প্রেক্ষাপট
দেবু ভট্টাচার্য
প্রকাশ : ২৫ মার্চ ২০২৪ ১০:১৭ এএম
দেবু ভট্টাচার্য
ব্যক্তি বা সমষ্টিগত
জীবন সামগ্রিকভাবে পরিবার কিংবা আরও বড় পরিসরে নানা প্রভাব ফেলে। মানুষ স্বভাবত কল্পনাপ্রবণ কিন্তু জীবন বাস্তবতায় পরিপূর্ণ; আর এই কল্পনা
ও বাস্তবের মধ্যে যখন অমিল দেখা যায় তখনই শুরু হয় মানসিক সংঘাত। যে অনন্ত, সীমাহীন
অনুভবকে পুঁজি করে অনেকেই, বরং বলা ভালো আমরা প্রায় সবাই; অস্তিত্বকে সামনের দিকে
এগিয়ে নিয়ে যাই, সেই অনুভূতিই জানে পথচলায় কত কিছু কতজনে পেছনে ফেলে আসেন। গভীর
অন্তর আত্মা কতবার অবিশুদ্ধ হয় কত নিষিদ্ধ জিনিসকে মনে ধরে, এই হিসাব যদি কোনো
যন্ত্র ধারণ করত তাহলে নিশ্চিত করে বলা যায়, কেউ আয়নার সামনে দাঁড়াতেন না। পৃথিবীর
অনেক কিছুই অনেকে নিজের খেয়ালে নেন না এবং দিন শেষে জানেন তার বা তাদের আশপাশে কত
কিছু খেয়াল করেই চলতে হয়।
যে নিজেকে খুব একা
ভাবেন নতুবা একাকিত্বে ডুবে থেকে সবকিছু থেকে নিজেকে আলাদা রাখতে চান, তিনি হয়তো
এটা ভুলেই যান তার একাকিত্বের প্রতিটি মুহূর্তে কেউ না-কেউ ঢুকে যাচ্ছেন যখন-তখন।
একাকিত্ব আসলে একটা নেশা এবং তাতে অনেকেই ডুবে থাকেন শুধু বিষাদমুক্তির আশায়।
কিন্তু তাতে কি সফল হওয়া যায়? অনেকেই অনেককিছু প্রশ্রয় দেওয়া পছন্দ করেন না কিন্তু
তিনিও তার অজান্তেই কতবার যে নিজেকে প্রশ্রয় দেন, সে হিসাবইবা কজন কষেন? বেড়াজাল
ছিন্ন করার ক্ষমতা নিয়েই মানুষ জন্ম নেয়। কিন্তু যে জাল মানুষ নিজে বুনে নিজেকে
আটকে রাখে, সেটাকে বেড়াজাল বলে না। যে নিয়ম মানুষ তৈরি করে, সে নিয়ম কোনো কোনো
মানুষই ভাঙে। থাকতে পারে তাতে নানা সমীকরণ। কতবার ভাঙলে একটা মানুষ একেবারে ভেঙে
যেত, সেটা যদি কোনো সমীকরণে মেলানো যেত, তাহলে মানুষের জীবনচিত্র নানাক্ষেত্রে
পালটে যেত এবং ঘুচে যেত চিন্তার বিভাজনও। সফল হওয়ার মানে শুধু এই নয়, যা চাইলাম তা
পেয়ে গেলাম, হেরে যাওয়ার কথা হেরে গেলাম, মনের ইচ্ছে পূরণ করে নিলাম, তেমন কিছু। সংকোচে
ভরা নিঃশব্দে রাতের অন্ধকারে চোখের জল ফেলে এক বুকভরা নিরাশার গল্প বয়ে বেড়ানো মানুষটি
যখন দেখে তার চারপাশের সব রাস্তা বন্ধ, তখন সে বুঝে সফলতা তেমন কোনো কিছু না। ঘুম
থেকে উঠেই বারবার ব্যর্থ হওয়া মানুষটাও জানে সফলতা তেমন কিছু না।
যে বা যারা বয়স বিশে
নিজেকে সুন্দর দাবি করেন, তিনি বা তারাই বয়স ত্রিশে যখন চেহারার কুশ্রী রূপটা
দেখতে শুরু করেন আর তা কেবলই ক্যারিয়ারের সৌন্দর্যের জন্য তখন তা আরও বেশি
মর্মস্পর্শী হয়। যে গল্প কারও কারোর চোখের জল ফেলে, সেই গল্পটা তার বা তাদের জীবনে
কি প্রেক্ষাপট তৈরি করে? কোনো কদাচারী-দুরাচারীকে ভালোবেসে কেউ যখন সেই মানুষটাকে
দোষে, সেই একই অপরাধে তাকেও কতবার দোষারোপ করা যায়—এ প্রশ্নও উঠতেই পারে। সব কথার শেষ কথা
হলো, জীবনের সব গল্প জয় দিয়ে শুরু হয় না, আবার সব গল্পে মানুষ হেরেও যায় না।
বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন একাধারে একজন আমেরিকান লেখক, চিত্রশিল্পী, রাজনীতিক, বিজ্ঞানী, সংগীতজ্ঞ, উদ্ভাবক, রাষ্ট্রপ্রধান, গণ-আন্দোলনকারী এবং কূটনীতিক। তার একটি মন্তব্য উদ্ধৃত করি। তিনি বলেছেন, ‘মানুষের জীবনে বিশ বছর পর্যন্ত ইচ্ছার রাজত্ব চলে, তিরিশ বছর পর্যন্ত চলে বুদ্ধির রাজত্ব এবং চল্লিশ বছর বয়সে বিচার-বিবেচনার রাজত্ব।’ আর ইংরেজ বহু বিদ্যাবিশারদ থমাস ইয়ং বলেছেন , ‘উচ্চাশা যেখানে শেষ হয়, সেখান থেকেই শান্তির শুরু হয়।’ এই প্রেক্ষাপটে আমরা বলতেই পারি, চিন্তার বিভাজন ঘুচিয়ে চিন্তাকে উদ্ভাবনী করলে, সেটা যেকোনো ক্ষেত্রেই হতে পারে; তা নিঃসন্দেহে জীবনের জন্য কল্যাণের বার্তা নিয়ে আসে। নিজের কাছে নিজের চিন্তার জবাবদিহিও প্রয়োজন।