× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

জাতীয় গণহত্যা দিবস

জাতিগত নিধনের প্রারম্ভ

মোহাম্মদ ফায়েক উজ্জামান

প্রকাশ : ২৫ মার্চ ২০২৪ ১০:৩০ এএম

মোহাম্মদ ফায়েক উজ্জামান

মোহাম্মদ ফায়েক উজ্জামান

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ঘুমন্ত বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানের আক্রমণ সাধারণ বাঙালির কাছে অতর্কিত হলেও সচেতন মানুষের কাছে খুব বেশি আকস্মিক ছিল না। কারণ যারা তখন পাকিস্তান শাসকদের আচরণ ও গতিপ্রকৃতি পর্যালোচনা ও পর্যবেক্ষণ করতেন তারা অনুধাবন করেন যে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী যেকোনো সময় নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। মার্চের গোড়া থেকেই পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় আন্দোলনকারী বাঙালিদের ওপর বিচ্ছিন্নভাবে আক্রমণ চালিয়েছে। ইতঃপূর্বে ১৯৬৯ সালে ড. শামসুজ্জোহা ও সার্জেন্ট জহুরুল হক হত্যাকাণ্ডের কথা বাদ দিলেও মাঝেই মাঝেই তারা এদেশের নিরীহ জনগণের ওপর গুলি চালিয়েছে; কিন্তু ২৫ মার্চ যে গণহত্যা তারা শুরু করেছিল তার পুরোটাই ছিল পূর্বপরিকল্পিত। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ তথা বাঙালিদের যেহেতু কোনোভাবেই পরাজিত করা সম্ভব হয়নি, তাই যেকোনো মূল্যে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা প্রদান না করার জন্য তারা শক্তি প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নেয়। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ভাষা আন্দোলনকে তারাÑ বিশেষ করে পাকিস্তানের জাতির জনক মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ্ হিন্দুদের ষড়যন্ত্র বলে মনে করেন। রাও ফরমান আলীর একটি লেখার মাধ্যমে আমরা বাঙালিদের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর দৃষ্টিভঙ্গি অনুধাবন করতে পারব।


তিনি লিখেছেন, ‘... বাংগালীরা সাধারণত বাংলা ভাষার মাধ্যমে ইসলামকে জানতে বুঝতে শিখেছে। এটা সর্বজনবিদিত, বাংলা ভাষায় ইসলামী চর্চা হয়েছে সামান্য এবং বাংলা ভাষাতে রয়েছে হিন্দী এবং সংস্কৃত শব্দের আধিক্য। আমি ওখানকার অনেক মৌলবীদের আল্লার বাংলা ‘প্রভু’ করতে শুনেছি। অথচ আল্লাহ এবং প্রভু আকাশপাতাল পার্থক্য, এতে কোনো সন্দেহ নেই।’ (রাও ফরমান আলী, ভুট্টো শেখ মুজিব বাংলাদেশ, ঢাকা : সৌখিন প্রকাশনী, নভেম্বর, ১৯৭৮, পৃ. ১০-১১। পাকিস্তানের উর্দু ডাইজেস্ট রাও ফরমান আলীর বক্তব্য বাণীবদ্ধ করে মার্চ, এপ্রিল ও মে সংখ্যায় ছাপে। পরবর্তীকালে এর বাংলা অনুবাদ করেন মোস্তফা হারুন)। রাও ফরমানের বক্তব্যে স্পষ্ট যে, বাঙালি মুসলমানদের তারা খাঁটি মুসলমান হিসেবে দেখেনি। তিনি একইভাবে আবার বলেছেন যে, ‘বাংলা সাহিত্যের প্রধান স্থপতি হলো হিন্দু সম্প্রদায়। স্বভাবতই এর বড় বড় কবি, সাহিত্যিক ও সাহিত্য যে পরিবেশে লালিত হয়েছে, সেখানে মুসলমানী রীতিনীতি, ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য অনুপস্থিত (ঐ, পৃ. ১১)। পৃথিবীর প্রত্যেক ভাষার মধ্যে মিশ্রণ আছে, কিন্তু পাকিস্তানিরা একে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে মূল্যায়ন করেছে। তারা হিন্দু সম্প্রদায়কে মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করেনি; এমনকি বাঙালি মুসলমানরাও প্রায় হিন্দুÑ এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচার করেছে। এজন্য ২৫ মার্চ ও গোটা ’৭১ ব্যাপী পাকিস্তানিদের যে গণহত্যা তা এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে হবে। পাকিস্তানি সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাস ১৯৭১ সালের জুন মাসে অনেক দিন কুমিল্লায় ছিলেন। সেখানে তিনি প্রতিদিনই হিন্দু বা মুসলিম অথবা কোনো খ্রিস্টানকে ধরে এনে হত্যা করতে দেখেছেন। তিনি সৈনিকদের জিজ্ঞাসা করেছেনÑ কেন তাদের হত্যা করা হচ্ছে। তারা তার উত্তরে বলেছে যে, পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার জন্য হিন্দুদের হত্যা করতে হবে। তাদের চোখে বাঙালি মানেই হিন্দু (দ্রষ্টব্য: অ্যান্থনি মাসকারেনহাস, দি রেইপ অব বাংলাদেশ, অনুবাদ : রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী, ঢাকা : পপুলার পাবলিশার্স, ২০১৯)।

