণের ফলে মানুষের কার্যক্রম ও সক্রিয়তা বাড়ছে। সক্রিয়তা বাড়ার দরুন সেকেন্ডারি সড়কগুলোয়ও দেখা দিচ্ছে মানুষের ভিড় ও যানজট। উদাহরণ হিসেবে গ্রিন রোডের কথাই ধরা যাক। গ্রিন রোডে বিগত ১০ বছরে অনেক হাসপাতাল ও অফিস গড়ে উঠেছে। এ সড়কটির পক্ষে এত পরিমাণ বাণিজ্যিক ও প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামোর ভিড় সামলানো সম্ভব নয়। কিন্তু শহরে মানুষের কর্মব্যস্ততার সঙ্গে যানবাহন ব্যবহারের মাত্রাও বেড়েছে।

সড়ক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে আমরা সব সময় মূল সড়কের কথা ভাবি এবং উল্লেখ করি। কিন্তু ট্রাফিক বিভাগ কিংবা সিটি করপোরেশন সেকেন্ডারি রোড, অলিগলি নিয়ে ভাবে কি না যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। এ ধরনের সড়কেও ব্যবস্থাপনা জরুরি। রিকশা, বাইক ও ব্যক্তিগত গাড়ি চলাচলের ক্ষেত্রে কিছু নিয়মকানুন তো চালু করা উচিত। ঢাকার অনেক স্থানে গলিতে একটি গাড়ি প্রবেশ করার সুযোগ নেই। সেখানেও একাধিক গাড়ি প্রবেশ করতে গিয়ে যানজট সৃষ্টি করছে। কারণ ওই সরু গলির দুই পাশেই বহুতল ভবন গড়ে উঠছে। মানুষের সক্রিয়তার মাত্রাও দিন দিন বাড়ছে। ঢাকা এমন এক মহানগরী যেখানে কেউ চাইলেই যেকোনো ধরনের সড়ক ব্যবহার করতে পারবে না। ফলে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে সুপরিকল্পনার বিকল্প নেই। বিশেষত ঢাকার স্থানীয় ও বৃহৎ পর্যায়ে মোবিলিটি পরিকল্পনার অভাবের অভিযোগ বহু পুরোনো। শুধু মেট্রোর ওপর নির্ভর করে আমরা আমাদের সার্বিক সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার সংহত রূপ যাচাই করতে পারব না। উল্লেখ্য, মেট্রোরেলেও সম্প্রতি যাত্রীর চাপ বাড়ায় বগির সংখ্যা বাড়ানোর প্রস্তাব উত্থাপিত হয়েছে।

সড়ক যোগাযোগের ক্ষেত্রে আরও কিছু বিষয় আমলে রাখা প্রয়োজন। সড়ক খনন নীতিমালা যথাযথভাবে তদারকির জন্য প্রয়োজনীয় লোকবল নিয়োগ করা দরকার। এ ক্ষেত্রে সব ধরনের জনদুর্ভোগ কমাতে ও এলাকাভিত্তিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের প্রয়োজনীয় তদারকির জন্য ‘ওয়ার্ডভিত্তিক কমিউনিটি ব্যবস্থাপক’ নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। সদিচ্ছা থাকলে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের জনভোগান্তি সহনীয় পর্যায়ে আনা সম্ভব। সেজন্য রাষ্ট্র ও সরকারের দায়িত্বশীল সংস্থাগুলোকে আন্তরিক হতে হবে। রাজধানীর খোঁড়াখুঁড়ির অচলাবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে এলাকাভিত্তিক জনসাধারণকে সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে তদারকি ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। নির্মাণকাজের তদারকির মাধ্যমে কাউন্সিলরদের জনদুর্ভোগ ও জনভোগান্তি কমানোর যে উদ্যোগগুলো নেওয়ার কথা, সেগুলো প্রায় অনুপস্থিত। অথচ স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন, ২০০৯ অনুসারে জনভোগান্তি কমাতে সেবা ও সড়ক নির্মাণকারী সংস্থাগুলো অর্থবছরের শুরুতেই কর্মপরিকল্পনা জমা দেবে সিটি করপোরেশনে। অনিবার্য প্রয়োজন ছাড়া বর্ষায় সংস্কার ও মেরামত বন্ধ রাখা এবং অযোগ্য ঠিকাদারদের কালো তালিকাভুক্ত করা ও জনদুর্ভোগ সৃষ্টিকারীদের আইনের আওতায় আনা প্রয়োজন।

‘ঢাকা নগর পরিবহন’ নামে একটি সেবা চালু করার প্রস্তাব ছিল। আংশিকভাবে তা চালু হয়েছেও। তবে পুরোপুরি চালু করা গেলে সার্বিকভাবে সুফলভোগী হতো নগরবাসী। ঢাকায় এমনকি অন্যান্য নগর-শহরের যানজটের কারণগুলো অচিহ্নিত নয়। এর নিরসনে উদ্যোগ-আয়োজনও কম নয়। কিন্তু এত কিছুর পরও সুফল দৃশমান হচ্ছে না। কেন হচ্ছে না এ আলোচনা এ নিবন্ধেই করা হয়েছে। ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি, পরিকল্পিত পরিকল্পনায় ঘাটতি এবং যেকোনো একটি বা দুটি মাধ্যমের ওপর নির্ভর করে সার্বিক যোগাযোগব্যবস্থার সংহত রূপ যাচাই করা সমীচীন হবে না। পরিকল্পিত নগরায়ণসহ সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার সংহত আশানুরূপ চিত্র এত ব্যবস্থার পরও কেন নিশ্চিত নয়, এর কারণ বিশ্লেষণ করে মনোযোগ দিতে হবে সংকটের উৎসে। এমন এক সময় আসন্ন যখন আমাদের প্রশ্ন করতে হবে, ২ কোটি মানুষের মহানগরীতে কেমন গণপরিবহন চলে? এর সদুত্তর আমরা আজও খুঁজে পাইনি। কিন্তু জনস্বার্থে উত্তর অনুসন্ধান জরুরি।

  • নগর ও যোগাযোগ পরিকল্পনাবিদ। নির্বাহী পরিচালক, আইপিডি ও অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা