স্বাধীনতা দিবস
আব্দুল বায়েস
প্রকাশ : ২৬ মার্চ ২০২৪ ১৪:৩১ পিএম
‘…মাঝমধ্যেই
আমরা প্রলুব্ধ হয়ে ভুল পথে এগিয়ে গেছি, কিন্তু তার মধ্যে ঠিক পথে যেটুকু এগিয়ে যাই তা যেন হারিয়ে
না ফেলি। এখনও বহুপথ বাকি’Ñঅমর্ত্য সেন
(জীবনযাত্রা ও অর্থনীতি)।
সদানন্দ ধুমের নামে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের এক সাংবাদিকের
২০১০ সালে দেওয়া মন্তব্য এখনও কানে বাজেÑ‘প্রায়
চল্লিশ পূর্বে,
একমাত্র একজন অসংযত আশাবাদী অপেক্ষাকৃত স্থিতিশীল এবং
সমৃদ্ধ পাকিস্তানের বিপক্ষে বন্যাপ্রবণ, যুদ্ধবিধ্বস্ত
বাংলাদেশের পক্ষে বাজি ধরত। কিন্তু
উঁচু প্রবৃদ্ধির হার, নিম্নগামী জন্মহার এবং আন্তর্জাতিক স্তরে
একটা অধিকতর প্রতিযোগিতামূলক অর্থনীতি নিয়ে বিগত বাস্কেট কেস হয়তো
শেষ হাসিটা দেবে।’ আসলে কি তাই
ঘটেছিল?
একাত্তরে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দিয়েছিলেন
স্বাধীনতার ডাক, দিয়েছিলেন সর্বশক্তি দিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করার
নির্দেশ। জানিয়েছিলেন চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান।
এরপর ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়। আজ আমাদের ৫৪তম
স্বাধীনতা দিবসে গঠনমূলক সমালোচনাসূচক মূল্যায়ন করি আমাদের অতীত, বর্তমানের কৃতিত্ব
ও ও ভবিষ্যতের লক্ষ্য নিয়ে।
দুই.
মনে আছে নিশ্চয়, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার
মাত্র কিছুদিন
পর বাংলাদেশ ঘিরে দুয়েকটা মর্মন্তুদ মন্তব্য সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্নকে সম্পূর্ণ বিনষ্ট করতে পারেনি তবে মসৃণ অগ্রগতির
আশায় চিড় ধরিয়েছিল। একটি হচ্ছে বাংলাদেশ নিয়ে হেনরি
কিসিঞ্জারের অপমানজনক মন্তব্য ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ এবং ইউসট ফাল্যান্ড ও জে পারকিনসনের কিছুটা সংবেদনশীল অথচ বিব্রতকর
বক্তব্যÑ‘বাংলাদেশে উন্নয়ন ঘটলে
পৃথিবীর কোনো দেশ উন্নয়ন ছাড়া থাকবে না’। অবশ্য
এর প্রায় তিন দশক পর ২০০৭ সালে ঢাকায় এসে বিআইডিএসের এক
সেমিনারে ‘উন্নয়নের টেস্ট কেস হাইপথেসিস পুনর্বিবেচিত’
শিরোনামে
এক প্রবন্ধে শোধরানোর সুরে তারা শুধালেন, প্রথম দিকে উন্নয়নের টেস্ট কেস হিসেবে ভেবে থাকেলও এখন আমাদের মনে হচ্ছে টেকসই
উন্নয়ন বাংলাদেশের হাতের নাগালের ভেতর, যদিও নিশ্চিত হতে অনেক
বাকি। ১৯৭২ সালে বিশ্বব্যাংক বলেছিল, এমনকি সবচেয়ে ভালো পরিবেশেও বাংলাদেশের উন্নয়ন একটা জটিল সমস্যা।
বাংলাদেশের উন্নয়ন নিয়ে শুরুতে হতাশার সুর শোনা গিয়েছিল তা
মূলত তিনটি ক্ষেত্রকে কেন্দ্র করে যথা : (ক) কৃষিক্ষেত্রে প্রযুক্তি প্রসারের ঘাটতি, বৈষম্যমূলক
কৃষি কাঠামো এবং তীব্র খাদ্য স্বল্পতা ও গণদারিদ্র্য, (খ) জনমিতিক জগতে নব্য ম্যালথুসিয়ান নিরাশা, নারীর নিচু শিক্ষা, সামাজিক বা পেশাগত অবস্থান ও
ভয়েস এবং
(গ) বাজার ব্যবস্থার দুর্বলতা, ব্যক্তি উদ্যোক্তার অভাব, দুর্বল রাষ্ট্রে দুর্বল
শিল্পনীতি,
প্রাথমিক পণ্যের আধিক্ষ্যে রপ্তানি হতাশা ইত্যাদি। উইনস্টন চার্চিল বলতেন, ভালো
সংকট অপচয় করতে নেই। আর আলেকজান্ডার গেরচেক্রেনের
মন্তব্য এ রকম–অনগ্রসরতা বাধা না হয়ে সুবিধাও হতে পারে। কে জানে, হয়তো অনগ্রসতা
এবং সংকটই বাংলাদেশের আশীর্বাদ হয়ে এসেছিল।
তিন.