১৯৭১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের বড় জেনারেলদের নিয়ে ইয়াহিয়া খান বৈঠক করেন এবং প্রথমে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে শায়েস্তা করার সিদ্ধান্ত নেন। পরে আলোচনার নামে সময়ক্ষেপণ করে বাঙালিদের ওপর চূড়ান্ত আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। প্রথম পর্যায়ের অভিযানের নাম দেওয়া হয় ‘অপারেশন ব্লিটজ্’ এবং ২৫ মার্চের হত্যাকাণ্ডের নামকরণ করা হয় ‘অপারেশন সার্চলাইট’ শেষোক্ত অপারেশন পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের মূল দায়িত্ব দেওয়া হয় রাও ফরমান আলী এবং খাদিম হোসেন রাজাকে (খাদিম হোসেন রাজা, অ্যা স্ট্রেঞ্জার ইন মাই ওন কান্ট্রি, ঢাকা : ইউপিএল, ২০১২, পৃ. ৪২, ৭২-৭৩)। তাদের এই অপারেশনের মূল উদ্দেশ্য ছিল : ১. বঙ্গবন্ধুকে জীবিত গ্রেপ্তার করা, ২. সেনা, নৌ, ইপিআর, পুলিশ বা অন্যান্য বাহিনীর বাঙালি সৈনিক ও কর্মকর্তাদের নিরস্ত্র বা বন্দি করা এবং এ ক্ষেত্রে প্রতিরোধের মুখোমুখি হলে তাদের হত্যা করা, ৩. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে করায়ত্ত করা। তারা পূর্বনিধারিত সময় অনুযায়ী রাত ১২টায় তাদের অপারেশন শুরু করে। এ প্রসঙ্গে খাদিম হোসেন রাজা আরও লিখেছেনÑ তাদের ওপর নির্দেশ ছিল যে, ইয়াহিয়া খান পশ্চিম পাকিস্তানে পৌঁছাবার পরেই অপারেশন শুরু হবে। ঠিক সেভাবেই অপারেশন শুরু হয়।

উপরোক্ত পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে তারা যা সামনে পেয়েছে তার সবই গুঁড়িয়ে দিয়েছে। যেসব মানুষ সামনে পড়েছে তাদের পাখির মতো গুলি করে মেরেছে। পিলখানা ইপিআর হেড কোয়ার্টার, রাজারবাগ পুলিশ লাইন এবং চট্টগ্রামের ইবিআরসিতে তারা একই সময়ে হামলা চালায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলা চালিয়ে ছাত্র ও শিক্ষকদের হত্যা করে। বিশেষ করে যেসব শিক্ষক বাংলা, বাঙালি ও বাঙালিত্বের প্রতি অনুরক্ত বা এ বিষয়াবলিকে উচ্চকিত করতে চান তাদেরই সেদিন হত্যা করা হয়। পাকিস্তানপন্থি কাউকে ভুলক্রমেও আঘাত করা হয়নি। অতএব এতে স্পষ্ট যে, যাদের হত্যা করা হবে তাদের তালিকা আগে থেকেই তৈরি করা হয় এবং টার্গেট মোতাবেক সবার আবাসস্থলে পাকিস্তান আর্মি পৌঁছে যায়। এই যে শিক্ষকদের বাসায় গিয়ে তাদের হত্যা করা হলো, এটি কোনো সাধারণ ব্যাপার নয়। তাদের বাঙালি দালালেরা এ বিষয়ে পূর্ণ সহায়তা করেছে। তারা ছিল প্রকৃতপক্ষে বাঙালিরূপী পাকিস্তানি। তাদের চেহারা বাঙালিদের মতো; কিন্তু মননে আপাদমস্তক পাকিস্তানি। তারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে পারেনি। কারণ আন্তর্জাতিকভাবে তারা এটিকে সামাল দিতে পারত না। তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করে শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের হত্যা করেনি, তারা ছাত্রী হলে ঢুকে তাদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায়। পুরো ৯ মাস এই বাঙালি নিধন চলেছে। পাকিস্তানিরা নারীর সম্ভ্রম নষ্ট করেছে, অসংখ্য নারীকে অন্তঃসত্ত্বা করেছে, বাবার সামনে কন্যাকে বা স্বামীর সামনে স্ত্রীকে এবং ভাইয়ের সামনে বোনকে ধর্ষণ করেছে। তারা এ দেশের সবুজ শ্যামলকে রক্ত দিয়ে লাল করতে চেয়েছে। এ এ কে নিয়াজী তার ‘বিট্রেয়াল অব ইস্ট পাকিস্তান’ গ্রন্থে লিখেছেন, টিক্কা প্রায়শ বলতেন যে আমি মানুষ চাই না ভূমি চাই (ঢাকা : ইউপিএল, ২০০০, পৃ. ৪৬)। যদিও এখানে নিয়াজী তার চেয়ে টিক্কাকে তিনি বেশি রক্তপিপাসু হিসেবে দেখিয়েছেন এবং তাকে হালাকু খান ও তৈমুর লংয়ের সঙ্গে তুলনা করেছেন, কিন্তু নিজের দায় স্বীকার করেননি। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ জাতিগত নিধনের যে সূচনা টিক্কা খান, রাও ফরমান ও খাদিম রাজা করেছিলেন, নিয়াজী নিজেও সেই ধারাবাহিকতা রক্ষা করেন। তবে শুধু সামরিক নেতৃত্বই যে এককভাবে এই হত্যাকাণ্ড চালায় তা নয়; রাজনৈতিক নেতৃত্বও পুরোপুরি এর পেছনে সক্রিয়ভাবে কাজ করেছে।

