সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়
প্রকাশ : ২৭ মার্চ ২০২৪ ১০:১৪ এএম
‘৫৩ বছরেও সংরক্ষণ
হয়নি যে বধ্যভূমি’ শিরোনামে ২৬ মার্চ প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ প্রকাশিত প্রতিবেদনটি একই
সঙ্গে বেদনাদায়ক ও দুঃখজনক। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালে বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জে
জিউধরা ইউনিয়নের লক্ষ্মীখালী গ্রামে শ্রীধাম গোপালচাদ সাধু ঠাকুরের সেবাশ্রমে রাজাকাররা
১৮০ জনকে গুলি ও জবাই করে গণহত্যা চালিয়েছিল। সেদিনের স্মৃতি মানুষকে আজও কাঁদালেও
স্বাধীনতার ৫৩ বছরে শহীদদের স্মৃতিবিজড়িত বধ্যভূমিটি সংরক্ষণ করা হয়নি। শুধু বাগেরহাটের
মোরেলগঞ্জের বধ্যভূমিই নয়, সারা দেশে এমন হাজারো বধ্যভূমি অযত্ন-অবহেলায় সংরক্ষণের
অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে। সারা বছর বধ্যভূমি, গণকবর নিয়ে কথাবার্তা শোনা না গেলেও, নির্ধারিত
কয়েকটি জাতীয় দিবস এলেই সবাই বিষয়গুলো নিয়ে নড়েচড়ে বসে। স্বাধীনতার এই পাঁচ দশক পরে
এসেও প্রতিবছর সংবাদমাধ্যমে নির্ধারিত দিবসের আগে আগে বধ্যভূমি ও গণকবরের স্থান সংরক্ষিত
না হওয়াসহ নানান বেদনাদায়ক খবর প্রকাশ পায়।
আমরা স্বাধীনতার
৫৪ বছরে পদার্পণ করেছি। বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো আমাদের আজকের বাংলাদেশ
যে আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত, যাদের ত্যাগ ও তিতিক্ষার বিনিময়ে পাওয়া, তাদের স্মৃতি
অবহেলিত থাকতে পারে না। তাদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনে ঘাটতি থাকার কথা না। অথচ
তাই হচ্ছে। আমাদের বারবার সে রকম খবর প্রত্যক্ষ করতে হচ্ছে। ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এ দেশের নিরীহ বাঙালিদের বধ্যভূমিতে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা
করেছে। শহীদদের স্মৃতি ধরে রাখতে এবং পরবর্তী প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস
জানানোর জন্য বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে ২০০১
সালে দেশের সব বধ্যভূমি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এরপর গত দুই যুগে দেশে কয়েকশ বধ্যভূমি
চিহ্নিত হলেও তা যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা হয়নি। আওয়ামী লীগ সরকার ২০১৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর
দেশে চিহ্নিত ২৮১টি বধ্যভূমি সংরক্ষণের জন্য ৪৪২ কোটি ৪০ লাখ টাকার প্রকল্প জাতীয় অর্থনৈতিক
পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) অনুমোদন করে। এ লক্ষ্যে সরকার ‘১৯৭১-এ মহান মুক্তিযুদ্ধকালে
পাকিস্তান হানাদার বাহিনী কর্তৃক গণহত্যার জন্য ব্যবহৃত বধ্যভূমি সংরক্ষণ ও স্মৃতিস্তম্ভ
নির্মাণ’ শীর্ষক প্রকল্প গ্রহণ করে। প্রকল্প অনুযায়ী দেশজুড়ে চিহ্নিত বধ্যভূমিগুলো
সংরক্ষণ ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২১ সালের জুনে। কিন্তু কয়েক দফা
মেয়াদ বাড়ানোর পর প্রকল্প বাস্তবায়ন করার সময় ধরা হয় ২০২৩ সালের জুনে। কিন্তু বর্ধিত
এই সময়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন কাজ তো শেষ হয়ইনি, প্রকল্পের অগ্রগতিও সন্তোষজনক নয়। প্রকৃতপক্ষে
কাজের কাজ কতটা হয়েছে, সে প্রশ্ন তোলা বাহুল্য। কারণ সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন বলছে,
নির্ধারিত সময় পেরোলেও শেষ হয়েছে মাত্র ৩৫টি বধ্যভূমি সংরক্ষণ ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের
কাজ। কিন্তু ইতোমধ্যে খরচ হয়ে গেছে কয়েকশ কোটি টাকা।
টানা চার মেয়াদে
যেখানে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায়, সেখানে এত দিনেও
বধ্যভূমিসমূহ সংরক্ষণ ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণকাজ শেষ করতে না পারা দুঃখজনক। একই সঙ্গে
