সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়
প্রকাশ : ২৮ মার্চ ২০২৪ ১১:০৯ এএম
‘নদীর তীরে বাঁধা
জীবন’ শিরোনামে গত বছর ফেব্রুয়ারিতে প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর সচিত্র প্রতিবেদনটি প্রাসঙ্গিক
কারণেই আবার পর্যালোচনায় এসেছে। নদ-নদীর ভাঙাগড়া ও জেগে ওঠা চরেও মানুষ কীভাবে স্বপ্ন
বুনে, জীবনজীবিকার ছক তৈরি করে; পদ্মা নদীতে জেগে ওঠা শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার চরাত্রা
চরবাসীর এবং এর আশপাশের মানুষের যে জীবনযাপন চিত্র উঠে এসেছিল ওই প্রতিবেদনে তা আজকে
আমাদের সম্পাদকীয়র সঙ্গে সামঞ্জস্যতার যোগসূত্র তৈরি করে। কুমিল্লার প্রধান নদী গোমতীর
দুই তীরের চরাঞ্চল জেলার শস্যভান্ডার হিসেবে পরিচিতি পেলেও তা এখন ভোগবাদীদের লালসায়
স্বপ্নের অপমৃত্যু ঘটাচ্ছে। গতকাল বুধবার প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ ‘ভূমিখেকোদের দৈরাত্ম্যে
বিলীন গোমতীর চরাঞ্চল’ শিরোনামের প্রতিবেদেনে যে চিত্র উঠে এসেছে তা দেশের অন্যান্য
নদ-নদী এবং জেগে ওঠা চরে ভূমিখেকোদের আগ্রাসী থাবা থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। গোমতীর
দুই তীরের চরাঞ্চলে বছরব্যাপী ফসল ফলানোর যে স্বপ্ন দেখতেন কৃষক সেই স্বপ্ন এখন দুঃস্বপ্নে
পরিণত হয়েছে, সেখান থেকে রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের মাটি কেটে বিক্রি করার কারণে। এর ফলে
একদিকে যেমন প্রায় বিনষ্ট হয়ে পড়েছে শস্য উৎপাদনের ক্ষেত্র তেমনি অভিঘাত লেগেছে গোমতীর
প্রতিরক্ষা বাঁধেও। আর এর পাশাপাশি বায়ু ও শব্দদূষণের বিরূপ প্রভাবে নদীর পারের মানুষের
জীবনযাপন হয়ে পড়েছে বিপর্যস্ত।
নদ-নদী ঘিরে প্রতিদিনের
বাংলাদেশ-এর প্রত্যয় সুনির্দিষ্ট। সপ্তাহজুড়ে ফিচার পাতার নাম নদ-নদীর নামানুসারে করার
মধ্য দিয়ে নদ-নদীর সুরক্ষায় আমাদের অঙ্গীকার ব্যক্ত হয়েছে। নদ-নদীতে চর জেগে এবং সমান্তরালে
বলবানদের দখল আর দূষণে দেশের অনেক নদ-নদীর প্রাণ ওষ্ঠাগত। জেগে ওঠা চর নদীর স্বাভাবিক
গতিপথে বিঘ্ন ঘটানোর পাশাপাশি তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছিনিয়ে নেয়। চর জেগে ওঠার কারণ
সচেতন মানুষের অজানা নয়। যথাযথ নদীশাসনের ক্ষেত্রে ঘাটতি কিংবা দায়িত্বহীনতার কারণেই
মূলত এর উদ্ভব ঘটে। কিন্তু নদ-নদীতে জেগে ওঠা চরও কোনো কোনো ক্ষেত্রে জীবন-জীবিকা এবং
কৃষি উৎপাদনে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে এমন নজিরও আমাদের সামনে অনেক আছে। গোমতীর দুই তীর
এরই নজির সৃষ্টি করেছিল।
দখল কিংবা নদীর
তীরবর্তী স্থান থেকে মাটি কেটে নেওয়া, বিধিমালা লঙ্ঘন করে নদী থেকে বালু উত্তোলন,
একই সঙ্গে নদ-নদীর জেগে ওঠা চরে ভূমিদস্যুদের ভোগের দৃষ্টি নতুন কিছু নয়। আমরা জানি,
পরিবেশ-প্রতিবেশের ওপর আঘাত সৃষ্টিসহ নদ-নদীর সার্বিক অবস্থা অধিকতর ঝুঁকির মুখে ঠেলে
দিতে ভূমিখেকো সামাজিক কিংবা রাজনৈতিক বলবান ব্যক্তি বা মহলবিশেষের অপতৎপরতা চলেই আসছে।
গোমতীর দুই তীরে যাদের আগ্রাসী থাবা পড়েছে তাদের নাম উঠে এসেছে প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর
অনুসন্ধানে। এরপরও প্রতিকারে দায়িত্বশীল অজুহাতই শ্রুত হয় কি না, এই প্রশ্ন থাকে।
গোমতীর দুই তীর
যারা খুবলে খেয়ে নিজেদের আখের গোছাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে স্থানীয়দের প্রতিবাদ করার সাহস
নেই। এ ব্যাপারে কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর
প্রতিবেদকের কাছে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা সেই গতানুগতিক দায়সারা গোছের। তিনি বলেছেন,
‘গোমতীর আমতলী অংশে কিছু ব্যক্তিমালিকানাধীন জমিতে শর্ত সাপেক্ষে মাটি কাটার অনুমতি