২৫ মার্চের হত্যাকাণ্ডের রাতে জুলফিকার আলী ভুট্টো ঢাকায় হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে অবস্থান করেন। তিনি সকালে উঠে টিক্কা, ফরমান, খাদিম ও জাহানজেব আরবাবকে অভিনন্দন জানান এবং বলেন যে, তোমরা পাকিস্তানকে রক্ষা করেছ, তোমাদের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত (নিয়াজী, পূর্বোক্ত, পৃ. ৪৫-৪৬)। এই যে রাজনৈতিক নেতৃত্বের ইন্ধন ও তত্ত্বাবধানে তার দেশের মানুষের ওপর গণহত্যা চালানোর নির্দেশ, এটি পৃথিবীতে নজিরবিহীন। কিন্তু এখনও প্রকারান্তরে এই হত্যাকাণ্ডকে সমর্থন করা হয়। পাকিস্তানিরা বাঙালিদের বা বাঙালি সংস্কৃতিকে হিন্দু সংস্কৃতি হিসেবে প্রচার করার যে নিরবচ্ছিন্ন প্রয়াস পেয়েছিল তা এখনও সমাজে বিদ্যমান। উগ্র সাম্প্রদায়িকতা এমনভাবে বিস্তার লাভ করছে যে, আসল বাংলাদেশকে চেনা কঠিন হয়ে পড়েছে। একাত্তরের গণহত্যাকারীরা ধর্মের লেবাস পরে মানুষকে তাদের অপকর্মকে লুকিয়ে রাখার জন্য ধর্মের জিগির তুলেছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরের প্রজন্ম ময়ূর পুচ্ছধারী এই কাকদের চিনতে পারে না। এই বন্ধুর পথ অতিক্রম করার প্রধান কাজটি রাজনীতিবিদদেরই করতে হয়। পৃথিবীর সকল দেশে তাই হয়েছে। যদি ২৫ মার্চকে জাতিসংঘের গণহত্যা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি আদায় করা যায়, তাহলে এর একটি সুদূরপ্রসারী ফল রয়েছে। গণহত্যার সঙ্গে যুক্ত পাকিস্তানি সেনা ও বাঙালি দালালদের সাম্প্রদায়িক মনোভাবের ওপর চপেটাঘাত পড়বে এবং তাদের কৃতকর্ম আবার নতুন করে সামনে আসবে। এখানে বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর ’৭১-এর ধর্ষকরা বড় বড় ধর্মবেত্তা বনে যায়। জেনারেল জিয়াউর রহমান ও জেনারেল এরশাদ এসব লম্পটকে রাজনৈতিকভাবে কাজে লাগান। ফলে বাংলাদেশ উদার ও প্রগতিশীল ভাবনা থেকে দূরে সরতে থাকে।

আজ গণহত্যা দিবস পালনের মধ্য দিয়ে আমরা অঙ্গীকার করতে চাই, যে স্বপ্ন নিয়ে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ ধারণাকে সামনে নিয়ে এসেছিলেন এবং তা বাস্তবায়ন করেছিলেন আমরা সেই বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে এগিয়ে যাব এবং এক্ষেত্রে ’৭১-এর মতোই সকল বাধাকে অতিক্রম করব। যুদ্ধাপরাধী পাকিস্তানি হানাদারদের বিচার না হওয়ার কলঙ্ক মোচনের উদ্যোগ রাষ্ট্রকে নিতে হবে কূটনৈতিক পর্যায়ে

  • শিক্ষাবিদ ও রাজনীতি-সমাজ বিশ্লেষক  
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা