সামসুল ওয়ারেস
প্রকাশ : ২৬ মার্চ ২০২৪ ০০:৪৫ এএম
আপডেট : ২৬ মার্চ ২০২৪ ১১:১১ এএম
সামসুল ওয়ারেস
স্মৃতিসৌধের ধারণাটা আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বরই উনি ঘোষণা দিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়া বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে একটা জাতীয় সৌধ নির্মাণ করতে হবে। সাভারের এই জায়গাটা তিনি বাছাই করেন। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, এখানে আমরা একটা স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করব। কারণ এখানে প্রায় দশটা জায়গায় অজ্ঞাত মুক্তিযোদ্ধাদের গণকবর আছে।
স্মৃতিসৌধের ইটের কাজ বঙ্গবন্ধুর আমলেই শুরু হয়। পরে ১৯৭৮ সালে একটি নকশা প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয় গণপূর্ত মন্ত্রণালয় ও স্থাপত্য অধিদপ্তর থেকে। বাংলাদেশের সব স্থপতিদের কাছে আহ্বান করা হয় নকশা। সেখানে বেশ কিছু নকশা জমা পড়ে। এ প্রতিযোগিতায় আমিও একজন বিচারক ছিলাম। স্থপতি মাজহারুল ইসলাম ছিলেন বিচারকমণ্ডলীর চেয়ারম্যান। যতদূর মনে পড়ে, সেবার ২৫ থেকে ৩০টি নকশা জমা পড়ে। সেই নকশাগুলোর মধ্যে আমরা কোনোটাই পছন্দ করতে পারিনি। আমরা তখন সরকারকে বললাম এই প্রতিযোগিতা যেন আবার আহ্বান করা হয়। দ্বিতীয়বারের প্রতিযোগিতায় প্রায় ৫০টির মতো নকশা জমা পড়ে। আমরা একই বিচারকমণ্ডলী মিলে সেগুলোর বিচার করি। এর মধ্যে স্থপতি সৈয়দ মইনুল হোসেনের কাজটাই আমাদের পছন্দ হয়েছিল।
১৯৭৯ সাল থেকে স্মৃতিসৌধের কাজ শুরু হয়ে যায়। সৈয়দ মইনুল হোসেন স্থাপত্য নকশার কাজ করেন। আর স্ট্রাকচারাল নকশার কাজটা করেন আমাদের নামকরা প্রকৌশলী শেখ মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ। তবে সামগ্রিকভাবে স্ট্রাকচারাল নকশা ও আর্কিটেকচারাল নকশার সম্পূর্ণ চিন্তাভাবনা স্থপতি সৈয়দ মইনুল হোসেনের। সব মিলিয়ে এখানে ৮৪ একর জমি ছিল। পরে আরও ২৪ একর জমি যোগ করা হয়। সৌধটির নির্মাণ ১৯৮২ সালে সম্পন্ন হয়।
স্মৃতিসৌধের ভেতর সাতটা অংশ আছে। সাতটি জোড়া ত্রিভুজ একটির পেছনে আরেকটি বসিয়ে পুরো বিষয়টা দাঁড় করানো হয়। সবচেয়ে সামনে যেটি আছে, সেটির নিচের অংশটা কম চওড়া কিন্তু উঁচু সবচেয়ে বেশি। উচ্চতা ১৫০ ফিট। এর পরেরটা একটু খাটো, কিন্তু চওড়ায় একটু বেশি। এভাবে এর পরেরটা আরও খাটো, আবার প্রস্থ বেশি। একটা বই যেমন অর্ধেকটা খুললে একটা অ্যাঙ্গেল হয়, সে রকম ত্রিভুজের কম্পোজিশন করে সাত জোড়া ত্রিভুজ বাসানো হয়েছে স্মৃতিসৌধে।
সাতটি স্তম্ভের কারণ হচ্ছে এর মাধ্যমে আমাদের মুক্তিসংগ্রামের সাতটি ধাপ চিহ্নিত করা। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্ন সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, ছাপ্পান্ন সালে শাসনতন্ত্রের অধিকারের দাবিতে আন্দোলন, বাষট্টি সালে শিক্ষা আন্দোলন, ছিষট্টিতে বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা, ঊনসত্তরে গণ-আন্দোলন এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধÑ এই সাতটা ভাগ।
