সমাজ
রোকেয়া ইসলাম
প্রকাশ : ২৯ মার্চ ২০২৪ ১৪:১৯ পিএম
৫৪তম স্বাধীনতা
দিবস উদযাপনের মধ্য দিয়ে ৫৩ বছরের স্বাধীন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন দাঁড়ায়, আমাদের
উন্নয়ন-অগ্রগতির সড়ক অনেক চওড়া হয়েছে বটে কিন্তু মানবিক উন্নয়ন কতটা ঘটেছে? সমাজের
গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রতিষ্ঠান আছে এর মধ্যে পরিবার এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অগ্রগণ্য।
একটি শিশু জন্মগ্রহণ করে পর্যায়ক্রমে বেড়ে ওঠার প্রেক্ষাপটে অনেকগুলো অনুষঙ্গ তার জীবনের
সঙ্গে জড়িয়ে যায়। একটি শিশু যখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রথম প্রবেশ করে তখন পর্যায়ক্রমে
সে সবগুলো স্তর পাড়ি দিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে শিক্ষাপর্ব সম্পন্ন করে উচ্চশিক্ষা
প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। কিন্তু আমরা দেখছি, মাধ্যমিক পর্যায় থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষা
প্রতিষ্ঠানে নানা স্তরে নিরাপত্তাহীনতার ছায়া ক্রমেই প্রলম্বিত হচ্ছে। মানবিক গুণসম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার পেছনে নানামুখী
অন্তরায় সৃষ্টি হচ্ছে। এই অন্তরায়ের অনুষঙ্গ যখন শিক্ষক নামে সমাজের সর্বজন শ্রদ্ধেয়
ব্যক্তিদের কেউ কেউ অর্থাৎ শিক্ষকরা শিক্ষার্থীর জীবনে হুমকি হয়ে দাঁড়ান তখন প্রত্যাশার
নাভিকেন্দ্রে পেরেক পড়ে। দুঃখজনক হলেও সত্য, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন স্তরের কোনো
কোনো শিক্ষক যেভাবে নেতিবাচক অর্থে সংবাদ শিরোনাম হচ্ছেন তখন প্রতীয়মান হয়; অবক্ষয়ের
ছায়া যেন সর্বগ্রাসী হয়ে উঠছে। দূর অতীত না হয় বাদই দিলাম, সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া কয়েকটি
ঘটনা এরই সাক্ষ্য বহন করছে।
ভিকারুননিসা নূন
স্কুল এন্ড কলেজের আজিমপুর শাখায় কিছুদিন আগে শিক্ষক কর্তৃক একজন শিক্ষার্থীর যৌন নিপীড়নের
ঘটনাটি তোলপাড় সৃষ্টি করে। এর রেশ কাটতে না কাটতেই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী
অবন্তিকার আত্মহনন ফের মর্মস্পর্শী বার্তা দেয়। শিক্ষক নামের কতিপয় নিপীড়ক কীভাবে শিক্ষাঙ্গন
কলুষিত করছেন অবন্তিকার স্বেচ্ছামৃত্যুর পথ বেছে নেওয়া তা-ই পুনর্বার সামনে নিয়ে এসেছে।
ভিকারুননিসা নূন স্কুল এন্ড কলেজ এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটনার প্রেক্ষাপট একই।
মাধ্যমিক পর্যায়ের একজন নারী শিক্ষার্থী শেষ পর্যন্ত মুখ খুলে প্রতিবাদ জানিয়েছেন।
আর উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একজন শিক্ষার্থী আত্মহননের মধ্য দিয়ে প্রতিবাদ জানিয়ে গেছেন।
ইতোমধ্যে দুটি ঘটনার ক্ষেত্রেই অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে
এবং দুটি ঘটনারই বিচারপ্রক্রিয়া চলমান। এমন ঘটনা ইতঃপূর্বেও ঘটেছে এবং নানা মহল থেকে
সঙ্গতই বলা হয়েছে, আগের ঘটনাগুলো যথাযথ প্রতিকার-প্রতিবিধান নিশ্চিত হয়নি বিধায়ই পরবর্তী
মর্মস্পর্শী ঘটনাগুলোর মুখোমুখি আমাদের হতে হয়েছে।
শিক্ষাক্ষেত্রে
নারী শিক্ষার্থীর হার তুলনামূলকভাবে এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি হলেও তাদের পথটা যে মোটেও
মসৃণ নয় এরই মর্মন্তুদ নজির উল্লেখিত ঘটনাগুলো। বিগত কয়েক মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ
দেশের আরও কয়েকটি উচ্চ বিদ্যাপীঠে যৌন নিপীড়ন-নির্যাতনের ঘটনা সংবাদমাধ্যমেই উঠে এসেছে
এবং এর প্রায় প্রত্যেকটির সঙ্গে শিক্ষকসহ সমাজবিরোধীদের যোগসাজশের অনাকাঙ্ক্ষিত খবরও
জানা গেছে। ফেনীর সোনাগাজীতে অধ্যক্ষের যৌন লালসার শিকার সেই নারী মাদ্রাসাশিক্ষার্থী
অগ্নিদগ্ধ হয়ে জীবনাবসানের মধ্য দিয়ে কর্দযতার যে ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছিল তা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান
তো বটেই, সামগ্রিকভাবে অন্ধকারের গ্রাসে নিমজ্জিত সমাজের অবয়বটাই স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান
হয়। দৃষ্টান্ত অনেক দেওয়া যায়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, একের পর এক ঘটনা ঘটছে এরপর কিছুদিন
সংবাদ ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঝড় বয়ে যায়, সামাজিক প্রেক্ষাপটে কিছু কর্মসূচি পরিলক্ষিত
হয়, সরকারের তরফে প্রতিকারের অঙ্গীকার-প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত হয় একপর্যায়ে বিস্ময়করভাবে
সবকিছু থেমে যায় কেন! বিরতিতে আবার ঘটে ঘটনা। এই বাস্তবতা শুধুই কি মূল্যবোধের অবক্ষয়?