বেদনাদায়ক এখনও আমাদের বধ্যভূমি-গণকবরের প্রকৃত সংখ্যা নির্ণিত না হওয়া। মুক্তিযুদ্ধে
সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধ, গণহত্যা ও নির্যাতন নিয়ে গবেষণা করা ওয়ার ক্রাইমস অ্যান্ড
ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটি তাদের একটি জরিপের প্রতিবেদনে জানিয়েছে, দেশে পাঁচ হাজার বধ্যভূমির
অস্তিত্ব রয়েছে। এর মধ্যে তারা ৯৪২টি বধ্যভূমি শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছে। আবার ২০১৭
থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত দেশের ৩৮ জেলায় ৮০৭টি বধ্যভূমি চিহ্নিত করে খুলনায় স্থাপিত গণহত্যা-নির্যাতন
আর্কাইভ ও জাদুঘর ট্রাস্ট। তাতে বধ্যভূমি, গণকবর, টর্চার সেলসহ গণত্যার অন্যান্য বিষয়
নিয়ে ১৮ হাজার ৯৫৬টি স্মৃতিচিহ্ন শনাক্ত করা হয়েছে। বাকি জেলাগুলোর জরিপ শেষে দেশে
বধ্যভূমির সংখ্যা দেড় হাজার ছাড়াবে বলে জাদুঘরসংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। অন্যদিকে সংবাদমাধ্যমে
সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের মহাসচিব বীর মুক্তিযোদ্ধা হারুন হাবীব বলেছিলেন, ‘দেশে প্রায়
চার হাজার বধ্যভূমি রয়েছে।’ সব মিলিয়ে বধ্যভূমি ও গণকবরের প্রকৃত সংখ্যা এখনও অজানা।
তবে এই সংখ্যা যেমন নির্ণিত হওয়া প্রয়োজন তেমনি প্রয়োজন প্রতিটি বধ্যভূমি ও গণকবর যথাযথভাবে
সংরক্ষণ করা। মুক্তিযুদ্ধের এত বছর পেরিয়ে এলেও বধ্যভূমিগুলো চিহ্নিত ও সংরক্ষিত না
হওয়া বেদনার। বধ্যভূমিগুলো আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
সারা দেশে অচিহ্নিত
অনেক বধ্যভূমি যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে চিহ্নিত বধ্যভূমিও। অবহেলা, অনাদর আর সংরক্ষণ
ও পরিচর্যার অভাবে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহ যেন হারিয়ে না যায়, সেজন্য
স্থানগুলো সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি সারা দেশের চিহ্নিত বধ্যভূমিগুলোর
স্মৃতিফলক বা স্থাপনা যেন ধ্বংস না হয়, সেদিকটিও নিশ্চিত করে স্থানগুলো যথাযথভাবে সংরক্ষণ
জরুরি। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন ও বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষণের উদ্যোগ না নিলে তা যেমন
আমাদের ইতিহাসবিমুখতার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করবে, তেমনি পরবর্তী প্রজন্মের কাছেও অজানা
থাকবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। বর্তমান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সরকারের উদ্যোগে দেশের বধ্যভূমিগুলো
সংরক্ষণ হবে এবং স্মৃতিফলক স্থাপনে সকল ধরনের প্রতিবন্ধকতা দূর হবে বলে আমরা প্রত্যাশা
করি। বধ্যভূমি সংরক্ষণের চেষ্টা ধীরগতিতে বাস্তবায়িত হলে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত
অনেক স্থাপনাই নষ্ট হয়ে যাবে। কালের গর্ভে হারিয়ে যাবে। কোথাও কোথাও স্থানগুলো বেহাতও
হয়ে যেতে পারে। তাই আমরা বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষণে জোর তাগিদ যেমন দিই, তেমনি এসব বধ্যভূমিতে
প্রতিটি ঘটনার বর্ণনাসহ স্মৃতিফলক স্থাপনের ওপরও জোর দিই। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ভবিষ্যৎ
প্রজন্মকে জানাতে চিহ্নিত সব বধ্যভূমি সংরক্ষণ করা উচিত। সেই সঙ্গে অযত্ন, অবহেলা ও
সংরক্ষণের অভাবে বেদখল হয়ে যাওয়া বধ্যভূমি উদ্ধারেরও দাবি জানাই। আমরা মনে করি, মুক্তিযুদ্ধের
স্মৃতিবিজড়িত বধ্যভূমিগুলোর সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে স্থানগুলো মুক্তিযুদ্ধ চর্চা
কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব হলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছড়িয়ে দেওয়া সহজ হবে।