তবে বলার অপেক্ষা রাখে না, আর্থসামাজিক অগ্রগতিতে বাংলাদেশের
বড় ধরনের ঘুরে দাঁড়ানোর ঘটনা ঘটে ২০১০ শতকের সময়কালে। যেমনÑনব্বইয়ের দশকের শুরুতে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিএনআই
পাকিস্তানের মাথাপিছু জিএনআইয়ের ৫৫ ভাগ ছিল অথচ ২০১০ দশকের শেষের দিকে পাকিস্তানের
চেয়ে ১০ শতাংশ বেশি বাংলাদেশের মাথাপিছু জিএনআই। অন্যদিকে, নব্বইয়ের দশকের শুরুতে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিএনআই
ছিল ভারতের ৮৭ শতাংশ, পার্থক্যটা
বৃদ্ধি পেয়ে ২০০০ দশকে দাঁড়ায় ৭৪ শতাংশ কিন্তু ২০১০ সালের শেষ দিকে হ্রাস পেয়ে ৮২
শতাংশ। শুনে কি মনে হচ্ছে না যে, এটা ক্যাচিং আপ ইন্ডিয়া সিন্ড্রোম!
চার.
বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী
বিনায়ক সেনের ধারণা, হতাশা থেকে সফলতার সঙ্গে আশায়
উত্তরণের বাংলাদেশের অভিযাত্রাকে মূলত দুটি পথে পরীক্ষা করা যেতে পারে। প্রথমত. এতদাঞ্চলের অন্যদের সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা যেমনÑ পাকিস্তান ও ভারতের সঙ্গে। দ্বিতীয় পথটি হচ্ছে পূর্ব জারিত /প্রত্যাশিত ও প্রকৃত ফলাফলের
তুলনামূলক বিচার-বিশ্লেষণ। বিচার-বিশ্লেষণ শেষে
আপাতদৃষ্টে এবং স্বাধীনতার পরবর্তী ভয়ংকর ভবিষ্যদ্বাণীর
প্রেক্ষিতে, বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন বিবরণী কারও কাছে আরব্য রজনির আখ্যান
মনে হতেই পারে।
প্রথমে ধরা যাক বাংলাদেশ বনাম পাকিস্তানের তুলনা। পাকিস্তান
আমলে বিচ্যুতি ছিল অগ্রগতিতে–পশ্চিম এগিয়ে ছিল আর পূর্ব অনেক পিছিয়ে। যার
ফলে স্বাধীন বাংলাদেশ। এখনও বিচ্যুতি লক্ষণীয়-বস্তুত বাড়ন্ত বিচ্যুতি–তবে এবার
উল্টো দিকে অর্থাৎ বাংলাদেশ অগ্রগামী পাকিস্তানের চেয়ে নানান নির্দেশকে। স্বাধীনতার
সময় প্রায় সব আর্থসামাজিক নির্দেশকে বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে পিছিয়েছিল; ২০১০
শতকের শেষে এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পাকিস্তানকে টপকে গেছে। বাংলাদেশ
বনাম ভারতের তুলনাটা এ রকম কিছু ক্ষেত্রে ছুঁইছুঁই, অন্য
ক্ষেত্রে এগিয়ে। যেমন জিডিপিতে ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের অবদান, শ্রমবাজারে
নারীর অংশগ্রহণের হার, নগরায়ণের
হার ইত্যাদিতে ভারতের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ এবং
অন্যান্য নির্দেশকে দ্রুত ধাবমান সেই দেশটির সমান হতে।
পাঁচ.