অনেকেরই ধারনা, রাষ্ট্র ও সামাজিক শক্তির নানা রকম ব্যর্থতার কারণেই এই জনপদ ক্রমেই
বন্যদের চারণভূমি হয়ে উঠছে। মানবতা ও সভ্যতার উৎকর্ষকালে এমনটি কোনোভাবেই মেনে নেওয়া
যায় না।
কয়েক দিন ধরে
সংবাদমাধ্যমে ঢাকাসহ সারা দেশে কিশোর গ্যাংয়ের দাপটের যে চিত্র উঠে এসেছে তাও শুভবোধসম্পন্ন
যেকোনো মানুষকে উদ্বিগ্ন না করে পারে না। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পুলিশ অভিযান
চালিয়ে কিশোর গ্যাংয়ের বেশ কিছু সদস্যকে আটক করার পর এর উৎসে অনুসন্ধান চালাতে গিয়ে
উঠে এসেছে আরও ভয়াবহ চিত্র। সংবাদমাধ্যমেই জানা গেছে, বিপথগামী এই কিশোরদের নিজের হীনস্বার্থ
চরিতার্থকরণে প্রতিপালন করেন কতিপয় জনপ্রতিনিধি, স্থানীয় রাজনীতিক এবং সমাজের ‘বড়ভাই’
হিসেবে কথিত বলবানরা। কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাত নতুন কিছু নয়। এরা নানা রকম অপরাধে জড়িয়ে
শান্তিপ্রিয় মানুষের জীবনযাপন তটস্থ করে তোলে। এলাকাভিত্তিক দখলদারত্বসহ খুনখারাবির
মতো ভয়াবহ অপরাধও এরা ঘটিয়ে থাকে। ভুক্তভোগীরা অনেকে বলবানদের ভয়ে মুখ খোলার সাহস পান
না, যেমনটি পান না শিক্ষাঙ্গনের অনেক নারী শিক্ষার্থীও। একদিকে লোকলজ্জার ভয় অন্যদিকে
নিরাপত্তাহীনতাসহ আরও বহুমাত্রিক শঙ্কা তাদের তাড়া করে। প্রশ্ন হচ্ছে, শিক্ষক, রাজনীতিক
কিংবা জনপ্রতিনিধি পরিচয়ে এই তথাকথিতদের নিয়ে আমরা কী করব? কিশোর গ্যাংয়ের বিস্তৃতির
পেছনে অভিভাবকদের দায় এড়ানোর পথ নেই। আমাদের পারিবারিক সম্পর্কে ক্রমেই ফাটল ধরছে এবং
হীনস্বার্থের ছায়া সেখানেও প্রলম্বিত হচ্ছে। শিক্ষাক্ষেত্রে যে অবক্ষয়ের ছায়া দৃশ্যমান
তা নিয়ে অধ্যায়ের পর অধ্যায় লেখা যাবে। অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষাদানের মতো মহৎ অঙ্গীকার
বাণিজ্যের লালসায় ডুবেছে। যেখানে মেধার চেয়ে অর্থের জোর বেশি সেই সমাজে মানুষ অর্থের
পেছনে ছুটবে এবং একজন তার কাতারে আরও পাঁচজনকে টানবে এটাই তো স্বাভাবিক। নীতি-নৈতিকতা,
ন্যায়-অন্যায়, দায়িত্বভার, মূল্যবোধ সবকিছু ক্রমেই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের
প্রধানদের অনেকেই তা মাধ্যমিক পর্যায় থেকে শুরু করে একদম বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত অনিয়ম-দুর্নীতিতে
আকণ্ঠ নিমজ্জিত। শিক্ষা যদি হয় জাতির মেরুদণ্ড তাহলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতির বিকাশের
উর্বর জমিন এবং শিক্ষকরা সেই মেরুদণ্ড গড়ার অন্যতম প্রধান শক্তি তা অনস্বীকার্য। যৌন
নিপীড়ন ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে শিশু থেকে বয়স্ক নারী অনেকেই এর শিকার। শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই
নয়, প্রায় প্রত্যেকটি পেশায়ই যেন নৈতিকতা-মূল্যবোধে ধস নেমেছে। একসময় মনে হতো অবক্ষয়ের
চোরা স্রোত বয়ে যাচ্ছে আমাদের সমাজে। বিদ্যমান বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে এখন মনে হয় চোরাস্রোত
নয়, রীতিমতো প্লাবনের ন্যায় অবক্ষয় ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে গোটা সমাজটাকেই। আমরা জানি না