এই স্মৃতিসৌধকে সামনে থেকে দেখলে এটাকে বক্ররেখার মতো মনে হয়। ডানের অর্ধেক ও বাঁয়ের অর্ধেক সমান ও একই রকম। এই সিমেট্রিক্যাল নকশা একটা বক্ররেখা তৈরি করে। কিন্তু এখানে কোনো বক্ররেখা নেই, সবই সোজা লাইন। ভিজ্যুয়াল ইলিউশনের কারণে বক্ররেখা মনে হয়। যেকোনো শিল্পের মধ্যে একটা জাদুকরী ব্যাপার থাকতে হয়। তা নাহলে সেটা শিল্প হয় না। সেই জাদুকরী ব্যাপারটা এখানে আছে। এটার সামনে থেকে পাশে গেলে সবকিছুর পরিবর্তন হয়ে যায়। পাশের সঙ্গে সামনে দেখা দৃশ্যের কোনো মিল নেই। এটা কংক্রিটে নির্মিত একটি সৌধ। কিন্তু এর মধ্যে আছে একধরনের পবিত্রতা। সুন্দর করে পালিশ করা কিছু নেই এতে। এ ধরনের কাজের জন্য স্মৃতিসৌধে একটা বার্তা রয়েছে। আমরা যে স্বাধীনতা পেয়েছি সেটা মনে রাখতে হবে এবং আমরা যে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার একটা অবস্থানে এসেছি সেটা এই স্থাপত্যের সামনে দাঁড়ালে মনে আসে।
স্মৃতিসৌধের আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে ওখানে কিন্তু গাড়ি নিয়ে যাওয়া যায় না। অনেকটা পথ হেঁটে যেতে হয়। পাশে কিছু পার্কিংয়ের জায়গা আছে। কিন্তু সেখানে গাড়ি রেখে বেশ কিছুদূর হাঁটতে হয়। আগের দিনে অনেক পবিত্র স্থাপত্য যেমন মন্দির, মসজিদ ইত্যাদির ক্ষেত্রে দেখা যায়Ñ এই হেঁটে সেটার কাছে যাওয়ার ব্যাপারটাও রয়েছে। এটাকে বলা হয় পলিগ্রমিজে। পলিগ্রমিজে মানেই হচ্ছে কিছুটা পথ হাঁটতে হবে। সেজন্য আগেরকালের মন্দিরগুলো পাহাড়ের চূড়ায় করা হতো। মানুষকে সেখানে হেঁটে হেঁটে যেতে হয়। এখনও ভারতের অনেক জায়গায় হেঁটেই উঠতে হয়। অনেক সিঁড়ি পার হতে হয়। স্মৃতিসৌধে এই পথ চলাটা একটা যাত্রা। এই যাত্রা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পথচলার সঙ্গে মেলানো যায়। সেটা ৯ মাসের একটা যুদ্ধ ছিল। বায়ান্ন থেকে ধরলে অনেক বছরের একটা যাত্রা আমাদের ছিল। এটার সমাপ্তিটা হয় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে জয়ের মাধ্যমে। সে জন্যই এটার একটা অর্থ আছে।
স্মৃতিসৌধের শুরুতেই আমরা দেখতে পাই লাল ইটের ব্যবহার। এ ঐতিহ্য আমাদের অনেক পুরোনো। আমাদের বাংলাদেশে প্রায় চার হাজার বছর আগেও ইটের ব্যবহার হতো। যেমন উয়ারী বটেশ্বরে আমরা দেখছি প্রায় চার হাজার বছর আগেই ইট ছিল। আমাদের দেশীয় উপাদান দিয়েই কাজটা আমরা করতে চেয়েছিলাম। আমরা যদি চাইতাম এটা মার্বেল দিয়ে মোড়ানো হোক, তাহলে মারবেল আনতে হতো পাকিস্তান, ভারত কিংবা ইতালি থেকে। তাহলে তো আমাদের দেশের জিনিস দিয়ে তৈরি হতো না। এটা একটা উদ্দেশ্য ছিল, আমরা যা-ই তৈরি করি না কেন, যতটা পারা যায় সেটা যেন আমাদের দেশের সামগ্রী দিয়েই তৈরি হয়। ইট কম খরচে হয় এবং এটা সহজে আমাদের এখানে পাওয়া যায়। এর আগে স্থপতি লুই আই কান আমাদের সংসদ ভবন কংক্রিট দিয়ে করেছেন, মাজহারুল ইসলাম চারুকলা ইনিস্টিটিউটে বা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইটের ব্যবহার করেছেন মুক্তিযুদ্ধের অনেক আগে। তাই আমরা মনে করেছি, ইটটাই আমাদের সঠিক উপাদান। আমাদের এই স্মৃতিসৌধ নির্মাণে খরচ হয়েছে তিন কোটি টাকার মতো। এমন একটি অসাধারণ স্থাপত্যের জন্য এ খরচ বেশি নয়।
সত্তরের দশকে তৈরি আমাদের স্মৃতিসৌধ আজও সমসাময়িক বেশ্বের একটি স্থাপত্য। বিদেশি অতিথিরা এ দেশে এলে এখানে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। তারাও মুগ্ধ হন এই স্থাপত্যের নির্মাণশৈলী দেখে। তাই নিঃসন্দেহে বলা যায় অনেক গর্বের এই স্থাপত্য যুগ যুগ ধরে প্রেরণা দেবে বাঙালিকে।
লেখক : স্থপতি-অধ্যাপক