সামাজিক নির্দেশকে সার্বিক পর্যবেক্ষণ অমর্ত্য সেনের বিশ্লেষণে উঠে এসেছে। আসলেও
বিনায়ক সেন তার স্বকীয় ধারায় দেশগুলোর অবস্থান তুলে ধরেছেন। বলতে চেয়েছেন
যে, অধিকাংশ
সামাজিক নির্দেশকে পাকিস্তানের আগে অবস্থান বাংলাদেশের–শিশু মৃত্যুহার, মৃত্যুহার, মোট
প্রজননহার, প্রত্যাশিত
আয়ু, বয়স্ক
স্বাক্ষরতা এবং
মেয়েদের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক অন্তর্ভুক্তি প্রভৃতি। বস্তুত যখন
জদ্রেজ এবং অমর্ত্য সেন মনে করেন, এসব নির্দেশকের
ক্ষেত্রে ভারতসহ
অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের জন্য বাংলাদেশ পথপ্রদর্শক, তখন গর্বে বাংলাদেশির বুক ভরে
উঠে বৈকি।
এবার সামাজিক নির্দেশকের তুলনামূলক আলোচনায় একটু নির্দিষ্ট হওয়া যাক। নব্বইয়ের
দশকের শুরুতে ভারতের তুলনায় শিশু মৃত্যুহার বাংলাদেশে বেশি থাকা সত্ত্বেও ২০০০
পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের নিচে শিশু মৃত্যুহার নামাতে পেরেছে (বাংলাদেশ প্রতি হাজারে ১০০ থেকে ২৬, ভারত
৯৯ থেকে ২৮ এবং পাকিস্তান ১০৭ থেকে ৫৫)। পাঁচ
বছরের নিচে শিশু মৃত্যুহার হ্রাসে একই প্রবণতা লক্ষণীয় যেমনটি মোট প্রজননের ক্ষেত্রে–নব্বইয়ের
শুরুতে প্রতিবেশী দুই দেশের তুলনায় বেশি থেকেও ইদানীং সবচেয়ে কম। খর্বকায়
অনুপাত নব্বইয়ের দশকে প্রতিবেশী দেশ দুটো থেকে বেশি নিয়ে যাত্রা শুরু কিন্তু ইদানীং
বাংলাদেশের অগ্রগতি অন্যদের চেয়ে ভালো। নব্বইয়ের
দশকের শুরুতে প্রত্যাশিত আয়ু সবচেয়ে কম ছিল বাংলাদেশে ৫৮ বছর, এখন
প্রায় ৭৩ বছর। আর সেই সময় পাকিস্তানে ছিল সবচেয়ে বেশি ৬০ বছর, এখন
৬৭ বছর; ভারত
৫৭ থেকে সত্তরে তুলতে পেরেছে। অর্থাৎ, পাকিস্তান
ও ভারতের তুলনায় বাংলাদেশের মানুষ বেশি দিন বাঁচে এখন। অপরদিকে, মোট
এবং নারী বয়স্ক সাক্ষরতায় ভারতের পেছনে থেকেও এখন ভারতকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে
বাংলাদেশ যেমনি
করে মেয়েদের প্রাথমিক স্কুলে অন্তর্ভুক্তিতে। তবে
মাধ্যমিকে মধ্যখানে পা পিছলালেও আবার ঘুরে দাঁড়িয়ে ভারতকে পেছনে ফেলেছে বাংলাদেশ।
গেল তিন দশকে চিত্তাকর্ষক চিত্র দারিদ্র্য হ্রাসের বেলায়–চরম দারিদ্র্য
প্রকোপ ভারতের চেয়ে কম এই বাংলাদেশে। স্ববিরোধী মনে হলেও সত্যি যে, আর্থসামাজিক
ক্ষেত্রে কম কৃতিত্ব নিয়েও পাকিস্তানে দারিদ্র্যের হার ৪-৮ শতাংশ,
যা গবেষকদের ভাবায়। তবে
নিঃসন্দেহে কিছু ক্ষেত্রে করতে পারেনি যার মধ্যে আছে বৈষম্য, নারীর
শ্রমবাজারে অংশগ্রহণ, দারিদ্র্য (১.৯ ও ৩.২ আন্তর্জাতিক রেখায়), খর্বতা
ইত্যাদি।
ছয়.