দেওয়া হয়েছে।’ প্রশ্ন হচ্ছে, শর্তের ব্যত্যয় ঘটিয়ে গোমতীর দুই তীরে ভূমিখেকোদের মাটি
লুণ্ঠনের যে মহোৎসব চলছে তা তাদের দৃষ্টিসীমার বাইরে থাকছে কী করে!। কুমিল্লা পানি
উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলীর প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর প্রতিবেদকের কাছে দেওয়া
বক্তব্যও সেই যেন গৎবাঁধা। আমরা মনে করি, সংশ্লিষ্ট কোনো পক্ষই এর দায় এড়াতে পারে না।
একসময়কার অনেক
খরস্রোতা নদীই এখন মৃতপ্রায়। ওই সব নদ-নদীতে পানিপ্রবাহের যে স্পন্দন ছিল তা এখন আর
নেই। অনেক নদ-নদীই টিকে আছে মাত্র রেখাচিহ্নে। আবার কোনো কোনোটি হারিয়ে কালের সাক্ষী
হয়ে আছে। নদ-নদীর নাব্য রক্ষায় নদীশাসনের অনেকগুলো অনুষঙ্গ রয়েছে। এর মধ্যে নিয়মিত
নদী খনন করে পানিপ্রবাহের পথ প্রতিবন্ধকতাহীন রাখা অন্যতম। আমরা জানি, নদীতে জেগে ওঠা
চর সম্ভাব্য ক্ষেত্রে খননের মাধ্যমে অপসারণ করে নদীর গতিপথ মসৃণ রাখা কিংবা যেক্ষেত্রে
এর উপযুক্ততা হারিয়ে গেছে সেসব চর কৃষি উৎপাদনব্যবস্থায় সংযুক্ত করার ভাবনা ছিল। এর
বাস্তবায়নে কতটা কী হয়েছে সেই প্রশ্ন যদি আমরা উত্থাপন না-ও করি, সৃষ্ট নতুন পরিস্থিতিতে
ভূমিখেকোদের কারণে নদ-নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধের সুরক্ষাসহ প্রতিবেশ-পরিবেশের ওপর যে অভিঘাত
ক্রমেই প্রকট হয়ে উঠছে এ ব্যাপারে দায়িত্বশীলরা তাদের দায়িত্ব পালনে কতটা নিষ্ট এই
প্রশ্ন আমরা রাখি। কোনো শক্তিবলে প্রশাসনের নাকের ডগায় রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে বলবানরা
ক্ষতের ওপর ক্ষত সৃষ্টি করছেন? এসব দেখভালের দায়দায়িত্ব যাদের তারা উটপাখির মতো বালুতে
মুখ গুঁজে আছেন, এ-ও বিস্ময়কর বৈকি। প্রশ্ন হচ্ছে, গোমতীর দুই পার কি ভূমিখেকোদের উদরপূর্তির
ক্ষেত্র হয়েই থাকবে?
নদ-নদী বাংলাদেশের
প্রাণ। উচ্চ আদালত নদ-নদীকে জীবন্ত সত্তা হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন। রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ
দাশ তার ‘নদী’ কবিতায় বলেছেন, ‘…হাজার বছর ধরে নদী তবু পায় কেন এইসব? শিশুর প্রাণে/
নদী কেনো বেঁচে থাকে? একদিন এই নদী শব্দ করে হৃদয়ে বিস্ময়/ আনিতে পারে না আর; মানুষের
মন থেকে নদী হারায়, শেষ হয়’। কবি তার কাব্যপঙক্তির মধ্য দিয়ে যা বলতে চেয়েছেন, তা আমাদের
অবোধগম্য নয়। পানিপ্রবাহের জটিলতার পাশাপাশি মনুষ্যসৃষ্ট অপরিণামদর্শী কর্মকাণ্ডও যে
নদ-নদীর মৃত্যুর কারণ এর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ নতুন করে নিষ্প্রয়োজন। বাংলাদেশের প্রাণ
নদীপথ অর্গলমুক্ত করার পাশাপাশি জেগে ওঠা চর অপসারণ করে কিংবা যেসব ক্ষেত্রে তা সম্ভব
নয়। সেসব ক্ষেত্রে চর কীভাবে উৎপাদন ব্যবস্থায় ব্যবহৃত করা যায় এর পরিকল্পিত পরিকল্পনা
এবং বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। ভূমিখেকোদের লোভের আগ্রাসনে নদীর চর কিংবা নদী
তীরের ভূমি তাদের ভোগে যাতে না লাগে এ ব্যাপারে নির্মোহ অবস্থান নিতে হবে। প্রতিরক্ষা
বাঁধের সুরক্ষার ব্যাপারেও যথাপযুক্ত উদ্যোগ সমভাবেই গুরুত্বপূর্ণ।
গোমতীর দুই তীরে
যে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি দৃশ্যমান এমনটি আরও অনেক স্থানেই বিদ্যমান। আমাদের দাবি,
ভূমিখেকোদের থাবা গোটাতে কালক্ষেপণ না করে যথাপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হোক। অস্তিত্বের
ওপর আঘাতকারীদের কোনোরকম অনুকম্পা দেখানো চলবে না। এ ব্যাপারে এ পর্যন্ত কথা হয়েছে
বিস্তর কিন্তু কাজের কাজ সেভাবে কিছুই হয়নি। গোমতীর তীর থেকে অনতিবিলম্বে কাজের কাজটি
শুরু হোক।