এর শেষ কোথায়? তবে সরকার তো বটেই সংশ্লিষ্ট কোনো পক্ষেরই এর দায় এড়ানোর অবকাশ খুব
ক্ষীণ।
সমাজে নীতি-নৈতিকতার
ব্যাপক অভাব একই সঙ্গে অধঃপতন বিদ্যমান বাস্তবতার প্রেক্ষাপট বহুল আলোচিত বিষয়। সরকারি
বিভাগ, সংস্থা কিংবা সংগঠনগুলোর অসাধু দায়িত্বশীলদের অনিয়ম-দুর্নীতির দোর্দণ্ড প্রতাপের
কথা সচেতন মানুষমাত্রেই জানা। কিন্তু নীতিনিষ্ঠতার বিপরীতে অনিয়ম-অনৈতিকতা যেভাবে ক্রমেই
সমাজকে গ্রাস করছে এর বিরূপ ফল বহুমুখী হতে বাধ্য। অনেকেই বলেন, সামাজিক এই অবক্ষয়ের
জন্য প্রধানত দায়ী আমাদের বিদ্যমান রাজনীতি, রাজনৈতিক নেতৃত্ব। এই বক্তব্য যে অমূলক
তাও বলা যাবে না। কথায় আছে, মাছের পচন শুরু হয় মাথা থেকে। এ কথাও স্বীকার্য, সমাজের
পচন শুরু হয় শীর্ষ থেকে। আমরা অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে সেই পরিস্থিতির শিকার। আমাদের অর্থনীতির
আকার অনেক বড় হয়েছে, নানা সূচকে সমাজের অগ্রগতি লক্ষণীয়, বহির্বিশ্বে আমরা কোনো কোনো
ক্ষেত্রে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবেও পরিচিত। কিন্তু এর মধ্যেও উল্লেখিত বিষয়গুলো যেন
প্রদীপের নিচের অন্ধকারের মতো। উন্নয়নকে যথাযথ অর্থবহ করতে হলে অনাচার-দুরাচার-কদাচার
এবং দুর্নীতির ছায়া সরিয়ে সুনীতির আলো ছড়িয়ে দিতে হবে। আমরা বিশ্বাস করি, সুনীতি-সুশাসনের
আলো ছড়ালে তা সামাজিক অবক্ষয়ের প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করবে।
অবন্তিকারা দুঃসময়ের
দুঃসহ স্মারক। অবন্তিকাদের লড়তে হচ্ছে কতিপয় লম্পট সহপাঠী ও শিক্ষক নামের অমানুষের
বিরুদ্ধে। তবে একটি কথা মনে রাখা উচিত, আত্মহত্যা কোনো সমাধান নয়, নিশ্চয়ই প্রতিবাদ-প্রতিরোধ
সমাধানের মোক্ষম শক্তি। পারিবারিক অনুশাসনের দিকে যেমন জোর দিতে হবে তেমনি জনপ্রতিনিধি
নির্বাচন থেকে শুরু করে শুধু শিক্ষকই নন, সব ক্ষেত্রে নিয়োগের ব্যাপারেই মনোযোগ গভীর
করতে হবে। অনাচারী-দুরাচারী কেউ যেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কিংবা যেকোনো পর্যায়ে তাদের উপস্থিতি
টিকিয়ে রাখতে না পারে এ জন্য সরকারসহ সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সব পক্ষকে নির্মোহ অবস্থান
নিতে হবে। সামাজিক সুস্থতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি সমাজ বিনির্মাণের জন্য অবক্ষয় প্রতিরোধে
গড়ে তুলতে হবে সামাজিক আন্দোলন। সরকারকে ন্যায়বিচার নিশ্চিতকল্পে নিতে হবে দৃঢ় অবস্থান।
রাজনীতিকদের দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করাও সমভাবেই গুরুত্বপূর্ণ। কর্মজীবন থেকে ব্যক্তিজীবনের সব পর্যায়ে সততা, নৈতিকতা, মানবিকতা ও পরমতসহিষ্ণুতার চর্চা বাড়াতে হবে। অপরাধী যে-ই হোক তার কোনো রাজনৈতিক কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয় থাকতে পারে না, সে অপরাধী হিসেবেই সরকারের দায়িত্বশীল সব মহলের কাছে চিহ্নিত হবে-এটিই স্বাভাবিক। আশাবাদী হতে চাই, আশাবাদী থাকতে চাই। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তো বটেই সমাজের সব স্তরে, সব পর্যায়ে সুনীতির অনুশীলনে প্রজন্মকে পরিশীলিত করতে হবে। এর দায় কমবেশি আমাদের সবার।