কথায় আছেÑচকচক করলেই
সোনা হয় না। গেল চার দশকের বেশি সময় ধরে ‘অবিশ্বাস্য’ তথা অর্থনৈতিক
উন্নয়নের ধাঁধার আড়াল-আবডালে অভাবনীয় উত্থান ঘটেছে কালো এক অর্থনীতির (আন্ডার
গ্রাউনড ইকোনমি)। মূলত প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার কারণে ‘অর্থনৈতিক শয়তানের’ অভাবনীয় আবির্ভাব ঘটেছে। অন্ধকারে
থাকা এই অর্থনীতি সরকারকে রাজস্ব থেকে বঞ্চিত রাখছে, রাজনীতিকে কলুষিত করছে, বিকৃত
ভোগবাদী সমাজ সৃষ্টিতে জ্বালানি জোগাচ্ছে, সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটাচ্ছে, মোটাদাগে
এটা একটা টেকসই উন্নয়নের পথে প্রধান প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করছে। ক্ষেত্রবিশেষে এর
ভেতরে অথবা পাশাপাশি অবস্থান নিয়েছে সর্বব্যাপী চরম দুর্নীতি। যদিও এ দেশে দুর্নীতির ইতিহাস
বেশ দীর্ঘ, তারপরও বিশেষত বিগত দশকগুলোতে রাষ্ট্রীয় আনুকল্যে পুঁজিবাদ প্রসারণের
পথ বেয়ে উত্থান ঘটেছে এক শ্রেণির দাপুটে, ক্ষমতাবান দুর্নীতিবাজদের। বলা যায়,
সমাজের অভিভাবক এখন তারাই; দুর্নীতি প্রতিবছর জিডিপির ২ শতাংশের মতো গিলে খায়। তা
ছাড়া প্রতিবছর দেশ থেকে অবৈধ পথে পাচার হয় গড়ে ৭০০-৮০০ কোটি ডলার; ২০০৬ থেকে ২০১৫
পর্যন্ত নাকি ৬০০০ কোটি ডলার পাচার হয়েছে বলা হচ্ছে।
বাংলাদেশ বচনের দেশ
যেমন সারা অঙ্গে ব্যথা, ঔষধ দেব কোথায়। এমনকি রক্ষণশীল হিসেবেও ঋণখেলাপির পরিমাণ দেড় থেকে দুই লাখ কোটি টাকা। এদের
একটা অংশ বিদ্যমান আইনের ফাঁকফোকরে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি। শেয়ারবাজা তুঘলকি কাণ্ড
ঘটিয়ে উত্থান ঘটেছে একশ্রেণির ধনী মানুষের। ব্যাংক খাতের বিবর্ণ চিত্রের অর্থাৎ
বলবানদের আগ্রাসী থাবার কথা আপাতত না হয় থাক। ঋণখেলাপি, অর্থ পাচারকারী কিংবা ব্যাংক ডাকাতদের বেশিরভাগ, দেশে অথবা বিদেশে, দাপটে
ও সুখে আছেন। অবৈধ অর্থ আর সম্পদের জোরে
তারা কিনে নিয়েছে রাজনৈতিক নেতা এমনকি মিডিয়া ও বুদ্ধিজীবীদের। অর্থনীতির গ্রেসামস
ল’ অনুযায়ী,
মন্দ টাকা ভালো টাকাকে বাজারছাড়া করে, তেমনি আজ এই সমাজে মন্দ লোক ভালো লোককে কোণঠাসা
করে রাখছে। রাজনীতি কলুষিত হয়েছে কালোটাকায়; এদের অস্ত্রের ভাষা কেড়ে নিয়েছে আমজনতার
ভাষার অস্ত্র। অনেকেই যেন বুঝে গেছেন অর্থই সকল সুখের মূলÑমূল্যবোধ আঁকড়ে থাকা
দুর্বলের ধর্ম। উন্নয়নের রোল মডেলের গায়ে কি এসব কলঙ্কের দাগ মানায়?
আসুন, সাম্যবাদী-অসম্প্রদায়িক- দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে বলীয়ান হই এবং কেবল তখনই বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বিনির্মাণের পথ মসৃণ হবে।